Thank you for trying Sticky AMP!!

'কোন্টে যামো জানি না'

রংপুরে গঙ্গাচড়ার তিস্তা নদীর ভাঙন রোধে বালুর বস্তা ফেলা হচ্ছে

১৪ জুলাই কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলার বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের তৈয়ব খান এলাকায় গিয়েছিলাম তিস্তার ভাঙন-পরিস্থিতি দেখতে। দেখলাম একজন বৃদ্ধ নারী লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটছেন, তাঁর সঙ্গে আরও একজন নারী খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছেন। দুজনই বৃদ্ধা। একজন মা। নাম আম্বিয়া। অন্যজন মেয়ে শাহিদা বানু। শাহিদা বানুই ঠিকমতো হাঁটতে পারেন না। তিনি তাঁর মাকে নিয়ে এসেছেন কয়েক দিন আগে বন্যার পানিতে ভেঙে যাওয়া তিস্তাগর্ভে বিলীন বাড়িঘরের ঠিকানা দেখতে। জিজ্ঞাসা করলাম—‘চাচি, বাড়িঘর নেই জেনেও কী দেখতে আসছেন?’ আম্বিয়া বুকভরা কষ্ট নিয়ে উত্তর দেন—‘বাবা, মনটা মানে না, খালি টানে।’ শাহেদা বানু বললেন, ‘মড়কের মন মানে না। জানে পানি ছাড়া কিছুই নাই তেঁও (তবুও) আসপে।’

তৈয়ব খান গ্রামে গিয়ে আরও দেখলাম তৈয়ব খান বাজার, তৈয়ব খান নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়, মসজিদ-মন্দির—সবকিছুই এখন নদীগর্ভে বিলীন। ভেঙে যাওয়া স্কুলের ক্লাস হচ্ছে তৈয়ব খান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এই প্রতিষ্ঠানও যেকোনো সময়ে নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার আশঙ্কায়। আরও অনেকের বাড়ি যেকোনো সময় ভেঙে পড়বে। তাঁরা তাঁদের ঘরের টিন-ইট-আসবাব—সব সরিয়ে নিচ্ছেন। গাছ কেটে নিয়ে যাচ্ছেন। একজন নারীর করুণ কান্নার সুর কানে পড়ল। জানলাম, ব্রজবালার মেয়ের কান্না। ব্রজবালার শিক্ষক স্বামী অনেক আগেই মারা গেছেন। তাঁর মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে কিছুদিন হলো। এক দিন পর ১৫ জুলাই তাঁর মেয়ের বিয়ের লগ্ন। কিন্তু তাঁদের বাড়ি নেই। কী করবেন ব্রজবালা, তা জানেন না।

একটু সামনে রবিউল ব্যাপারীর বাড়ি। চারবার বাড়িভাঙা রবিউল ব্যাপারী নিজের ঘরের খুঁটি সরাচ্ছেন। ‘চাচা, কোথায় যাবেন এখন?’ এ কথা জানতে চাইতেই মাথা ঘুরিয়ে উল্টো দিকে মুখ করে বসে পড়লেন। বুঝলাম লুঙ্গি দিয়ে নিজের চোখের পানি মুছছেন। তারপর মুখ ফিরিয়ে বললেন, ‘কোন্টে যামো জানি না, আল্লাহ জানে।’ অবিবাহিত এক মেয়ে, স্ত্রী এবং তিনটি গরু নিয়ে কোথায় যাবেন, এর কোনো সদুত্তর তাঁর কাছে নেই।

দেখতে সুদর্শন নূর মোহাম্মদ। কিন্তু কে যেন তাঁর চোখে-মুখে কালো ছায়া মেখে দিয়েছে। উদাস দৃষ্টি। আলাপ করে জানলাম, বাজারে তাঁর একটি মুদির দোকান ছিল, অনেক জমি ছিল; ভাঙনে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। এখন কোথায় আছেন জিজ্ঞাসা করতেই বিনয়কৃষ্ণ নামের একজনকে দেখিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এই মামার বাড়িত আছি।’

২২ বার বাড়িভাঙা আবদুস সালাম কয়েকজন নারী-পুরুষ নিয়ে বসে ছিলেন। তাঁদের সবার চোখমুখে বিষাদের রেখা, শোকাচ্ছন্ন সবাই। একজন বলছেন, ‘মনে হয় নদী শান্ত হইবে।’ পাশের এক নারী ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন, ‘চুপ হ। সোগ ভাঙি নিয়ে গেল। আর এলা শান্ত হয়?’

স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, কোনো বছরই নদীর পাড় শক্ত করে নির্মাণ করা হয় না। বর্ষার মৌসুমে ভাঙন ঠেকাতে খুব চেষ্টা হয়। গাবুর হেলান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কাম বন্যা আশ্রয়কেন্দ্রের পাশে স্থানীয় বাসিন্দা মোস্তাফিজার রহমান বলছিলেন, ‘প্রথমে সামান্য একটু জায়গায় ভাঙন দেখা দিছলো। তখনই যদি বন্ধ করা গেল হয়, তা হইলে এত ভাঙন হইল না হয়।’ অনেকেই বলছেন, নদীর পানি ধারণক্ষমতা নেই বলে নদী ভাঙছে। নদীর ভাঙনের মুখে যত বোল্ডার, বালুর বস্তা দেওয়া হচ্ছে—সবটাই ভেঙে যাচ্ছে। গণকমিটি কুড়িগ্রামের সদস্য খন্দকার আরিফের সঙ্গে ওখানেই দেখা। সে মন্তব্য করছিল, ‘একশ্রেণির মানুষের আয়ের উৎস বন্যার সময়ে ঠিকাদারি। এই সময়ে কম কাজ করে বেশি দেখানো যায়।’ স্থানীয় সাংসদ জাতীয় পার্টি থেকে নির্বাচিত তাজুল ইসলাম একবারও এ অবস্থার খবর নেননি। দুর্গত মানুষেরা আশাও করেন না সাংসদ খোঁজ নেবেন। গত বছর যখন প্রায় তিন মাস বন্যা ছিল তখনো কুড়িগ্রামের সাংসদেরা দুর্গত লোকজনের কোনো খবর নেননি। তাঁরা পাঁচ বছরে একবারই আসেন। ভোট মৌসুমে। তবে ইউএনও এসেছিলেন কয়েকবার। একবার কয়েকটি পরিবারের মধ্যে দুই হাজার করে টাকা আর একবার পাঁচ কেজি চাল, এক কেজি ডাল, এক কেজি তেল, এক কেজি চিড়া, ম্যাচ, মোমবাতি দিয়েছেন। এসব প্রয়োজনের তুলনায় যত্সামান্য।

রাজারহাট থেকে গিয়েছিলাম কুড়িগ্রামের মোগলবাসার ধরলা নদীতে চর সিতাইঝাড়। বন্যায় ধরলা এখন পাঁচ-সাত কিলোমিটার প্রশস্ত রূপ ধারণ করেছে। সেখানে অনেক বাড়িঘর পানির নিচে ডুবে আছে। অনেক বাড়ি চারদিকে পানিবন্দী। ৭ নম্বর চর সিতাইঝাড়ে কোনো স্কুল নেই। নুরানি মাদ্রাসা আছে দুটি। পাশে চর কৃষ্ণপুরের স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে ফাতেমা বেগম। বন্যা মৌসুমে প্রায় তিন মাস স্কুলে যেত পারে না। সেখানে আচিয়া নামের এক বালিকাবধূকে পেলাম। নিজে বয়স বলছে ২০ বছর। যদিও তার বয়স ১২-১৩ বছরের বেশি বলে মনে হলো না। লেখাপড়া কেন করেনি আচিয়া? জানতে চাইলে সে বলে, ‘স্কুল আনি দেবেন পড়মো।’

নদী রক্ষা বাঁধ করা হয়েছে কিন্তু কোনো বছর নদী খনন করা হয়নি। বরং বাঁধ দিয়ে শাখানদীগুলোকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। এখন উজান থেকে নিয়ে আসা পলি আর প্রতিবছরের ভাঙনে নদী ভরাট হয়। মজিবুর রহমানের লেখা ভাওয়াইয়া গানে আছে—‘ও তোর বুকভরা নদী বালু চরে/ অল্প জলে বান দুই কিনারে রে।’ সরকার যদি নদীশাসন করতে চায়, তাহলে শুধু নদী রক্ষা বাঁধ করলেই হবে না, নদীও খনন করতে হবে।

কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জসহ উত্তরের বেশ কয়েকটি জেলা এখন বন্যার কবলে। প্রস্থে প্রায় ১০ কিলোমিটার তিস্তা, ৭ কিলোমিটার ধরলা, ৭ কিলোমিটার দুধকুমার, ৫ কিলোমিটার গঙ্গাধর, এক কিলোমিটার সঙ্কোশের উপচে পড়া পানির প্রবাহ গিয়ে পড়ছে ব্রহ্মপুত্রে। প্রায় ১৫ কিলোমিটার প্রশস্ত ব্রহ্মপুত্রের নিজেরই পানি ধারণক্ষমতা নেই। সেখানে আরও এত বিপুল পানি পড়লে তা কত ভয়াবহ হতে পারে, সহজেই অনুমান করা যায়।

এই বন্যা প্রায় প্রতিবছরই হয়। কোনো সময়ে বছরে তিনবারও বন্যা হয়। কিন্তু সরকার বন্যার্ত লোকজনের পাশে কখনোই পর্যাপ্ত সহযোগিতা নিয়ে দাঁড়ায় না। এ বছর হাজার হাজার বাড়িঘর পানির নিচে। হাজার হাজার বাড়ি-জমি ভেঙে নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোর উচিত সামর্থ্য অনুযায়ী সাময়িক এবং স্থায়ী উভয় ধরনের সমাধানে এগিয়ে আসা।

তুহিন ওয়াদুদ: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর

wadudtuhin@gmail.com