Thank you for trying Sticky AMP!!

হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের খোঁজে

দালালের মাধ্যমে সমুদ্র পথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে এভাবেই ক্যামেরাবন্দী হন নৌকার লোকজন। তবে সৌভাগ্যক্রমে কোস্টগার্ডের নজরে পড়ে যাওয়ায় তাঁদের উদ্ধার করা হয়। গত বছরের শেষ দিকে টেকনাফের মহেশখালিয়াপাড়া সৈকত এলাকা থেকে ছবিটি তোলা। ছবি: ফাইল ছবি

এখন যেমন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আন্দোলন এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আরোপিত ভ্যাটের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের রাজপথে নামা গণমাধ্যমের প্রধান শিরোনাম, কয়েক মাস আগে সেই জায়গা দখল করেছিল সমুদ্র পথে মানবপাচারের ঘটনা।
গত কয়েক বছরে পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে বাংলাদেশের কত মানুষ যে নিঃস্ব ও রিক্ত হয়েছেন, কত মানুষ যে বিদেশের জঙ্গলে, মরুভূমিতে, আশ্রয়শিবিরে বা কারাগারে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন, তার খবর যেমন আমরা রাখি না, তেমনি পুরো তথ্য নেই সরকারের খাতায়ও।
মাঝে মধ্যেই গণমাধ্যমে খবর বের হয় যে বিদেশের কারাগারে বাংলাদেশি কোনো নাগরিক আটক রয়েছেন কিংবা আশ্রয় শিবিরে ঠাঁই পেয়েছেন।সেসব অনেকটাই গা সওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু সম্প্রতি থাইল্যান্ডের উপকূলে নৌকাডুবিতে ​বেশ কিছু বাংলাদেশি নাগরিক মারা যাওয়ায় চার​দিকে হইচই পড়ে যায়। আন্তর্জাতিক মহলও তাদের পাশে এসে দাঁড়ায়। কিন্তু আমরা ঠিক জানি না কতজন নাগরিক বিদেশে গিয়ে নিখোঁজ রয়েছেন।
শুধু কি সমুদ্র পথে? মানুষ পাচার হয়ে যাচ্ছে স্থল পথে। পাচার হয়ে যাচ্ছে আকাশ পথেও। ​এক শ্রেণির দালালচক্র বিভিন্ন গ্রামে বিদেশে লোভনীয় চাকরি দেওয়ার নাম করে তরুণদের বিদেশে পাচার করে দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক চক্রের সঙ্গে এই দালালদের রয়েছে যোগসাজশ। স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর সদস্যদেরও তারা নানাভাবে ম্যানেজ করেন। মানবপাচারের কূটকৌশলটি বেশ অভিনব। প্রথমে বলা হয়, বিদেশে যেতে কোনো অর্থ লাগবে না; একখানা পাসপোর্ট হলেই চলবে। ভিসা, যাতায়েত সব তাদের।
কিন্তু দালালচক্রের ফাঁদে পা একবার কেউ পা দিলেই পদে পদে বিপদ। কোনোভাবে টেকনাফে নিয়ে যেতে পারলেই হলো। তারপরই পাচারকারীদের আসল চরিত্র উন্মোচিত হয়। ছোট জাহাজ বা সাম্পান থেকে বড় জাহাজে তোলার সময়ই বড় অঙ্কের টাকা দাবি করা হয় অথবা সমুদ্রে ডুবিয়ে দেওয়ার ভয় দেখানো হয়। এরপর ওই ব্যক্তিকে দিয়ে আত্মীয়স্বজনকে ফোন করিয়ে বলা হয়, এত টাকা না দিলে তাকে ছাড়া হবে না। সেই টাকা পরিশোধের পরও রক্ষা নেই। কখনো গভীর সমুদ্র থেকে, কখনো থাইল্যান্ড বা মালয়েশীয় উপকূল থেকে ফের টেলিফোন করে আরও বড় অঙ্কের অর্থ দাবি করা হয়। সেই অর্থ পরিশোধ করলেও সবাই নিরাপদে গন্তব্যে যেতে পা​রবে কিংবা চাকরি পাবে সেই নিশ্চয়তা নেই।
এভাবে একজন বিদেশগামী ব্যক্তির কাছ থেকে দুই থেকে চার লাখ টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়। এই অর্থ ভাগাভাগি হয়ে যায় দেশি-বিদেশি দালালচক্র এবং যেই দেশে তাদের পাচার করা হয়, সেই দেশের পুলিশ-কর্মকর্তাদের মধ্যে। আর আমাদের দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, কোস্টগার্ড বা বিজিবিই কী করছে? তারা কি পাচারকারীদের সুলুকসন্ধান জানে না? যাত্রার শুরুতে যদি তাদের আটকানো যেত তাহলে এই মানব বিপর্যয় ঘটত না।
তবে দেশি বিদেশি তৎ​পরতায় সাম্প্রতিককালে মানবপাচার কমেছে। আবার বিভিন্ন মহলের সহায়তায় গত কয়েক মাসে ​বিদেশে পাচার হওয়া অনেক নাগরিককে উদ্ধার করাও সম্ভব হয়েছে। আবার অনেককে যে এখনো উদ্ধার করা যায়নি সেই সত্যই বেরিয়ে এলো অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রাম (ওকাপ) ও ভালোবাসি বাংলাদেশ নামে দুটি সংগঠনের রোড শোতে। তারা গত শনিবার রাজধানীর শনিরআখড়া থেকে নরসিংদী পর্যন্ত এই রোড শোর আয়োজন করে মানবপাচারের বিরুদ্ধে গণসচেতনতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে। এতে অংশ নিয়েছিলেন মানবাধিকার কর্মী হামিদা হোসেন, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক নূর খান, কারাম এশিয়া অঞ্চলের সমন্বয়ক হারুন অর রশিদ এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। এর আগে হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডার নামে একটি সংগঠন কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত একই কর্মসূচি পালন করেছে। উদ্যোক্তাদের একজন প্রথম আলোকে বললেন, তারা সিরাজগঞ্জ, সাতক্ষীরাসহ ​আরও অনেক জেলায় অনুরূপ কর্মসূচি নেবে।
তাদের কাছে পেয়ে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের বেশ কয়েকজন স্বজনহারা মানুষ কারও সন্তান, কারও ভাইকে ফেরত পাওয়ার আকুতি জানান। তাঁদের কেউ জানালেন, স্বজন থাইল্যান্ডের কারাগারে আছেন​, কেউ বললেন, দালালদের খপ্পরে পড়ে প্রিয়জন মালয়েশিয়ায় গিয়ে আর ফিরে আসেননি। একেকটি ঘটনা একেকটি পরিবারের ​মানবিক বিপর্যয়। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রের এসব নিয়ে তেমন মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। কেন এত বিপুলসংখ্যক মানুষ বিদেশে যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে? কেন তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্র পাড়ি দেয়, মরুভূমিরা দুর্গম পথ বা সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া ডি​ঙানোর চেষ্টা করে? দেশে যদি আমরা তাদের ন্যূনতম কর্মসংস্থান করতে পারতাম তাহলে হয়তো এই মানবিক বিপর্যয় এড়ানো যেত।

