Thank you for trying Sticky AMP!!

'নিখোঁজ' ও ভয়ের সংক্রমণ

যাঁরা নিখোঁজ হন ও শেষ পর্যন্ত কোনো খোঁজই মেলে না, তাঁদের পরিবার ও পরিজন সম্ভবত এই দুনিয়ায় সবচেয়ে দুর্ভাগা। নানা করণেই মানুষ নিখোঁজ হয়। দুর্বৃত্ত চক্রের খপ্পরে পড়ে অনেকে নিখোঁজ হয়ে যান। তাঁরা হয় হত্যাকাণ্ড অথবা পাচারের শিকারে পরিণত হন। কেউ কেউ নিজেও গৃহত্যাগী হন, পালিয়ে গিয়ে ‘নিখোঁজ’ ব্যক্তিতে পরিণত হন পরিবারের কাছে। 

কিন্তু আমাদের দেশে গত কয়েক বছর ‘নিখোঁজ’ ও শেষ পর্যন্ত অনেক ক্ষেত্রে একেবারে গুম হয়ে যাওয়ার যে ঘটনাগুলো ঘটে চলেছে, এগুলো সেসব থেকে আলাদা। এ ধরনের ঘটনাগুলোর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিখোঁজ বা গুম হয়ে যাওয়া পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ উঠছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর আর কোনো খোঁজ মিলছে না। এমন গুরুতর অভিযোগের বিহিত ও ব্যাখ্যার দায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপরই এসে পড়ে। এসব অভিযোগ যদি ভিত্তিহীন হয়ে থাকে, তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব হচ্ছে যারা এসব অপকর্ম করছে, তাদের চিহ্নিত করে আইনের মুখোমুখি করা।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র ও অধিকারের সূত্রে জানা যাচ্ছে ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে গত ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৩ বছরে গুম বা নিখোঁজ হয়েছেন ২২০ জন। এঁদের মধ্যে ৩৯ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। ১৮ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে এবং ২০ জন বিভিন্ন সময়ে মুক্তি পেয়েছেন। বাকি ১৪২ জনের কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না।
যে ৩৯ জনের মরদেহ পাওয়া গেছে, তাঁরা যেভাবেই হোক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। এসব হত্যাকাণ্ডে কোনো বিচার নেই। তবে তাঁদের শোকার্ত পরিবারের অন্তত এইটুকু সান্ত্বনা রয়েছে যে তাঁরা তাঁদের স্বজনকে নিজেদের মতো করে ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে দাফন বা সৎকার করতে পেরেছেন। সেখানে গিয়ে তাঁদের জন্য দোয়া-দরুদ বা প্রার্থনা করার সুযোগ টুকু অন্তত পান। বাকি ১৪২ জনের পরিবারের কথা ভাবুন। তাঁরা কী তাঁদের স্বজনদের ফিরে আসার আশা ছেড়ে দিয়েছেন? কোনো কিছু নিশ্চিত না হওয়ার আগে কী কোনো দিন আশা ছেড়ে দেওয়া সম্ভব? যে পরিবারগুলো এই কষ্ট বয়ে বেড়াচ্ছে, তারা কী ভাবে তা সহ্য করে টিকে আছে কে জানে!
পাবনার ফরিদপুর উপজেলার খাগরবাড়িয়া গ্রামের তিন ভাই ১২ দিন ধরে নিখোঁজ। প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী তাঁর কৃষিশ্রমিক। টিক্কা সরদার, এরশাদ সরদার ও সাদ্দাম সরদার। তাঁদের বয়স ৩০, ২৫ ও ২০। পরিবারের অভিযোগ সেই একই ধরনের। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ১১ মে ভোররাতে তাঁদের নিয়ে গেছে। স্থানীয় থানার পুলিশ যথারীতি জানিয়েছে, তারা এ ব্যাপারে কিছুই জানে না।
এই তিন ভাইয়ের বাবা প্রথম আলোকে বলেছেন, দুটি মাইক্রোবাসে করে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং এ সময় আরও ১৫ থেকে ২০ জন লোককে সেখানে দেখা গেছে। এত ঘটা করে তিন ভাইকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকজন কেউ কিছু জানলেন না? অন্তত ঘটনা ঘটার পরও তাঁরা তদন্ত করে কিছু বের করতে পারলেন না তাঁদের কারা নিয়ে গেছে! আমরা কি অনুমান করতে পারি তিন ছেলে নিখোঁজ হওয়ার পর সেই বাবা-মা বা তাঁদের স্ত্রী-সন্তানেরা গত ১২ দিন কীভাবে পার করল! ভয় আর কষ্ট চেপে এই তিন ভাইয়ের পরিবারকে কত দিন অপেক্ষা করতে হবে কে জানে! বা আদৌ এই অপেক্ষার শেষ হবে কি?
পাশের গ্রামের একটি খুনের ঘটনায় এই তিন ভাইয়ের জড়িত থাকার কথা অনেকেই শুনেছেন। কিন্তু সেই খুনের ঘটনায় থানায় যে মামলা হয়েছে তাতে এই তিন ভাইয়ের নাম নেই বলে জানালেন প্রথম আলোর পাবনা প্রতিনিধি। যদি তাঁরা সন্দেহভাজনও হয়ে থাকেন, তবে সে ক্ষেত্রেও তো তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আইনের বিধিবিধান রয়েছে এবং তা মেনে মানতে হবে।
এই অঞ্চলে চরমপন্থীদের প্রভাব রয়েছে। চরমপন্থীদের সঙ্গে গ্রামাঞ্চলে কে কীভাবে যুক্ত হয়ে পড়েন বা যুক্ত হতে বাধ্য হন, সেটাও এক বড় জটিলতা। এমন এক ধোঁয়াশা পরিস্থিতিতে তিন ভাইয়ের ‘নিখোঁজ’ হয়ে যাওয়া সেখানে হয়তো ভয়ের পরিস্থিতিকেই আরও জোরালো করবে। দেশজুড়ে এ ধরনের ভয়ের পরিস্থিতি যত বিস্তৃত হবে, আইনের প্রতি মানুষের আস্থাও ততই কমতে থাকবে। আমাদের দেশের দুর্বল আইনের শাসনও আরও দুর্বল হতে থাকবে। কিন্তু আমাদের সবার ভাবগতিকে মনে হচ্ছে, এমন একটি পরিস্থিতিকেই যেন আমরা মেনে নিচ্ছি। এর বিপদ ও পরিণতির কথা কি আমরা সচেতনভাবেই এড়িয়ে যাচ্ছি? ভয় কি আমাদের সবার মধ্যেই আস্তে আস্তে সংক্রামিত হচ্ছে?