Thank you for trying Sticky AMP!!

'নিজের দুটি চরণ ঢাকো, তবে'

ডেঙ্গুর বিস্তার রোধে জনপ্রতিনিধি ও তারকারা শুকনা রাস্তা ঝাড়ু দিয়ে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করছেন। অথচ ডাক্তারি মতে ডেঙ্গুর মশা পানিতে জন্মায়। ‘জুতা আবিষ্কার’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘কহিল রাজা, “করিতে ধুলা দূর, জগৎ হল ধুলায় ভরপুর!”’ তার চেয়ে হাতে দস্তানা পরে যদি তারা বাড়িঘর দোকানপাটের আশপাশ থেকে পানি জমে থাকা ডাবের খোলা, দইয়ের পাত্র, ভাঙা টব, টিনের কৌটা সরাতেন, তাহলেও কিঞ্চিৎ উপকার হতো।

যে জাতি যত পরিচ্ছন্ন, সে জাতি তত উন্নত। মশারি টানানো খুবই বিরক্তিকর কাজ। উন্নততর দেশে বেড়াতে গিয়ে প্রথম স্বস্তির কাজ মশারি না টানানো। আমাদের দেশে আজকালকার ছেলেমেয়েরা সংসারজীবন শুরুর সময় শর্ত জুড়ে দেয় ‘মশারি তুমি এক দিন টানাবে, আমি এক দিন, এখানে নো কম্প্রোমাইজ।’ সংসার ভাঙার অনেক কারণের মধ্যে মশারির ভূমিকাও নগণ্য নয়। আমেরিকায় পড়তে যাওয়া পুত্রর পড়াশোনা শেষে দেশের ছেলে দেশে ফিরে আসার অভিপ্রায়। পুত্রবধূ বলেন, ‘সেটি হচ্ছে না। গিয়ে রোজ আমাকেই মশারি টানাতে হবে জানি।’ দেশীয় এক পর্যটক বলছিলেন, যেদিন দেখব দেশে আর মশারি বিক্রি হচ্ছে না, সেদিন জানব দেশ উন্নত হচ্ছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ডেঙ্গু নিয়ে সোচ্চার ভুক্তভোগীরা। একজন লিখেছেন, বহুতলবিশিষ্ট ভবনের নিচের দিকের যে ফ্ল্যাটে তিনি বসবাস করেন, তার লাগোয়া খোলা ছাদ। ওপরের ফ্ল্যাটগুলোর শতাধিক জানালা দিয়ে প্রতিমুহূর্তে তাঁর জানালার পাশের ছাদে এসে পড়ছে বাসি ভাত-তরকারি-ডাল, চকলেট-বিস্কুট-চানাচুরের খালি প্যাকেট, ডাবের খোলা, আইসক্রিমের বাটি, বাচ্চা ও নারীদের ব্যবহৃত ডায়াপার-স্যানিটারি প্যাড, মুড়ো ঝাঁটা, নোংরা ন্যাকড়া, ওষুধের খালি ফয়েল, ছেঁড়া জুতা। প্রতিটি ফ্ল্যাটে গিয়ে তিনি জোড় হাতে মিনতি করে এসেছেন এসব বন্ধের। সবাই চোখ কপালে তুলে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তাঁদের বাসার কেউ এ কাজ করে না। কমবেশি প্রতিটি বাসাই পরিচ্ছন্ন। কেবল একজন বললেন, ‘আসলে বারবার গৃহপরিচারিকা পরিবর্তন এর অন্যতম কারণ। অনেক শেখানো-পড়ানোর পরও তাঁরা সচরাচর নিজের মতোই আচরণ করেন।’ হয়তো সামনাসামনি উপদেশমতো কাজ দেখান, কিন্তু আজকাল তো স্বামী-স্ত্রী অনেকেই কর্মজীবী। তাঁরা কাজে বেরিয়ে যাওয়ার পর পরিচারিকারা নিজের মতো চলেন। বাসার ভেতরটা পরিচ্ছন্ন রাখাটাই তাঁদের মূল বিষয়। অপরের বা পরিবেশের ক্ষতির বিষয়ে তাঁদের ‘সিভিক সেন্স’ নেই বললেই চলে। আমাদেরই উচিত সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ এবং নিজেদেরও সচেতন হওয়া। আর এক ফেসবুকার পাশাপাশি দুই ভবনের মধ্যে অবস্থিত ড্রেনের ছবি পাঠিয়েছেন। যে চিত্র ছাদে, সেই একই চিত্রের পুনরাবৃত্তি। বাড়তি শুধু ড্রেনে জমে থাকা পানি। 

পত্রপত্রিকার তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বরে মারা গেছে অন্তত ৯৪ জন। ৬ আগস্ট পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার। কোরবানি ঈদের ছুটিতে দেশব্যাপী আরও ব্যাপক হারে এ রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

এ রোগ প্রতিরোধের একমাত্র উপায় পরিচ্ছন্নতা। এক মাঘে যেমন শীত যায় না, তেমনি বছর ঘুরলে আবারও ডেঙ্গু আরও শক্তিশালী হয়ে ফিরে আসবে না, তার নিশ্চয়তা নেই। শরৎ চন্দ্র, কাফকা, মার্কেজরা ম্যালেরিয়া, প্লেগ, কলেরার মহামারির কথা সাহিত্যে অমর করে গেছেন। দারিদ্র্য, অশিক্ষা, অপরিচ্ছন্নতা, কুসংস্কার ও রোগবালাই একে অন্যের পরিপূরক। রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান, পরিবার ও গণমাধ্যমে পরিচ্ছন্নতার প্রশিক্ষণসহ সচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগ নিতে হবে। শোনা যায় আমরা অচিরেই উন্নততর দেশে পর্যবসিত হতে চলেছি। আশা করি আর কোনো মহামারির চিত্র আমাদের এখনকার সাহিত্যিকদের সাহিত্যে স্থান পাবে না। কেবল নিজ নিজ মুখগহ্বর পরিষ্কার রাখার জন্য যেমন আমরা হাট-বাজার-রাস্তা-ঘাট থুতু-কফে সয়লাব করে রাখি, তেমনি শুধু নিজের বাসাটুকু ঝকঝকে রেখে আশপাশের পরিবেশ বিষাক্ত করলে পরিস্থিতি বুমেরাং হয়ে হানা দেবে। যেমন এখন দিচ্ছে। মশা মারা ওষুধ আর রাস্তাঘাট ঝাঁট দিয়ে সারা দেশ ধুয়া-ধূলি-ধূসর করলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় উল্টো ফলও আসতে পারে। সবচেয়ে ভালো, সবারই নিজ নিজ আবাসসহ আশপাশ পরিষ্কার রাখা। সুতরাং রবীন্দ্রনাথেই ফিরে যাওয়া যাক—

‘নিজের দুটি চরণ ঢাকো, তবে

ধরণী আর ঢাকিতে নাহি হবে।’ 


উম্মে মুসলিমা কবি ও কথাসাহিত্যিক 

muslima.umme@gmail,com