'আমাদেরও দম আটকে আসছে', শুনতে কি পাও?
সময়ের সর্বজনীন আর্তনাদ সাহিত্যিকেরা কমই সৃষ্টি করেন, তা রচিত হয় যন্ত্রণাদীর্ণ মানবহৃদয়ে। মার্কিন নাগরিক জর্জ ফ্লয়েডের অন্তিম আর্তিটা সে রকম। মহামারি আর মহাবঞ্চনায় পড়া সব দুর্গত মানুষের জানের আওয়াজটাই তাঁর মুখ দিয়ে বের হয়েছে, ‘আমার দম আটকে আসছে’। সঙ্গে সঙ্গে কোটি মানুষের মনঃকষ্টের তারটা বেজে উঠেছে। ডুবন্ত জাহাজের নাবিক যেমন উদ্ধারকারী জাহাজের আশায় ‘এসওএস’ বার্তা পাঠায়, এটা ডুবন্ত মানবতার তেমনই এক জীবনরক্ষী বার্তা। আমাদের সময়ের শিরোনাম এই একটি কথা।
বৈষম্য থাকলেই বিপ্লব হয় না, কিন্তু হঠাৎ ক্রয়ক্ষমতা হারিয়ে ফেলা মানুষ জ্বালাও–পোড়াওয়ে নেমে পড়তে পারে। বৈষম্যের সমাজটা হলো মাইনফিল্ডের মতো। মানবজমিনের তলায় এখানে–সেখানে ছড়িয়ে থাকে অসন্তোষের ‘বোমা’। কখন কোনটার ওপর কার পা পড়বে আর তখন কী ধরনের বিস্ফোরণ ঘটবে, তার পূর্বাভাস জানা কোনো রাষ্ট্রের পক্ষেই সম্ভব নয়। আবার কখন কোন আর্তনাদ বোবা হয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর মুখে প্রতিবাদের ভাষা ফোটাবে, তা–ও আগাম বলা যায় না। শিল্পায়নের প্রথম যুগে শ্রমিকেরা সইতে না পারলে কারখানা ভাঙচুর করত, বণিক সভ্যতার বঞ্চিত মানুষ দোকানপাটে হামলা চালায়।
যুক্তরাষ্ট্রের এক শ্বেতাঙ্গ পুলিশ জর্জ ফ্লয়েড নামের দরিদ্র কৃষ্ণাঙ্গ মানুষটির গলায় পা দিয়ে যখন মেরে ফেলছিল, তখন লোকটি শুধু বলতে পেরেছিল, ‘আই কান্ট ব্রিদ’—আমার দম আটকে আসছে, আমি শ্বাস নিতে পারছি না। ফ্লয়েডের জীবনের বাতাস কেড়ে নিয়েছিল পুলিশ। যারা যুক্তরাষ্ট্রের শহরগুলোতে প্রতিবাদ করছে, হোয়াইট হাউস যারা ঘিরে ধরেছিল, কারফিউ ভেঙে যারা লাখো কণ্ঠে বলছে, ‘আমাদেরও দম আটকে আসছে’; তারা কারা? তারা কেবল ফ্লয়েডের মতো বৈষম্যের শিকার কালো বা বাদামি মানুষ নন—ভীষণ বৈষম্যপূর্ণ আমেরিকান অর্থনীতির সৌধ যাদের মাথার ওপর রানা প্লাজার মতো ভেঙে পড়েছে, তারাও নেমেছে রাজপথে। যে এক লাখের বেশি মার্কিন নাগরিক করোনার ছোবলে জীবন হারিয়েছেন, যাঁদের মধ্যে কালো ও গরিব মানুষেরাই বেশি—এঁরা তাঁদেরও স্বজন, তাঁদের মতোই বিপন্ন।
করোনা ওয়ার্ডে শেষনিশ্বাসের আগে মানুষ যা বলে, ‘দম আটকে আসছে’। শ্বাসের জন্য প্রাণপণ মানুষ আরেকটা মানুষকে এ কথাই শুধু জানাতে চায়, ‘আমার দম আটকে আসছে’। গলায় পা দিয়ে যে হত্যা করছে, মরে যেতে যেতে তাকেও মানুষ বলে, ‘আমার দম আটকে আসছে, ছেড়ে দাও’। তেমন করেই আমেরিকার জনগণ শহরে শহরে আগুন জ্বেলে এক লাখ আমেরিকানের মৃত্যু আর অসহ্য কষ্টের জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে দায়ী করে বলছে, ‘We can't breathe’।
