Thank you for trying Sticky AMP!!

'সরকারি দলের কোটা' বাতিল করুন

সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশের বেকারত্বের হার বেশ কম, শিল্পোন্নত দেশগুলো থেকেও কম। সরকারের সর্বশেষ ‘শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৬-১৭’ অনুযায়ী দেশে বেকারত্বের গড় হার ৪ দশমিক ২ শতাংশ। প্রকৃতপক্ষে এর হার অনেক বেশি হবে। কাজ পেতে আগ্রহী কেউ সপ্তাহে এক ঘণ্টা কাজ করলেই যদি কর্মরত বলে ধরে নেওয়া হয় তাহলে বলতে হবে বাংলাদেশ এখন পূর্ণ কর্মসংস্থান স্তরে আছে! কারণ বাংলাদেশে প্রকৃতপক্ষে কর্মসন্ধানী সবাই কিছু না কিছু উপার্জনমুখী বা উপার্জন বিকল্প কাজ করে। সাধারণত কাজের বয়স ১৫ থেকে ৬৫ বছর বয়স ধরা হলেও বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষের কাজ শুরু হয় ৫-৭ বছর বয়স থেকেই, আর তা অব্যাহত থাকে (বেঁচে থাকলে) ৬৫ বছরের পরও। এ দেশে যাঁরা নিজেদের শৈশবকে শৈশব হিসেবে পার করতে পেরেছেন তাঁরা বিশেষ সুবিধাভোগী।

বেকারত্বের সংকীর্ণ সংজ্ঞা দিয়ে কর্মসংস্থান মাপা তাই খুবই বিভ্রান্তিকর। কর্মঘণ্টা, ধরন, আয়, নিশ্চয়তা এগুলোও বিবেচনায় আনতে হবে। প্রবাসে এখন প্রায় এক কোটি বাংলাদেশি কাজ করেন। তারপরও দেশে কাজের পরিমাণগত ও গুণগত অবস্থা ভালো নয়। কৃষি খাতের অনুপাত কমেছে, কর্মসংস্থানেও। কিন্তু শিল্পকারখানা খাতের অনুপাতের তুলনায় অনেক বেশি বেড়েছে পরিষেবা খাত। সেখানে স্থায়ী ও নিরাপদ কাজের সুযোগ খুবই কম। তাই অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজ, স্বকর্মসংস্থানেই বেশির ভাগ মানুষের নির্ভরতা। উপরিউক্ত শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী দেশে কর্মসংস্থানের ৮৫ শতাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক। এসব ক্ষেত্রে কাজের কোনো স্থিরতা নেই, আয় তুলনামূলকভাবে অনেক কম, নিরাপত্তাও কম। স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষা নিয়েও অনেককে এ ধরনের কাজই খুঁজতে হচ্ছে। দোকান, মোবাইল ফোন, ইলেকট্রনিক জিনিসপত্র, মোবাইল ব্যাংকিং, টিউশনি, কোচিং সেন্টার, অনলাইন বিভিন্ন সার্ভিস, কুরিয়ার, পরিবহন, বিক্রয় প্রতিনিধিসহ এজেন্ট হিসেবে কাজ—এগুলোই এখন শিক্ষিত তরুণদের কাজের এলাকা। ব্যাংক, এনজিও, পুলিশ, বিজিবি, সেনাবাহিনী, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে বিশেষ আগ্রহের জায়গা। সবচেয়ে গুরুত্ব পাচ্ছে এখন বিসিএস ক্যাডার সার্ভিস।