কক্সবাজারের রামু উপজেলার দুর্গম দারিয়ারদীঘি গ্রাম। গ্রামের একেবারে দক্ষিণে দিনমজুর আবদুল শুক্কুরের মাটির ঘর। ঘরের দাওয়ায় বসে বড় ছেলে হারুন অর রশিদের (১২) দুটি ছবি হাতে শুক্কুরের স্ত্রী হাজেরা খাতুন। আড়াই বছর আগে তাঁকে অপহরণ করে থাইল্যান্ডে পাচার করে দালালেরা। সেই থেকে হারুন নিখোঁজ। ছবি: ফাইল ছবি

গতকালের শনিবারে পত্রিকায় দেখলাম, মালয়েশিয়ায় ​আটক আটক সন্তানকে ফিরে পাওয়ার জন্য মুক্তি পান আদায় করার পরও সন্তানকে ফিরে পাননি পিতা। তাঁকে সেখানে হত্যা করা হয়েছে। আর কত সন্তানকে আমরা এভাবে বেঘোরে মরতে দেব?
কেবল নরসিংদী বা আড়াই হাজারে নয়, বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে স্বজন হারানোর কান্না আমরা শুনতে পাচ্ছি। হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডার, কাপ বা অন্য কোনো সংগঠন হয়তো জনসচেতনতা তৈরি করতে পারে, কেউ যাতে ভবিষ্যতে প্রতারিত না হন, সে ব্যাপারে জনগণকে সজাগ করে দিতে পারে। কিন্তু বিদেশে যারা ইতিমধ্যে পাচার হয়ে গেছেন, তাদের ফিরিয়ে আনার কাজটি করতে হবে সরকারকেই।
সরকার এবং বেসরকারি সংগঠনের সম্মিলিত ও সমন্বিত প্রয়াসেই আমরা মানবপাচার রোধ করতে পারি। আসুন, আমরা বাংলাদেশকে ভালোবাসি। আর যারা এই বাংলাদেশে মানবপাচারের মতো ঘৃণ্য কাজ করে, তাদের ঘৃণা করি।