Thank you for trying Sticky AMP!!

হি প্রোডাক্ট বনাম শি প্রোডাক্ট

সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া আমার ছেলেটির ত্বকে বয়ঃসন্ধির কিছুটা প্রভাব পড়েছে। তাই ওর হাতে তুলে দিয়েছিলাম একটি হারবাল ফেসওয়াশ। ফেসওয়াশটি মেয়েদের পণ্য বলেই বাজারে পরিচিত। পণ্যটির মোড়কও তাই বলে। বয়ঃসন্ধিতে নিজের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে সচেতন হতে শুরু করা আমার কিশোর ছেলেটি পণ্যটি হাতে পেয়েই জিজ্ঞেস করেছিল, ‘এই ফেসওয়াশটি কি ছেলেরাও ব্যবহার করতে পারে? আমি তো ভেবেছিলাম এটি শুধুই মেয়েদের জন্য।’ ছেলেকে বুঝিয়ে বললাম, ‘এটি ব্যবহার করতে ছেলেদের কিন্তু কোনো বাধা নেই।’ তবে আমার এই যুক্তি তার খুব একটা মনে ধরেছে বলে মনে হলো না। তারপরও আমাকে খুশি করার জন্য সে পণ্যটি ব্যবহার করতে শুরু করল এবং কিছুদিন পর বেশ ভালো ফলও পেল। কিশোরের অনুসন্ধিৎসু মন জানতে চাইল, কেন পণ্যের এই জেন্ডার বিভাজন। প্রশ্নের উত্তরটি কিন্তু সহজ ছিল না আমার জন্য।

পণ্যের জেন্ডার বিভাজনের বিষয়টি যেন দিন দিনই প্রকট হয়ে উঠছে; অথচ পণ্যের এই বিভাজনটি কিন্তু খুব কম ক্ষেত্রেই প্রয়োজনীয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিভাজনটি আরোপিত। নারী-পুরুষের প্রচলিত ও প্রত্যাশিত ভূমিকার ওপর ভিত্তি করে পণ্যের বিভাজন তো আছেই, তার ওপর একই পণ্যের নারী-পুরুষ বিভাজনের হাস্যকর সাম্প্রতিক প্রবণতাটি প্রভাব ফেলছে নারী-পুরুষের সামাজিক অবস্থানের ওপর, বাড়িয়ে দিচ্ছে বৈষম্য। আরোপিত এই বিভাজনটি পণ্য বিপণনের অনন্য এক কৌশল, যা সমাজে বিরাজমান জেন্ডার বৈষম্যকে স্থায়ী রূপ দিচ্ছে। শুধু তা–ই নয়, কৌশলটি নারী কিংবা পুরুষ পরিচয়ের বাইরে যে মানুষগুলো বৈচিত্র্যময় লৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী, তাদের অস্তিত্বের প্রতি চরম উদাসীনতা ও অবজ্ঞা প্রকাশ করছে।

পণ্য বিভাজনের প্রক্রিয়াটি শুরু হয় মূলত একটি মানব ভ্রূণের লিঙ্গ পরিচয় নিশ্চিত হওয়ামাত্রই। অনেক পরিবারেই শিশুর লিঙ্গ পরিচয়ের ওপর ভিত্তি করে অনাগত শিশুটির জন্য জিনিসপত্র কেনাকাটার ধুম পড়ে যায়। সাধারণের এই আবেগ আর আতিশয্যকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতে থাকে ব্যবসায় মুনাফা লাভের কৌশল। ছেলে আর মেয়ে পরিচয়ের ওপর ভিত্তি করে পণ্যকেও এমনভাবে বিভাজিত করা হয় যার আদৌ কোনো প্রয়োজন নেই। শুধু জনন অঙ্গ ছাড়া একটি সদ্যোজাত ছেলে আর মেয়ের মধ্যে আর কোনো পার্থক্য কিন্তু থাকে না। অথচ জন্ম হতে না হতেই শিশুর ন্যাড়া মাথায় ফুলেল ফিতার উপস্থিতি জানান দেয়, শিশুটি মেয়ে।

অন্যদিকে ছেলে শিশুকে সাজিয়ে তোলা হয় কালো কিংবা নীলে। কোমল গোলাপি সুন্দরী রাজকন্যার প্রতিমূর্তির বিপরীতে শিশু খুঁজে পায় শৌর্য–বীর্য ও বুদ্ধিতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী, গাঢ় নীল পোশাকে সজ্জিত রাজার প্রতিমূর্তিকে। শিশুর জন্য জেন্ডার নিরপেক্ষ গল্পের বই, পোশাক, কসমেটিকস, খেলনা, চকলেট এমনকি চিপস কিনতে গেলে রীতিমতো গোলক ধাঁধায় পড়ে যেতে হয়। ছেলে আর মেয়ের জন্য সমাজ প্রত্যাশিত রং, চেহারা কিংবা ভূমিকা আমাদের মস্তিষ্কে এমনভাবে প্রথিত হয়ে থাকে যে আমরা এ থেকে বের হতেই পারি না। শিশুর বুদ্ধি হওয়ার আগেই তার মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয় তার চেহারা, অবয়ব এবং আচরণসংক্রান্ত সমাজের প্রত্যাশা।