সচিব, যুগ্ম সচিবসহ উচ্চ পদগুলোতে সংখ্যার তুলনায় নিয়োগ বেশি হলেও প্রয়োজনীয় নিয়োগে সরকারের অনীহা প্রবল। সর্বজন (পাবলিক) স্কুল-কলেজে বহু হাজার পদ এখনো খালি। সরকারের বাজেট ক্রমেই বেড়ে যায়, অভূতপূর্ব উচ্চ ব্যয়ে বিভিন্ন প্রকল্প নেয় সরকার, কিন্তু প্রয়োজনীয় নিয়োগের ক্ষেত্রে বলে টাকার অভাব। সরকার একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে, কিন্তু শিক্ষক নিয়োগ করতে গেলে বলে অর্থ নেই। বছরের পর বছর কলেজগুলোতে পদ শূন্য, শিক্ষক নেই; বহু প্রতিষ্ঠানে ক্লাস না করেই পরীক্ষা দিতে হয় শিক্ষার্থীদের। বহু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকের অভাবে ঠিকমতো ক্লাস হয় না। অন্যদিকে প্রায় ক্ষেত্রেই মেধা বা যোগ্যতার সঙ্গে কাজ পাওয়ার সম্পর্ক নেই। প্রায় নিয়োগের সময়ই মেধা বা যোগ্যতার চেয়ে কার কী যোগাযোগ, কে কত টাকা দিতে পারবে, সে প্রশ্ন ওঠে। চাকরি এখন কিনতে হয়। শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের কর্মসংস্থানের এসব জটিলতা নিয়ে উদ্বেগ দেখতে হয় নিয়মিত। এ দেশে যোগ্যতা অর্জন করা কঠিন, যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ পাওয়া আরও কঠিন।

বিসিএস ক্যাডারের বিষয়ে স্নাতক-উত্তীর্ণ তরুণদের মধ্যে আগ্রহ বেড়েছে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। বিসিএস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি বিশ্ববিদ্যালয় ও স্নাতক কলেজ শিক্ষার্থীদের এখন প্রধান ব্যস্ততা। স্নাতক উত্তীর্ণ হওয়ার অনেক আগে থেকে এই বিষয়ে পড়াশোনাই তাদের কাছে বেশি গুরুত্ব পায়। কারণ, স্থায়ী নিরাপদ কর্মসংস্থানের আর কোনো ক্ষেত্র নেই। কিন্তু এত ভরসা যার ওপর সেখানে কোটার প্রতিবন্ধকতা দিনে দিনে ক্ষোভ বৃদ্ধি করছে শিক্ষার্থীদের।

খুবই স্পর্শকাতর বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে এই কোটা নিয়ে আলোচনা। কারণ, শতকরা ৫৬ ভাগের মধ্যে শতকরা ৩০ ভাগই মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য (এখন নাতি-নাতনি যোগ হয়েছে)। এ বিষয়ে তাই খোলামেলা আলোচনা হয়নি, কিন্তু ক্ষোভ ক্রমেই ছড়িয়েছে। এবারই তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে বেশি। স্পর্শকাতর হলেও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাপ্য সম্মানের কথা বিবেচনা করেই এ বিষয়ে কথা বলা উচিত। মুক্তিযোদ্ধা পরিবারগুলো থেকেই আলোচনা হওয়া দরকার বেশি। বাবা-মা উভয়েই মুক্তিযোদ্ধা, এ রকম একজন সন্তান তানিম আহমেদ ২০১৩ সালেই এতটা কোটা সংরক্ষণের বিরুদ্ধে লিখেছিলেন। বলেছেন, কোটার সুবিধা দেওয়া হয় অনগ্রসর, সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জন্য। মুক্তিযোদ্ধারা অনগ্রসর নয়। 

