Thank you for trying Sticky AMP!!

আলোর গল্প, ভালোর গল্প

বাদশাহ বীরবলকে বললেন রাজ্যের সবচেয়ে বড় বোকার তালিকা করতে। বীরবল তালিকা করলেন। এক. একজন মানুষ রাস্তায় জাল ফেলছে। বীরবল বললেন, ‘আপনি জাল দিয়ে কী ধরছেন?’ লোকটা বলল, ‘আমার ঘরটা অন্ধকার। আলো নাই। জাল দিয়ে আলো ধরে ঘরে নিয়ে যাব।’ বীরবল তাঁর নাম বোকার তালিকায় রাখলেন।
আরেকটা গল্প। এক বাবা তাঁর দুই ছেলে, এক মেয়ের প্রত্যেকের হাতে ১০০ টাকা করে দিয়ে বললেন, সন্ধ্যার মধ্যে তোমরা তোমাদের নিজ নিজ ঘরকে এই ১০০ টাকা দিয়ে কেনা জিনিস দিয়ে ভরে ফেলবে।

বড় ছেলে ১০০ টাকায় কিনল তুলা। তারপর ঘরে এনে তুলা ধুনে ঘর ভরে তোলার চেষ্টা করতে লাগল।
মেজ ছেলে কিনল খড়। সে ঘরে ঢুকে খড় ছিটাতে লাগল।
ছোটটা মেয়েটা কী কিনেছে বোঝা যাচ্ছে না। সন্ধ্যার সময় দেখা গেল, সে একটা মোমবাতি বের করেছে। দেশলাইয়ের বাক্স হাতে নিয়েছে। সে মোমবাতি জ্বালাল। সমস্ত ঘর আলোয় ভরে উঠল।
বাবা বললেন, আমার ছোট্ট মেয়েটাই জয়ী হয়েছে।
তরবারি দিয়ে অন্ধকার দূর করা যায় না। ছড়ি ঘুরিয়েও আঁধার তাড়ানো যায় না। অন্ধকারকে গালিগালাজ করেও তাকে তাড়ানো যাবে না।

রংপুরের মিঠাপুকুরের পায়রাবন্দ গ্রাম। জমিদারবাড়ি। সেই বাড়িতে বাংলা পড়া পাপ, ইংরেজি পড়া মহাপাপ। সেখানেই একটা ছোট্ট মেয়ে মন দিয়ে বাংলা পড়তে লাগল। সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে, প্রদীপের চিমনির পাশে একটা কার্ড রেখে দেয় সে, যাতে অন্যদের ঘুমে অসুবিধা না হয়। তার ভাইয়েরা আর তার বোন তাকে পড়াশোনায় উৎসাহ জোগান। সেই মেয়ে বড় হলো। এত ভালো বাংলা শিখল যে লিখল, অবরোধবাসিনী নামের বই, মতিচূর নামের বই। এত ভালো ইংরেজি শিখল যে সে লিখল, সুলতানা’স ড্রিম। সে বলল, ‘ভগিনীরা! চুল রগড়াইয়া জাগিয়া উঠুন, অগ্রসর হউন! মাথা ঠুকিয়া বলো মা! আমরা পশু নই; বলো ভগিনী! আমরা আসবাব নই; বলো কন্যে; আমরা জড়োয়া অলঙ্কাররূপে লোহার সিন্ধুকে আবদ্ধ থাকিবার বস্তু নই; সকলে সমস্বরে বলো আমরা মানুষ।’ তিনি স্কুল খুললেন। ছাত্রী আনার জন্য গেলেন বাসায় বাসায়। সেই যে একটি মেয়ে একটা মোমবাতি নিয়ে এগিয়ে এল, তার থেকে জ্বলল হাজারটা হৃদয়ের মোমবাতি।

এই দেশকে আমাদের কোটি কোটি কিশোরী-তরুণীরাই বিজয়ী করবে। আঁধার থেকে রক্ষা করবে। শুধু ওদের মোমবাতির সুতোয় অগ্নিসংযোগের জন্য দরকার মফিজ স্যার, আকবর স্যার, বীরসেন স্যার, সুইহ্লামং মার্মা, গোলাম রব্বানী, মাহফুজা আক্তার আপা! আরেকটা কথা! দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, দূরদর্শিতা, প্রশিক্ষণ, সাধনা, অবকাঠামো, সংগঠন—সাফল্যের জন্য এসবের কোনো বিকল্প নেই।

