'কুড়িতে বুড়ি নয়, বিশের আগে বিয়ে নয়'
যে প্রতিষ্ঠানটি আমি ৩৬ বছর আগে প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছি এবং আজ অবধি যার সঙ্গে কাজ করছি, সেই সিএমইএসের (সেন্টার ফর ম্যাস এডুকেশন ইন সায়েন্স) একটি বড় কার্যক্রম ‘কিশোরী কর্মসূচি’। দেশে ২০টি জেলার গ্রামাঞ্চলে সিকি শতাব্দী ধরে সমিতিবদ্ধ মোট প্রায় দুই লাখ কিশোরী এর মধ্য দিয়ে নিজেদের মূলমন্ত্র করেছে: ‘কুড়িতে বুড়ি নয়, বিশের আগে বিয়ে নয়’। নারী-পুরুষ সমতা ও নারী ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে উজ্জীবিত এই কিশোরীদের এ সংকল্পের নানা কারণের মধ্যে একটি ছিল: ‘আমাদের এক পণ, বিয়ের আগে উপার্জন’। যেসব জায়গায় আমরা কাজ করেছি, সেখানে সাফল্যের সুস্পষ্ট সূচকগুলো পরিমাপ করে করেই এগিয়েছি। কিশোরী ক্ষমতায়নের সব সাফল্যের একটি পূর্বশর্ত ছিল এবং এখনো আছে, তা হলো বাল্যবিবাহ রোধ৷ সে কারণেই ওই সংকল্পের ওপর এত জোর। আমাদের কিশোরী কর্মসূচির দ্বিমাসিক পত্রিকা কিশোরীতে বাল্যবিবাহ বন্ধের অনেকগুলো প্রামাণ্য উদাহরণ প্রতি সংখ্যায় থাকে। ওই ক্ষমতায়িত কিশোরীরা একটি একটি করে গ্রামকে বাল্যবিবাহমুক্ত গ্রাম হিসেবে ঘোষণা করতে পারছে (এ পর্যন্ত ৮২টি)।
অনেক বাধা, সন্দেহ নেই; তবু সাফল্য ধীরে ধীরে কিন্তু নিশ্চিতভাবে এসেছে, যদিও অনেক পথ আরও পাড়ি দিতে হবে। কিন্তু হঠাৎ ওই আইন সম্পর্কে সরকারের কিছু ইচ্ছা প্রকাশ বিনা মেঘে বজ্রাঘাতের মতো আমাদের হতভম্ব করেছে। মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮ থেকে কমিয়ে ১৬ বছর করে আইন বদলানোর একটি চিন্তাভাবনার কথা জানানো হয়েছে। যে আইনের বলে বলীয়ান হয়ে এবং যে আইন অমান্যের ফাঁকফোকর বন্ধ করে করে এতগুলো বছর ধরে যেভাবে সবাই এগোচ্ছিলাম, এই অপ্রত্যাশিত প্রস্তাবে তার অনেক কিছু ওলট-পালট হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে।
সম্প্রতি লন্ডনে গার্লস সামিট থেকে ফিরে এসে প্রধানমন্ত্রী বাল্যবিবাহকে কমিয়ে আনার লক্ষ্যে মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৬ করার বিষয়ে সরকার চিন্তাভাবনা করবে জানিয়েছেন। পরে কোনো কোনো মন্ত্রী এতে মেয়েদের নিরাপত্তা ঝুঁকির সুরাহা হবে বলে মন্তব্য করেছেন। কিশোরী ও নারী উন্নয়নের পূর্বশর্ত হিসেবে ১৮ বছরের যে লক্ষণরেখাটি কিশোরী, অভিভাবক, সমাজ সবার সামনে রেখে আন্দোলনকে একটি লক্ষ্য দেওয়া সম্ভব হয়েছিল, হঠাৎ তার থেকে পিছু হটে কার কী লাভ হবে, তা আমাদের বোধগম্য হচ্ছে না। বরং বাল্যবিবাহকে আরও বাল্য বয়সের দিকে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এটি কাজ করবে বলে আমাদের আশঙ্কা।
যেটুকু বুঝে নিতে পারলাম, তাতে মনে হয় যে বয়স কমানোর চিন্তার কারণটি হচ্ছে আমাদের বাল্যবিবাহের ঘটনার সংখ্যা যেন কম মনে হয়, সে জন্য ‘বাল্য’ কথাটির সংজ্ঞাটিরই পরিবর্তন করে দেওয়া। কিন্তু সংজ্ঞার এই পরিবর্তনের ফলে এই ন্যূনতম বয়সে যেই কিশোরীর বিয়ে হবে; তাতে শিক্ষা, দক্ষতা, মানসিক উন্নয়ন, অভিজ্ঞতা—সব দিক থেকে তার ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার কী গতি হবে, সেটি কি বিবেচনার মধ্যে আনতে হবে না? এ যেন ক্রিকেটের স্কোরবোর্ডে বাউন্ডারির সংখ্যা কম দেখা যাচ্ছে বলে খেলার মাঠটিকেই ছোট করে দেওয়া।