লায়লা হাসিন আমার ছাত্রী, এখন বিভাগে সহকর্মী। মুক্তিযোদ্ধার সন্তান তিনি, কোটা সংস্কারের আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বলেছেন, ‘কখনো বাবার মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় নিয়ে কোনো সুবিধা নিতে চাইনি। বাবা আমাকে যোগ্য করে তুলেছেন, নিজের যোগ্যতার বলেই এ পর্যন্ত এসেছি। আমার সন্তানদের আমি কোনো করুণার বস্তুতে পরিণত করতে চাই না। ওরা নিজেদের যোগ্যতাবলেই নিজেরা যত দূর যেতে পারে যাবে।’ একজন মুক্তিযোদ্ধার, একজন শহীদের, নির্যাতিত মানুষদের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পেছনে যে অবদান তাতে তাঁদের কাছে বাংলাদেশের মানুষের ঋণ পরিশোধযোগ্য নয়। কিন্তু এত বছরেও মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ, যুদ্ধাপরাধীদের তালিকা সম্পূর্ণ হয়নি। সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে তালিকার পরিবর্তন ঘটে, একই সরকারের অধীনেও বদলাতে থাকে। এখনো মাঝেমধ্যে পত্রিকায় খবর আসে রাজাকারের নাম মুক্তিযোদ্ধার তালিকায়, ভুয়া সার্টিফিকেট নিয়ে উচ্চ পদে আসীন। ক্ষমতাবানদের স্পর্শ থাকলে যে রাজাকারও মুক্তিযোদ্ধা হয়ে যায়, তার প্রমাণ আমরা বহু পেয়েছি। অন্যদিকে গ্রামে গ্রামে, শহরে বন্দরে এমন অনেক পরিবারের সন্ধান পাওয়া যায়, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের সময় সর্বোচ্চ ত্যাগ করে, সর্বোচ্চ লড়াই করেও পরে নিগৃহীত, বঞ্চিত হয়েছেন। শহরের সুবিধাভোগী পরিবারের কেউ কেউ এই পরিচয় নিয়ে নানাভাবে নিজের অবস্থার পরিবর্তন করতে পারলেও শ্রমিক, খেতমজুরসহ শ্রমজীবী মানুষের জীবনের কোনো পরিবর্তন হয়নি। সরকার যদি সমস্যাজর্জরিত মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সন্তানদের শিক্ষা, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দেশে–বিদেশে কর্মসংস্থানের জন্য যোগ্য করে তুলতে ভূমিকা পালন করত, তাহলে তা দীর্ঘ মেয়াদে টেকসই ও সম্মানজনক হতো।

কোটা পরিচয় নিয়ে বর্তমানে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের সন্তানেরা তাই বড় যন্ত্রণার মধ্যে আছেন। করুণা নয়, সম্মান তাঁদের প্রাপ্য। সরকার যে মুক্তিযোদ্ধা কোটার অনুপাত শতকরা ৩০ ভাগ করেছে, সন্তানের পর এখন নাতি-নাতনি পর্যন্ত কোটা সম্প্রসারিত করেছে, এটা কি মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি ভালোবাসার জন্য, তাদের প্রতি দায়বোধের জন্য? বাস্তব পরিস্থিতি তা বলে না। বিভিন্ন অভিজ্ঞতা থেকে এটা বলা যায় যে সরকার এবং বিভিন্ন পর্যায়ে ক্ষমতাবানদের বেশি বেশি কোটা রাখার আগ্রহ এই কারণে যে এর মাধ্যমে তারা নিজেরা নিজেদের পছন্দমতো লোকজনকে চাকরি দিতে পারে, সুবিধামতো নিয়োগ-বাণিজ্য করতে পারে। সে জন্য ভুয়া সার্টিফিকেটের জোয়ারে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা আর তাঁদের সন্তানেরাও ভেসে যাচ্ছে। অলিখিত প্রবল একটি কোটা এখন অন্য সব কোটা পরিচালনা করছে, সেটা হলো ‘সরকারি দলের কোটা’।

কাজের খোঁজে তরুণদের সংখ্যা বাড়ছে, তাঁরা বাড়তি বা বিশেষ কোনো সুবিধা দাবি করছেন না। কাজ না করে চাঁদাবাজি বা অপরাধ করে জীবিকা অর্জনের পথেও তাঁরা যেতে চান না। তাঁরা মেধা ও যোগ্যতায় নিজেদের তৈরি করতে পারবেন, তার ভিত্তিতে কাজ পাওয়ার অধিকার রাষ্ট্র নিশ্চিত করবে, এটা তাঁদের খুবই ন্যায়সংগত দাবি।

কোটা নিয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত এখনো পরিষ্কার হয়নি, গেজেট হলে হবে। কোটা বাতিল নয়, সংস্কারই তরুণদের দাবি। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অলিখিত ‘সরকারি দলের কোটা’ বাতিল করা বা দুর্নীতি আর নিয়োগ-বাণিজ্যের উৎস দূর করা।

আনু মুহাম্মদ অর্থনীতিবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক

anu@juniv.edu