আমাদের ৬৮ হাজার গ্রামের কোটি কোটি রোকেয়া সভা করেন না। সেমিনার করেন না। বেইজিং সম্মেলনে যান না। তাঁরা ঠিক কাজটা করেন। তাঁরা নিজেই নিজের প্রদীপ হয়ে ওঠেন। লাখ লাখ নারী কাজ করছেন গার্মেন্টসে। কে তাঁদের রুধতে পারল? তেঁতুলিয়ায় গিয়ে দেখুন, নীল ইউনিফরম-সাদা ওড়না, মেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে সাইকেলে চড়ে। নড়াইলের মেয়েরা যায় লাল জামা, সাদা পায়জামা, লাল ওড়না পরে, সার সার সাইকেলে। বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা কাপ ফুটবল চালু হলো প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মেয়েদের জন্য। জাতীয় টুর্নামেন্ট। কলসিন্দুরে মেয়েদের নিয়ে ফুটবল দল বানালেন মফিজ স্যার। প্রথম দিকে গ্রামের লোকেরা কথা বলত, মেয়েরা ফুটবল খেলব, কেমন কথা? সেই মেয়েরা যখন চ্যাম্পিয়ন হলো, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে ট্রফি নিল, বদলে গেল মানুষের মন। প্রথম আলোর প্রামাণ্যচিত্র রেদোয়ান রনি নির্মিত অদম্য মেয়েরায় (২০১৫) দেখুন সেই দৃশ্য, বিজয়ী মেয়েদের জন্য শসা এনেছেন গ্রামের চাষি, আমাদের এই সানজিদা আক্তার তাঁকে রসিকতা করে বলছেন, এর পরে শসার সাথে লবণ নিয়া আইসেন। সাতক্ষীরার সাবিনা আর মাসুরাকে গড়েছেন সেখানকার কোচ আকবর আলী। গত জুন মাসে মারা গেছেন তিনি। আনাই, আনুচিং, ঋতুপর্ণা, মনিকা, রুপনাদের গড়েছেন মঘাছড়ির প্রাথমিক শিক্ষক বীরসেন চাকমা। তাদের তারকা হয়ে ওঠার পেছনে ছিলেন বাংলাদেশ আনসারের কোচ সুইহ্লামং মার্মা। ঋতুপর্ণার লম্বা চুলের ঢেউ খেলানো পাস দেখে আমরা অবাক। রুপনা চাকমার গোল সেভিং দেখে আমরা মুগ্ধ। রাঙামাটিতে তাঁর ঘরে দেখে মনে হয়, মা গাইতে পারেন: ‘আমার ভাঙা ঘরে ভাঙা চালা, ভাঙা বেড়ার ফাঁকে, অবাক জোছনা ঢুইকা পড়ে হাত বাড়াইয়া ডাকে।’ হাত বাড়িয়ে দেশকে ডেকে বলে, জাগো। আর হাত বাড়িয়ে ফ্রি–কিক সেভ করে দেশকে জেতায়।

Also Read: গ্রামীণ রূপকথার দিনে মনে পড়ে স্বরলিকা পারভীন

এই দেশকে আমাদের কোটি কোটি কিশোরী-তরুণীরাই বিজয়ী করবে। আঁধার থেকে রক্ষা করবে। শুধু ওদের মোমবাতির সুতোয় অগ্নিসংযোগের জন্য দরকার মফিজ স্যার, আকবর স্যার, বীরসেন স্যার, সুইহ্লামং মার্মা, গোলাম রব্বানী, মাহফুজা আক্তার আপা!
আরেকটা কথা! দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, দূরদর্শিতা, প্রশিক্ষণ, সাধনা, অবকাঠামো, সংগঠন—সাফল্যের জন্য এসবের কোনো বিকল্প নেই। বিশ্বকাপ ক্রিকেট জিতেছিল যে শ্রীলঙ্কা দল, অর্জুন রানাতুঙ্গার নেতৃত্বে তারা বহুদিন একসঙ্গে খেলেছে। ব্রাজিলকে ৭-১ গোলে হারিয়েছিল যে জার্মানি, তারা ব্রাজিলে দ্বীপ ভাড়া নিয়ে বহুদিন একসঙ্গে থেকে খেলে প্রস্তুত হয়েছিল। আমাদের মেয়েরা ২০১৬ সাল থেকে ঢাকায় বাফুফে ভবনে থাকে, ভোর পাঁচটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত নানা ধরনের প্রশিক্ষণ নেয়। একটা সময় এই মেয়েদের অনেকেই বাড়িতে খেতে পেত না, আজকে রংপুরের স্বপ্নার টিনের ঘরে ইটের দালান উঠেছে।

২০১৬ সালে রংপুরের প্রথম আলোর প্রতিনিধি আরিফুল হক লিখেছিলেন: ‘রংপুর শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে সদ্যপুষ্করিণী ইউনিয়নের অজপাড়াগাঁ নয়াপুকুর। গ্রামের খেলার মাঠে বিরল একটি দৃশ্য অনেককে অবাক করবে—ফুটবল খেলছে গ্রামের মেয়েরা। শুধু খেলছে না, ফুটবলের কলাকৌশল রপ্ত করছে তারা কঠোর অনুশীলনের মধ্য দিয়ে। এরা সবাই “নয়াপুকুর সাজানো বাগান ফুটবল একাডেমি”র শিক্ষার্থী।’

২০২২ সালে আরিফুল হক লিখলেন:
‘রংপুর সদর উপজেলার সদ্যপুষ্করিণী ইউনিয়নের পালিচড়া জয়রাম গ্রামটি নারী ফুটবলের গ্রাম হিসেবেই পরিচিতি পেয়েছে। স্বপ্না এই গ্রাম থেকেই উঠে এসেছেন। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় ২০১১ সালে স্বপ্নার ফুটবল খেলা শুরু। সেই স্বপ্না এবার নারী সাফ ফুটবলে ১০ নম্বর জার্সি পরে খেলেছেন।
‘আজ সকালে স্বপ্নার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির অবকাঠামোর অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আগে স্বপ্নাদের বাড়ি ছিল টিনের ঘর। একটি লম্বা ঘরে দুই ভাগে ভাগ করে স্বপ্নাসহ তিন বোন, মা-বাবা থাকতেন। গত ১০ বছরের ব্যবধানে ফুটবল খেলে স্বপ্না গ্রামের মুখ উজ্জ্বল করার পাশাপাশি বাড়িঘরের আমূল পরিবর্তন করেছেন।’

অন্ধকার তরবারি দিয়ে, ছড়ি ঘুরিয়ে দূর করা যায় না। আলো জ্বালাতে হয়। রংপুর থেকে এক বালিকা আমাকে লিখেছে, স্যার, আমি ফুটবলার হতে চাই, কী করব?
এ আগুন, এ আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে সবখানে।

  • আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক