Thank you for trying Sticky AMP!!

হেফাজতে হত্যা নিয়ে দায়ীদের গালগল্প

গত মাসে যশোরের শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের তিন কিশোর হত্যা সরকারি হেফাজতে ঘটা প্রথম হত্যাকাণ্ড নয়। বলা যায়, ‘সাত খুন মাফ’–এর সময়কাল থেকেই কিংবা তারও আগে থেকে হেফাজতে হত্যা প্রায় ডালভাত। কখনো এসব হত্যাকাণ্ড চালিয়ে দেওয়া হয় আত্মহত্যা বলে, কখনো বলা হয় ‘দুই পক্ষের সংঘর্ষ’। নিহতের সংখ্যা কম হলে বা কোনো সাক্ষী না থাকলে কিংবা ঘটনা সামলে ফেলা গেলে হত্যা হয়ে যায় আত্মহত্যা। না হলে সংঘর্ষের বহুল প্রচলিত বয়ান তো রয়েছেই।

গত স্বাধীনতা দিবসে বরগুনার আমতলী থানায় সিলিংয়ের সঙ্গে দড়িতে বাঁধা শানু হাওলাদারের লাশের ছবি আমরা ঝুলতে দেখেছি। এ বছরের ১৯ জানুয়ারিতে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানাহাজতে থাকা আবু বক্কর সিদ্দিক (৪৫) নাকি গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। পরের দিন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘হেফাজতে “আত্মহত্যা” করলেও পুলিশ এর দায় এড়াতে পারে না।’ দায়ের এ তালিকা অনেক বড়। টেকনাফের অভিযুক্ত ওসি প্রদীপের ভাষায় এসবই হচ্ছে গায়েবি আত্মহত্যা।

যশোরের শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে গায়েবি আত্মহত্যার ঘটনার কথা বলে শেষ করা যাবে না। নিজেদের মধ্যে মারামারির ফল বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টাও নতুন নয়। ঠিক যেমন চেষ্টা করা হয়েছিল পঞ্চাশের দশকে খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ডের সময়। গুলি করার সময় পুলিশ সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল দাগি অপরাধী কয়েদিদের একটা লাঠিয়াল দল। ‘রাজবন্দীদের তারা নির্মমভাবে লাঠিপেটা করে ২০-২৫ মিনিট ধরে’ (খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ড ১৯৫০, মতিউর রহমান, পৃষ্ঠা ৬৩)। তখনো চেষ্টা হয়েছিল ঘটনাটা বিহারি কয়েদি বনাম বাঙালি কয়েদিদের দাঙ্গা বলে চালিয়ে দেওয়ার। বঙ্গবন্ধু তাঁর রোজনামচায় সে মারপিটের বর্ণনা দিয়েছেন, ‘...আর যাঁরা বেঁচে আছেন তাঁদের অবস্থা শোচনীয়। কারণ, এমনভাবে তাঁদের মারপিট করেছে যে জীবনে কিছুই করার উপায় নাই’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা ১৮৬)। যশোরেও নৃশংসতার শিকার ১৮ শিশুর যে কয়জন বেঁচে আছে, তাদের অবস্থাও খাপড়া ওয়ার্ডের আহতদের মতো। শুধু সেটা বলা আর লেখার লোক নেই।

যশোর জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক অমিয় দাসকে ম্যানেজ করতে পারলে আমরা কোনো দিনও আসল ঘটনা জানতে পারতাম না। পুলিশের প্রথম বয়ানও ছিল অন্য রকম। তারা কেন্দ্রের কর্তৃপক্ষের বলা কথিত পাভেল গ্রুপ ও রবিউল গ্রুপ গল্পের ফাঁদে পা দিয়ে বলে, ‘বৃহস্পতিবার বেলা দুইটার দিকে উভয় গ্রুপের আধিপত্যকে কেন্দ্র করে মারামারির ঘটনা ঘটে। ফলে পাভেল গ্রুপের পারভেজ হাসান রাব্বি, রাসেল ওরফে সুজন এবং রবিউল গ্রুপের নাঈম হোসেন গুরুতর জখম হন।’ গভীর বিশ্বাস থেকেই অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তৌহিদুল ইসলামও সংবাদমাধ্যমকে জানিয়ে দেন, ‘আধিপত্য বিস্তার নিয়ে তাদের মধ্যে বেশ কয়েক দিন ধরে উত্তেজনা চলছিল। বেলা দুইটায় তারা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে।’