করোনায় মৃত লাখো মানুষের অন্তিম যন্ত্রণার ভাষাহীন কষ্টটা ধরা আছে এই আর্তচিৎকারে। সে চিৎকার চাপা ছিল করোনা ওয়ার্ডের দেয়ালের মধ্যে, তথ্য গুমের গুমোট পরিবেশে সে কথা শোনা যেত না। সেই কথাটাই এখন বিশ্বজুড়ে আওয়াজ তুলেছে, ‘We can’t breathe’—আমাদের দম আটকে আসছে।
জর্জ ফ্লয়েড আমেরিকান মার্কিন বিক্ষোভের প্রতীক হিসেবে আরব বসন্তের স্ফুলিঙ্গ জ্বালানো তিউনিসীয় ফেরিওয়ালা মোহামেদ বুয়াজিজির মতো হয়ে গেছেন। পুলিশ হাঁটু দিয়ে যাঁকে গলা চেপে ধরে মেরে ফেলছে, তিনি যেন মৃত্যু ও ক্ষুধাতাড়িত বিশ্বজনতা, আর শ্বেতাঙ্গ পুলিশটা যেন করোনাভাইরাস আর শাসকশ্রেণির নিষ্ঠুরতার প্রতীক। মানবতা ফ্লয়েডের মুখ দিয়ে জানিয়েছে অন্তিম এসওএস বার্তা, ‘দম আটকে আসছে’।
বিক্ষোভের জ্বালাও–পোড়াওকে ফৌজদারি দণ্ডবিধির আলোকে দেখলে এই এসওএস বার্তার মর্ম ধরা পড়বে না। গণ–অসন্তোষের কার্যকারণ ও প্রতিকার করার কাজটা পুলিশি দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে করা যায় না; তাতে হিতে বিপরীত হয়।
আমেরিকা জ্বলছে চূড়ান্ত কনজিউমারিজম, নির্দয় বাজার অর্থনীতি আর ট্রাম্প প্রশাসনের পাষাণ রাষ্ট্রাচারের বিরুদ্ধে। সিস্টেম যদি বিভ্রাটে পড়ে বা ম্যালফাঙ্কশন করে, তাহলে শান্তির কলও ম্যালফাঙ্কশন করবে। কনজিউমারিজমের উৎসব হলো ‘শপিং স্প্রি’ বা উদ্দাম কেনাকাটা। অথচ দোকানে থরে থরে জিনিস সাজানো কিন্তু কিনতে পারছে না অনেক মানুষ। ওই সব দোকানের সেলসম্যানরা বেতন পাচ্ছেন না। সরকার দরিদ্রদের জন্য যে ১২০০ ডলারের চেক দেবে বলেছে, তা পাওয়ার শর্ত পূরণ করাও কঠিন; আবার অনেকে তা পাচ্ছেও না। এ অবস্থায়, গত ২৩ ফেব্রুয়ারিতে শ্বেতাঙ্গ পুলিশ আহমদ আরবারি নামে এক অশ্বেতাঙ্গকে গুলি করে মেরে ফেলল, এখন মারল জর্জ ফ্লয়েডকে। আগে থেকে তৈরি থাকা সামাজিক মাইনফিল্ড তখন বিস্ফোরিত হলো।
এখন সেসব মানুষের অনেকে দোকানপাট লুট করেছে। টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর প্রেসিডেন্ট বুশ আমেরিকানদের বলেছিলেন, ‘গো শপিং’। স্বাভাবিক জীবনে ফেরার আর কোনো নমুনা তাঁর মাথায় আসেনি হয়তো। কিন্তু সত্য এটাই; কনজিউমারিস্ট সমাজে শপিং মানে সমাজের বিকল্প সামাজিকতা, ‘ব্যাক টু নরমাল’। ট্রাম্পও তা-ই বলেছেন। কিন্তু টাকা না থাকা মানুষেরা ‘নৈরাজ্যিক’ পথে ‘শপিং’ করছে, ‘শপিং স্প্রি’র জায়গায় তারা করছে ‘শপিং ফর ফ্রি’—নিখরচা কেনাকাটা; যাকে আইনের ভাষায় বলা হয় ‘লুট’। কনজিউমারিজমের মুদ্রার এক পিঠে শপিং স্প্রি থাকলে আরেক পিঠে থাকে এই ‘শপিং ফর ফ্রি’।