জামাকাপড় তো বটেই এমনকি খেলনা, গল্পের বই, কলম-পেনসিল-পেনসিল কাটার, স্কুলব্যাগ, চকলেটসহ প্রতিটি প্রয়োজনীয় পণ্যে সে বারবার বিষয়টির প্রতিফলন পায়।
সৌন্দর্যবর্ধনকারী পণ্য তো বটেই; ইদানীং চা, কফি, ঠান্ডা পানীয় কিংবা চকলেট, চিপসের মতো পণ্যগুলোকেও হাস্যকরভাবে বিভাজিত করা হয়। পণ্যের মোড়কের কোমল রং আর ফুলেল ডিজাইন ভোক্তাকে জানান দেয় নারীকে হতে হবে ফুলের মতো কোমল আর সুন্দর। অন্যদিকে পুরুষের জন্য নির্ধারিত পণ্যের মোড়কে গাণিতিক ও জ্যামিতিক নকশার উপস্থিতি, সুঠাম ও শক্তিশালী দেহাবয়ব আর তথাকথিত কড়া পুরুষালি রঙের ব্যবহার বলে দেয় পুরুষকে ঝুঁকি নিতে জানতে হবে, তাকে হতে হবে দৃঢ়, কঠিন, কৌশলী ও হিসাবে পাকা। একই পণ্যের ভিন্ন এই উপস্থাপন সমাজ সৃষ্ট নারী-পুরুষের বৈষম্যকে দীর্ঘস্থায়ী করতে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখছে। সমাজ নারী কিংবা পুরুষের জন্য তৈরি করে রেখেছে সাফল্যের আলাদা মানদণ্ড। আর সেই নির্ধারিত মানদণ্ড অর্জনের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে ‘নারী’ কিংবা ‘পুরুষ’ সিল বসানো এই পণ্যগুলো।

কিছুদিন আগপর্যন্ত পণ্য, বিশেষ করে সৌন্দর্যবর্ধনকারী পণ্যের বিপণনে মেয়েদের আকৃষ্ট করার প্রবণতাই লক্ষ করা গেছে অনেক বেশি। পণ্য ব্যবহারের মাধ্যমে ঝলমলে মায়া সৌন্দর্যের আধকারী হয়ে ওঠার সেই আহ্বানে নারীরাও ব্যাপক হারে সাড়া দিয়েছেন। সে ধারা আজও অব্যাহত আছে। তবে কয়েক বছর ধরে পুরুষদের এই দৌড়ে শামিল করা হয়েছে। তবে নারী আর পুরুষের এই দৌড়ের পার্থক্যটি হলো নারীর সৌন্দর্যের পরিপূর্ণতা যেখানে রমনীয়তা, কমনীয়তা আর উজ্জ্বলতা লাভের মধ্যে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে, সেখানে পুরুষের সৌন্দর্যের সম্পূর্ণতাকে শক্তি, ক্ষমতা আর আধিপত্য লাভের মাধ্যম হিসেবে দেখানো হচ্ছে। সৌন্দর্য কিংবা শক্তির এই অলীক স্বপ্ন পূরণে পুরুষ কিংবা নারী কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ খরচ করতেও কুণ্ঠা বোধ করছেন না। মাঝখান থেকে মুনাফা ঘরে তুলে নিচ্ছে বিভিন্ন কোম্পানি। তারা গ্রাহকদের সৌন্দর্য কিংবা শক্তি-সামর্থ্যের এমন এক মরীচিকার পথ দেখাচ্ছে, যার অস্তিত্ব বাস্তব জীবনে নেই বললেই চলে। আপাতদৃষ্টিতে ক্ষতিকর মনে না হলেও পণ্যের এই জেন্ডার বিভাজনে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নারী-পুরুষ উভয়ই। তাদের আত্মবিশ্বাস মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

পণ্যের বিপণনের ভোক্তার প্রয়োজন মাথায় রেখে তার উপস্থাপন আলাদা হতেই পারে। তবে সে ক্ষেত্রে শুধু জেন্ডার নয়, আরও বিবেচনা করা প্রয়োজন ভোক্তার আগ্রহ, বয়স, চাহিদা, পারিপার্শ্বিকতা, ভৌগোলিক অবস্থানসহ নানা বিষয়। পণ্যের অকারণ যে উপস্থাপন নারী ও পুরুষের বৈষম্যকে উসকে দেয় ও সমাজে নারীর অবস্থানকে অবদমিত করে, তা কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত নয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলো এক–দেড় দশক ধরে জেন্ডার বিভাজন নিয়ে বিপণনকারীদের যতটা আগ্রহ দেখা গেছে, অন্যান্য বিষয়গুলো নিয়ে ততটা মনোযোগী হতে দেখা যায় না। শুধু তা–ই নয়, আমরা চাই পণ্যের গুণগত মানোন্নয়নে উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকতর মনোযোগ। যে বিপণন কৌশল নারী, পুরুষ কিংবা অন্য লিঙ্গগত বৈশিষ্ট্যের অধিকারী মানুষগুলোর মধ্যে বৈষম্য কিংবা বিভাজন তৈরি করে, তা কখনোই কাঙ্ক্ষিত হতে পারে না।

নিশাত সুলতানা লেখক ও উন্নয়নকর্মী
purba_du@yahoo.com