Thank you for trying Sticky AMP!!

হিন্দুবাড়ির রান্না

সুবিমল ঘোষ পশ্চিম বাংলার রোটারির গভর্নর ছিলেন [১৯৯০-৯১]। একাধারে কলকাতা ক্লাবের সভাপতি এবং নামকরা চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। স্ত্রী চিত্রা ঘোষ শরৎ বসুর কন্যা। শরৎ বসু নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর বড় ভাই। বাংলাদেশের রোটারির গভর্নর আমি। কলকাতায় আসমা ও আমি ওঁদের বাসায় বেশ কয়েকবার অতিথি হই। এখন নেই সে সুবিধা। থাকেন রবীন্দ্রনাথের আপন নিবাস বোলপুরে। তঁার বাড়ির রান্নার স্বাদ গ্রহণ করেছি। অপূর্ব, তবে তা ঠাকুরের রান্না, ইউরোপিয়ান আইটেমই বেশি।

কলকাতায় গিয়ে জীবনে প্রথম হিন্দুবাড়ির রান্না খেলাম। অত্যন্ত সুপ্রাচীন ব্রাহ্মণ পরিবারের একজন গৃহিণী, আগে ছিলেন নামকরা নৃত্যশিল্পী। আজ তাঁরই রান্না আমার জীবনের একটি অক্ষয় ভোজন স্মৃতি। আগরতলা থেকে ফিরে ঢাকার পথে দু-তিন ঘণ্টা হাতে, ভাবলাম মধ্য কলকাতায় একটি বড় চায়নিজ রেস্টুরেন্টে আহার সমাপন করব। কিন্তু তার সুযোগ আর হলো না।

গেলাম সম্ভ্রান্ত পাড়া সল্টলেকের একটি বাড়িতে। সুন্দর পাতাবাহার দিয়ে সাজানো বাগান। প্রতিটি বাড়ি ফুল দিয়ে সজ্জিত। এমনই প্ল্যানিং যে মনে হয় কলকাতার বাইরে আছি। সুন্দর সজ্জিত ড্রয়িংরুম। সেখানে অপেক্ষা করছেন গৃহকর্ত্রীর মা, যিনি আমার সমবয়সী। রবীন্দ্রনাথকে কাছে থেকে দেখেছেন। আব্বাসউদ্দীনের গান শুনেছেন, তাঁর পুত্রকে দেখার জন্য অপেক্ষা। কয়েক মিনিটে হয়ে গেলেন অনেক কাছের মানুষ। কিছুক্ষণ পরই তাঁর বড় বোন এসে হাজির। তাঁর চেয়ে সাত বছরের বড়। তাঁর প্রজ্ঞা দেখে আমি নতজানু। সামান্য কয়েকটা বই লিখেছি। ভেবেছি, আমি না জানি কী হয়ে গেলাম। তাঁর পদ স্পর্শ করলাম। পরপরই তাঁরা দেখতে চাইলেন কীভাবে নামাজ পড়ি। দুই রাকাত জোহরের কসর পড়লাম। মোনাজাতে আল্লাহর কাছে চাইলাম এই বাড়ির সবার নিরাপত্তা, সুখ ও সমৃদ্ধি। দেখলাম, ড্রয়িংরুমে রাখা পূর্বপুরুষদের তেলচিত্র। মুহূর্তে বোঝা গেল এদের এক শ বছরের ইতিহাস। এরা সংস্কৃতিতে সমুন্নত। তাঁদের ছেলেটি ছয় ফুট লম্বা। ধোনি হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। নজরুল ও আব্বাসউদ্দীনকে তাঁরা সঙ্গে রেখেছেন। ভুলবেন না কোনো দিন। প্রতি গান ভালোবাসার ধন। তাই আমার সম্মান। অথচ আমি কিছুই নই।

হিন্দুদের কাছ থেকে দেখিনি, খাইনি ওদের বাসায় গিয়ে। রান্নার সুখ্যাতি শুনেছি সৈয়দ মুজতবা আলীর বইতে। আমি কখনো খাইনি, কী লিখব? আজ প্রস্তুত, প্রথম আইটেম: সুক্তো। আমার স্ত্রী ওদের আইটেমের খবর পেয়েছেন দেশ পত্রিকা থেকে। আমি সুনীল ও শীর্ষেন্দুর বইতে। ওরা আমাদের খবর পেয়েছে হ‌ুমায়ূনের কাছে। এখন পাচ্ছে আমার বইগুলোতে।