দেশের কয়েকটি দৈনিক আর অনলাইন খবর করে, ‘২ গ্রুপের সংঘর্ষ, প্রাণ গেল ৩ কিশোর অপরাধীর’। সাধারণ পাঠকের এসব খবর পড়ে মনে হতেই পারে, ‘আপদ গিয়েছে’। অপরাধীরা মরেছে, বেশ হয়েছে। এভাবে যে জনমত তৈরি হয়ে যায়, তাকেই পুঁজি করেন উন্নয়ন কেন্দ্রের অভিযুক্ত কর্মকর্তা থেকে রক্ষী-পিয়ন-আরদালিরা। তাঁরা হয়তো ভাবেন, ‘হেফাজতে থাকা’ যে কারও সঙ্গে যেকোনো আচরণ করা যায়।

সংঘর্ষের কাহিনি তৈরি করে ঠিকমতো প্রচার করতে পারলে পাবলিককেও ম্যানেজ করা সহজ হয়। আগ্রহী পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে আছে, যশোর হত্যা প্রসঙ্গে আমাদের সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য। তাঁর মতে, ‘শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রগুলোয় যারা আসে, তারা সবাই অপরাধী। কাজেই এ ধরনের ঘটনা ঘটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।’ বিবিসিকে তিনি জানান, ‘যারা এখানে আসে, তারা বিভিন্ন অপরাধে জড়িত; তাদের দ্বারা অপরাধ হয়ে থাকে। আবার ২৪ বছর বা ২৬ বছরের লোকের বয়স ১৮ লিখে দিয়ে এখানে পাঠিয়ে দেয়। তারা অপরাধ করে। কিন্তু যা হয়েছে, সেটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এগুলো সচরাচর হয় না।’

কাকতালীয়ভাবে খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে তৎকালীন নুরুল আমিন সরকারের প্রেসনোটের ভাষাটাও ছিল এ রকমের। সেই প্রেসনোটেও নিহত–আহত কয়েদিদেরই দায়ী করা হয়েছিল।(খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ড ১৯৫০, মতিউর রহমান, পৃষ্ঠা ৬৭)। যশোরেও কিশোরদের হাত-পা বেঁধে ও মুখের ভেতরে কাপড় গুঁজে লোহার রড, পাইপ ও কাঠ দিয়ে বেদম মারধর করার পর তাদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফেলে রাখে কর্তৃপক্ষ। সেদিন এমনিতেই তাপমাত্রা ছিল বেশি, চিকিৎসা দূরে থাক, সেদিন তাদের কিছুই খেতে দেওয়া হয়নি। নির্যাতন, ক্ষুধা আর চিকিৎসাহীন অবস্থায় এক জায়গায় গাদাগাদি করে রাখায় সন্ধ্যার দিকে পরপর তিন কিশোর মারা যায়। লাশ হাসপাতালে নেওয়ার পর খবর চাউর হয়, গণমাধ্যম জেনে যায়, পুলিশের কাছে খবর যায়। তবে এর মধ্যে কেটে যায় ছয়–সাত ঘণ্টা! অর্থাৎ নির্যাতনের পর বিনা চিকিৎসায় এসব কিশোরকে ফেলে রাখা হয়েছিল।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে থাকা বাহিনী এবার গালগল্পে মাতেনি। খুলনা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি খুব পরিষ্কার করেই বলেছেন, ‘যারা আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, তারাই এ ঘটনার মূল সাক্ষী। মৃত্যুপথযাত্রী কেউই মিথ্যা কথা বলে না। তাদের কথার সত্যতা ও যৌক্তিকতা রয়েছে। আমাদের অনুসন্ধানে তাদের বিষয় গুরুত্ব পাবে।’ যশোরের পুলিশ সুপার জানিয়েছেন, ‘প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে, পৈশাচিক এই হত্যাকাণ্ডে কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়কসহ পাঁচ কর্মকর্তা সরাসরি জড়িত। যে কারণে তাঁদের গ্রেপ্তার ও রিমান্ড আবেদন করা হয়েছে।’ নানা কারণে কোণঠাসা থাকার কারণেই হোক, আর শুভবুদ্ধির উদয় হওয়ার কারণেই হোক, পুলিশের তদন্ত এখন পর্যন্ত ঠিক আছে বলে মনে হচ্ছে। মামলায় আটক পাঁচ কর্মকর্তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হয়েছে। মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো তথাকথিত ‘অনুগত’ আট কিশোরকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশি হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদের আবেদন আদালত মঞ্জুর করেছেন। আশা করা যায়, শিশুদের জিজ্ঞাসাবাদের সব বিধান মেনে সে কাজ করা হবে।

যশোর হত্যার হয়তো একটা কিনারা হবে। বদলি–ছাঁটাই দিয়ে হয়তো শেষ হবে এবারের ঘটনা। কিন্তু খাপড়া মানসিকতা দূর হবে কীভাবে? অব্যবস্থাপনার খোলনলচে না বদলাতে পারলে হেফাজতে হত্যা বন্ধ হবে না। হেফাজতে শিশু হত্যাও চলতে থাকবে; কখনো আত্মহত্যা, কখনো মারামারির লেবাসে।

গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক

nayeem5508@gmail.com