দুর্ভাগ্য যে এ রকম অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বাস্তবতা আদর্শস্থানীয় নয়। এই বাস্তবতা কিশোরীর প্রতি এত নির্মম বলেই তো, নারী অধিকার ও নারী-পুরুষ সমতার অন্তরায় বলেই তো এত বছর ধরে এত সংগ্রাম আমরা চালিয়ে যাচ্ছি এই বাস্তবতাকে পরিবর্তনের চেষ্টায়। এ জন্যই তো আইনের মাধ্যমে বিয়ের নিম্নতম বয়সকে ১৮ করা হয়েছে এবং সে আইন যাতে ভঙ্গ না হয়, সে জন্য নানাভাবে প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে শত প্রতিকূলতার মধ্যে। এ জন্যই তো সিএমইএসের মতো প্রতিষ্ঠান বছরের পর বছর ধরে কিশোরীদের মধ্যে সচেতনতা এনে তাদের শিক্ষা, কারিগরি প্রশিক্ষণ, ব্যবসায় শিক্ষা, উপার্জন, ব্যক্তিত্ব অর্জন ইত্যাদির মধ্য দিয়ে ক্ষমতায়নের পথে নিয়ে যাচ্ছে; গ্রামে সমর্থক গোষ্ঠী গড়ে তুলে, কাজি-ইমাম-ঘটকদের সচেতন করে, জন্মনিবন্ধনব্যবস্থাকে সক্রিয় করে ১৮ বছরের আইনটিকে অর্থবহ করার চেষ্টা করছে। বাস্তবতা পরিবর্তনের চেষ্টার পরিবর্তে নির্মম বাস্তবতার কাছে আত্মসমর্পণই কি কাম্য?
ব্রিটেনের মেয়েদের ন্যূনতম বিয়ের বয়স ১৬ থাকার বিষয়টির বরাত দিয়ে কথাটি এসেছে। দেখতে হবে, এই ন্যূনতম বয়সটি ব্রিটেনের সমাজে কীভাবে কতখানি প্রাসঙ্গিক। অনেক দিনের পুরোনো এই ১৬ বছর নিম্নতম বয়স করার আইনটি পরিবর্তনের কোনো সামাজিক কারণ ব্রিটেনে অবর্তমান। এই বয়সে বিয়েটি ওখানে খুবই বিরল ঘটনা। আজ ব্রিটিশ সমাজের প্রায় সব অংশে মেয়েদের সচরাচর বিয়ের বয়স এর বেশ কিছু বছর ওপরে। ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে যে কটি বিয়ে এই ন্যূনতম বয়সে হয়, শুধু তাদের জন্য আইনি সম্মতি দেওয়া ছাড়া এই আইনটির আর কোনো প্রাসঙ্গিকতা সেখানে নেই। সেখানে টিনেজ ম্যারেজ নয় বরং টিনেজ প্রেগনেন্সিটিই বড় সামাজিক সমস্যা এবং তা-ও অধিকাংশ সিঙ্গেল মাদার হিসেবেই। ১৬ বছরের বিয়েকে আইনসিদ্ধ করার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক এই আসল সমস্যার নেই। আমাদের দেশের ক্ষেত্রে ন্যূনতম বয়সের আইন বাল্যবিবাহের মতো অত্যন্ত ভয়াবহ ও সর্বব্যাপ্ত সমস্যার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আইনের সামান্য ঢিলেমি সেখানে সমস্যাকে আরও প্রকট করে তুলতে পারে। তাই ব্রিটেনের সঙ্গে এ ক্ষেত্রে তুলনা চলে না।
আমাদের দেশের সঙ্গে অধিকতর তুলনীয় এশিয়া ও আফ্রিকার কিছু দেশের মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়সগুলো অনুসন্ধান করে দেখছিলাম। বাংলাদেশের মতো সম–অধিকার ও উন্নয়নপ্রত্যাশী দেশগুলোর প্রায় সব কটিতে এখানে এই বয়স ১৮ বছর। অবশ্য এ রকম দু-একটি দেশে এটি ১৬-ও আছে, তবে সেগুলোয় যৌতুক, বাল্যবিবাহ, নারী-পুরুষ অসাম্য ইত্যাদি আমাদের মতো প্রকট নয় মোটেই। আর বেশ কিছু দেশে ১৬, ১৫ ইত্যাদি রয়েছে, এমনকি দু-একটিতে বয়ঃসন্ধি অর্থাৎ মাসিক শুরুর সময়কেই মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। বলা বাহুল্য, এসব এমন দেশ, যাদের মৌলবাদী সামাজিক রীতিনীতি ও রাজনৈতিক মতাদর্শ বাংলাদেশের মানুষ অনুসরণ করতে আগ্রহী হবে না।