সুক্তো খেয়েই আমার মায়ের কথা মনে হলো। মা-ও পারতেন। ডোমারের মেয়ে। এরপরে এল ভেটকি মাছের পাতুরি। এত সুন্দর রান্না জীবনে খাইনি। ভেটকি মাছ এত সুস্বাদু হয়, তা জানতাম না। দুটি টুকরো। অনেকক্ষণ ধরে রসিয়ে খেলাম। সুস্বাদের কারণ জানলাম পাতুরির সংযোগ। এরপর সরষে দিয়ে ইলিশ। পেটির টুকরো মাত্র একটিই ছিল। ওরা জানতে চাইলেন পদ্মা না গঙ্গা, কোন নদীর ইলিশের স্বাদ বেশি? বললাম, পদ্মা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে শেখ হাসিনা অনেক পদ্মার ইলিশ পাঠিয়েছেন। লোকমুখে শোনা।

ছিল ডাল, আর কিছু না। এরপর ছিল মিষ্টি। ওরা জানত আমার ডায়াবেটিস। এত ভালো মিষ্টিবিবর্জিত মিষ্টি আর কোথাও পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ। হিন্দুবাড়ির সমস্ত সুষমা এই কয়েক আইটেমে। আমার জীবনে প্রথম হিন্দু ব্রাহ্মণকন্যার হাতে খাওয়া। হয়তো এখানে আমার আর কোনো দিন আসা হবে না। যাঁরা আমাকে এনেছেন এখানে, তাঁদের জন্য আল্লাহর কাছে মঙ্গল কামনা করলাম। ওদের নাম বলার প্রয়োজন নেই। আমার অন্তরে লেখা আছে। ছোঁয়াছুঁয়ি উঠে গেছে। ক্রমশ মানুষ হয়ে উঠছি আমরা।

এরপর তিন-চারটি প্রতিষ্ঠান থেকে আমাকে করা হলো মাল্যদান। তাদের নাম: সৃজন, শোভা, কল্যাণী, মনদরিয়া। তাঁদের নাম-ঠিকানা সবই আছে। তাঁরা ভালোবাসেন ‘গঙ্গা আমার মা, পদ্মা আমার মা’। বলেন, ‘একই আশা ভালোবাসা কান্না হাসির একই ভাষা/ দুঃখ সুখের বুকের মাঝে একই যন্ত্রণা’। বলেছি শুধু রান্নার কথা, অন্যদিকে গেলাম না। ভালোবাসা প্রবেশের অনেক পথ। নীলিমা ইব্রাহিম বলতেন আমার স্ত্রীকে, ‘আসমা, স্বামীকে বাগে রাখবে রান্না দিয়ে।’ আর আজ প্রথম হিন্দুবাড়ির রান্না খেয়ে আমার চোখে অশ্রু।

আগরতলায় এক অপূর্ব সমাবেশে গান গাওয়ার সুযোগ হলো। রবীন্দ্রনাথের ও আব্বাসউদ্দীনের গান একসঙ্গে। আমি গাইলাম আব্বাসউদ্দীনের গান আর আগরতলা ও কলকাতার শিল্পীরা গাইলেন রবীন্দ্রনাথের। মিলিয়ে দিলাম পশ্চিমবঙ্গ, আগরতলা ও বাংলাদেশ একটি গানে। ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে’। রাজ্যপাল বক্তৃতায় জানালেন আব্বাসউদ্দীনের প্রতি বাঙালির ঋণ। দুই ঘণ্টা গান গাওয়ার পরও শ্রোতারা তৃপ্ত নন। আরও চাই। নিয়ে গিয়েছিলাম আমার লেখা: সুরের কুমার: শচীনদেব বর্মণরবীন্দ্রনাথ: প্রেমের গান। মুহূর্তে বই উধাও। বিনা পয়সায় কাউকে বই দিই না। কিছু টাকা পকেটে এসে গেল। কিনলাম: ত্রিপুরেশ্বরী মন্দিরের বিশ্ববিখ্যাত পেড়া, আগরতলার হাতের কাজ।

আগরতলায় আমাদের অ্যাসিস্ট্যান্ট হাইকমিশনার খাওয়ালেন ডিনার। তবু কলকাতায় হিন্দুবাড়ির খাওয়া ভুলতে পারছি না।

মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সাহিত্য-সংগীত ব্যক্তিত্ব।

mabbasi@dhaka.net