দোলনা থেকে কফিন পর্যন্ত আমাদের শেখানো হয় ‘কেনাকাটাই আনন্দ, কেনাকাটাই নিরাপত্তা, কেনাকাটাই শক্তি’। কিন্তু মহামারি ও অভাবের সময়ে সেটা কোনো কাজেই এল না। শপিং মল হলো আধুনিক বাজারব্যবস্থার তীর্থ—সেটা যেন আমাদের সব অসুখীপনা সারাবার ওষুধের দোকান। মানুষ সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিতকে না পেয়ে একসময় ঘৃণা করা শুরু করে। লন্ডন ও প্যারিস রায়টের পর মার্কিন রায়টে শপিং মল পোড়ানোর হিড়িক আসলে সুখের দোকানে ঢুকতে না পারা, অযোগ্য ও বাতিল করে দেওয়া সাবেক ক্রেতাদের অসুখী আক্রোশ।
আমেরিকা ছিল কারখানার দেশ, কিন্তু গত তিরিশ বছরে দেশটা হয়েছে রেস্টুরেন্ট, হোটেল আর বিনোদন–সেবার দেশ। উৎপাদন চলে গেছে চীনে, বিনোদন–ব্যবসায় মজেছে বিশ্বাধিপতি। এদিকে করোনার হানায় গত তিরিশ বছরে তৈরি হওয়া নতুন কর্মসংস্থানের জায়গাগুলো ধসে গেছে, বেকারত্ব লাফিয়ে বেড়েছে। কোনো না কোনো অঘটনের ধাক্কায় পরিস্থিতি তাই ফেটে পড়তই।
বিপ্লবও দমন করা যায়, কিন্তু নৈরাজ্যিক গণবিস্ফোরণ নিজের থেকে দম হারানো পর্যন্ত চলতেই থাকে—বাধা দিলে বরং বাড়ে। ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ সেটা অসুখী মানুষের মন—কোনো দমকল তা নেভাতে পারে না। মানুষের ইতিহাসে দেখা যায়, যাদের দ্বারা সমস্যার জন্ম, তাদের হাত দিয়ে তার সমাধান হয় না, অন্য কাউকে আসতে হয়। বিভ্রাটে পড়া রাষ্ট্রের শাসকশ্রেণি যখন সংকটকে আরও গভীর করে খুঁড়ছে, তখন মার্কিন নিম্নবর্গীয় মানুষ সমাধানের জন্য পথে নেমেছে। দিনের পর দিন রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে জনগণকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার তো পাল্টা প্রতিক্রিয়া থাকবেই।
করোনা এসে মানুষকে মানুষ মনে করার, প্রজাতিগতভাবে মানববিরোধী ভাইরাসের দ্বারা তৈরি সংকটকে মোকাবিলার তাগাদা দিলেও কোনো চোরাই ধর্মের বাণী শোনেননি। বরং নিপীড়ন আর অবহেলা আরও বেড়েছে। কালো মানুষেরাই বেশি মারা যাচ্ছে করোনায়, ভেঙে পড়ছে বেকারত্ব আর ক্ষুধায়। আর কোনো দেশের জনগণ এই দুর্দশার সময় মানবতার মশাল হাতে নিতে পারেনি—আমেরিকান জনগণ পেরেছে। পেরেছে যে, তার অন্যতম কারণ সেখানে অন্তত গণতন্ত্র আছে। না হলে পরিস্থিতি আরও সহিংস হতো। কিন্তু এ ঘটনার তাৎপর্য কেবল আমেরিকান রাষ্ট্রের মধ্যে সীমিত নয়। ম্যালফাঙ্কশন করা পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় চাপা পড়া মানুষের জীবন বাঁচানোর এসওএস বার্তা হিসেবেই একে পাঠ করা দরকার।
আমেরিকান স্বপ্ন দুঃস্বপ্ন হয়ে গেলে সেখানে মানুষ জেগে উঠে বলতে পারে, ‘আমার দম আটকে আসছে’। অনেক দেশের মানুষ তা–ও বলতে পারে না।
ফারুক ওয়াসিফ: প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ও লেখক।
faruk.wasif@prothomalo.com