অল্প বয়সী মেয়েদের নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে অভিভাবকেরা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন থাকেন বলেই সেই ঝুঁকি থেকে সুরক্ষার জন্য বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৬ করা দরকার—এমন কথা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। এই ঝুঁকি কোথা থেকে সৃষ্টি হচ্ছে? যদি ঝুঁকি বলতে মাস্তানি, যৌন আক্রমণ, বলপূর্বক বিয়ে ইত্যাদি গুরুতর অপরাধের ঝুঁকি বোঝানো হয়, তাহলে তা এড়ানোর উপায় কি তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচার ব্যবস্থা করে দেওয়া, নাকি ওই অপরাধকে কঠোর হাতে দমন করা? আর যদি ঝুঁকির মানে নিজের মেয়ের ওপর আস্থা না রাখতে পারা, নানা ‘কুপ্রভাবে’ পড়ে তাদের পালিয়ে গিয়ে বিয়ে ইত্যাদির ঝুঁকি হয়, সে ক্ষেত্রেও কি তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিলেই সমাধান হয়ে যায়? নাকি মেয়েকে শিক্ষা, সচেতনতা এবং একই সঙ্গে স্বাধীনতা দিয়ে সময় হলে তাকেই সিদ্ধান্ত নিতে দেওয়াই এর সমাধান। আসলে মেয়েকে যত দিন বোঝা মনে করা হবে, তত দিন ওই সব ঝুঁকির ও রকম শর্টকাট সমাধানই শুধু খোঁজা হবে। ঝুঁকি সৃষ্টিকারীদেরও তত দিন পোয়াবারো অবস্থা থাকবে।
অন্যদিকে মেয়েকে যখন বাবা, মা, রাষ্ট্র সবাই সম্পদ হিসেবে দেখতে শিখবে এবং ও রকম সম্পদ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য আত্মনিয়োগ করবে, উল্লিখিত ঝুঁকি মোকাবিলা ততই সম্ভব হয়ে উঠবে।
আমাদের সমাজে যুগ যুগ ধরে বালিকাবধূর চাহিদাটি এসেছে মূলত স্বামী-শ্বশুরের পরিবারে বধূকে অসহায় ও অসমভাবে পাওয়ার ইচ্ছা থেকে। এতে তখন ও পরবর্তী সময়ে তাদের সবার ইচ্ছা বধূর ওপর চাপিয়ে দেওয়া সহজ হয়, নির্যাতন করাটাও সহজ হয়। এর মাধ্যমে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ গড়া যায়, উন্নত ও প্রগতিশীল সমাজ গড়া যায় না। কৈশোর-শক্তিকে অসহায় করে ও রকম সমাজ হয় না। কবি সুকান্ত যখন লিখেছিলেন, ‘এ দেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে’, তখন তিনি ওই কৈশোর–শক্তিরই বোধন করেছিলেন। কৈশোর–শক্তি হলো অসম্ভবকে সম্ভব করার শক্তি, প্রতিকূল অবস্থায়ও স্বপ্ন দেখার শক্তি, দৃষ্টিকে অনেক উচ্চে রাখার শক্তি, শুধু স্বামী-সংসার নিয়ে ভাবনার শক্তি নয়। আমাদের সনাতন সমাজ বরং মেয়েদের কৈশোরকে হরণ করার ব্যবস্থাই করে এসেছে—যুগে যুগে, অযৌক্তিক সব বিধিনিষেধ আরোপ আর বাল্যবিবাহের মাধ্যমে, প্রায়ই নির্যাতনের মাধ্যমেও।
আজ তাদের এই কৈশোর ফিরিয়ে দেওয়াটাই আমাদের প্রচেষ্টা হওয়া উচিত, কৈশোর হরণের প্রক্রিয়াকে কোনোভাবেই প্রশ্রয় দেওয়া নয়। বাল্যবিবাহ রোধ করতে হবে তার আসল চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে, ওই চ্যালেঞ্জকে পাশ কাটিয়ে গিয়ে নয়।
ড. মুহাম্মদ ইব্রাহীম: অধ্যাপক, বিজ্ঞান লেখক।
আরও পড়ুন
-
ডলারের মূল্যবৃদ্ধি কী সমস্যা তৈরি করছে, কেন উদ্বিগ্ন সবাই
-
তৃতীয় টি–টোয়েন্টি: চট্টগ্রামেই সিরিজ জিতে নিল বাংলাদেশ
-
জেলেনস্কিকে হত্যার রুশ ষড়যন্ত্রে যুক্ত অভিযোগে ইউক্রেনের দুই কর্নেল গ্রেপ্তার
-
নির্বাচনে যেভাবে একচেটিয়া জয়ের পরিকল্পনা করেছে মোদির বিজেপি
-
নাশতার প্যাকেটের সঙ্গে সাংবাদিকদের টাকা দিল ন্যাশনাল ব্যাংক