Thank you for trying Sticky AMP!!

নতুন পাঠ্যক্রম: অনেক অর্জন হয়েছে, বাকি আরও অনেক

এনসিটিবি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে পাঠ্যক্রমের দীর্ঘ প্রতীক্ষিত ও প্রয়োজনীয় সংশোধন করেছে। যদিও এখনো তা পরীক্ষামূলক অবস্থায়, এর জন্য এনসিটিবি অবশ্যই প্রশংসার যোগ্য। এনসিটিবি প্রয়োজনীয় শিখন নির্দেশিকা ও টিচিং গাইড প্রস্তুত করেছে এবং শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম সংশোধনও শুরু হয়েছে। এসব সংশোধনের সম্পর্কে নেতিবাচক সমালোচনার ঝড় উঠেছে। এটাও প্রত্যাশিত ছিল। আমরা এই প্রবন্ধে একটি গঠনমূলক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে  সামগ্রিক উদ্দেশ্য ও পরিবর্তনগুলো কীভাবে বাস্তবায়িত করা যায়, তার ওপর আলোকপাত করার চেষ্টা করব। আমরা  প্রধানত ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বাংলা ও ইংরেজি পাঠ্যক্রম ও শিখন নির্দেশিকার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করব। অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে কিছু সাধারণ মন্তব্যও থাকবে।

প্রথমত, বাংলা আমাদের সমাজে একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগের ভাষা এবং শিক্ষার মাধ্যম। বাংলার সংশোধিত পাঠ্যক্রম এই কাঠামো মাথায় রেখেই তৈরি করা হয়েছে। শিক্ষকদের বাংলা ভাষা শেখাতে হবে এবং শিক্ষার্থীদের  বাংলা শিখতে হবে, এই দুটি বিষয় পাঠ্যক্রমে এবং শিখন নির্দেশিকায় সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। এটা আমাদের কাছে অত্যন্ত উৎসাহব্যঞ্জক মনে হয়েছে। পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তুও একই ছাঁচে সংগঠিত। ভাষার আটটি দক্ষতা চিহ্নিত করা হয়েছে এবং বিভিন্ন অধ্যায়ের উপকরণগুলো সুসংগতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। অভিজ্ঞতামূলক শিক্ষার চারটি প্রয়োজনীয়তা পূরণের জন্য শিক্ষাগত পদ্ধতি কী হবে, তার ব্যাখ্যাও করা হয়েছে।

শিক্ষার্থীদের মূল নির্দেশাবলিতে বাংলা ব্যবহার করার জন্য এবং শিখন নির্দেশিকায় উদারভাবে বাংলা ব্যবহার করার জন্য ইংরেজি পাঠ্যপুস্তকগুলোর লেখকেরা কৃতিত্বের দাবিদার। তবে বলতে হয়, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির পূর্ববর্তী ইংরেজি পাঠ্যপুস্তকগুলো যোগাযোগমূলক ইংরেজির জন্য বেশ ভালো ছিল। লেখকেরা আমূল ভিন্ন পাঠ্যপুস্তক প্রস্তুত করার চেয়ে পুরোনো পাঠ্যপুস্তকগুলোকে আপগ্রেড করলে ভালো করতেন। লেখকেরা নতুন পাঠ্যপুস্তক তৈরি করেছেন, যেগুলো পঞ্চম শ্রেণি থেকে বেরিয়ে আসা শিক্ষার্থীদের জন্য খুব কঠিন হবে। এতে নতুন পাঠ্যক্রমের উদ্দেশ্য নষ্ট হবে। ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন ইংরেজি পাঠ্যক্রমকে পরিবর্তিত পদ্ধতিতে বাস্তবায়নের জন্য বিবেচনা করা উচিত এবং অবিলম্বে একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা করা উচিত। আমূল পরিবর্তনের সঙ্গে ব্যর্থতার অতীত অভিজ্ঞতা এনসিটিবির জন্য পথ প্রদর্শন করতে পারত।

মানসম্মত শিক্ষা নিয়ে আমাদের কাজে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা এবং জীবনে দক্ষতা—উভয়ের ওপরই জোর দিয়েছি। আমরা বর্তমানে ‘শিক্ষার সামাজিক দায়িত্ব’—এসএসডি (শিক্ষার জন্য সমাজের দায়বদ্ধতা) ধারণাটি প্রয়োগ করে সম্প্রদায় ও স্কুলকে জড়িত করছি। শিশুদের জন্য মানসম্মত শিক্ষা সম্প্রদায়ের সবার স্বার্থ পূরণ করে, এই বিষয়ে এসএসডি একটি ঐকমত্য তৈরি করে। যদিও মানসম্মত শিক্ষার প্রাথমিক দায়িত্ব বিদ্যালয়ের (ছাত্র, শিক্ষক এবং ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যদের)। কিন্তু বিদ্যালয় একা তা সম্পন্ন করতে পারে না

অন্যান্য বিষয়ের জন্য পাঠ্যক্রম পরিকল্পনার যে পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছে, তা সার্বিকভাবে ভালো এবং বিষয়বস্তুগুলো ভালোভাবে ভাবা ও প্রস্তুত করা হয়েছে। এগুলোতেও পরিবর্তন প্রয়োজন হবে; পরিবর্তনগুলো করা যেতে পারে গঠনমূলক সমালোচনা অনুসরণ করে। সব বিষয়ের জন্য একটি ভালো ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছে এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উন্নতি ঘটবে।

শিখন নির্দেশিকার আরও কয়েকটি বিষয়ে আসা যাক। শিক্ষণ নির্দেশিকাগুলো বিশেষজ্ঞদের দ্বারা পরিকল্পিত হয়েছে এবং উচ্চমানের। তবে সব নির্দেশিকাতে খুব বেশি উপাদান দেওয়া হয়েছে, যেন শিক্ষকেরা কীভাবে পড়াতে হয়, সে সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। আমরা মূলত বাংলা ও ইংরেজির শিক্ষণ নির্দেশিকা সম্পর্কে কিছু পরামর্শ দেব। তবে সেগুলো সাধারণভাবে সব বিষয়ের জন্য প্রযোজ্য।

প্রতিটি নির্দেশিকা পাঠ্যপুস্তকের সংগঠনকে খুব উপযুক্তভাবে বর্ণনা করেছে, তার মধ্যে বিভিন্ন দক্ষতার ব্যাখ্যাও রয়েছে। যা–ই হোক, শিক্ষকদের প্রতি নির্দেশগুলো আরও স্পষ্ট ও সংক্ষিপ্ত হতে পারত। নির্দেশিকাতে সহজ ভাষায় বলা যেত, কীভাবে একটি ক্লাস পরিচালনা করতে হয়, কীভাবে একটি সক্রিয় শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করতে হয় এবং কীভাবে প্রত্যেকে যে শেখার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করছে, তা নিশ্চিত করতে হয়। প্রতিটি শিক্ষার্থীকে আলাদাভাবে কীভাবে মূল্যায়ন করা যেতে পারে, তার জন্য একটি সহজ ও অনুসরণযোগ্য সার্বিক কাঠামো দেওয়া যেতে পারে।

পৃথক ক্লাস পরিচালনা করার বিষয়ে কয়েকটি নির্বাচিত পাঠ বেছে নেওয়া উচিত এবং সেই পাঠগুলোতে কীভাবে কার্যকরভাবে ক্লাস নেওয়া যায়, তা প্রদর্শন করাই শ্রেয় হবে নির্দেশিকার পক্ষে। প্রতিটি পাঠ কীভাবে শেখাতে হবে, তা জানাতে গিয়ে শিক্ষকদের ওপর প্রচুর বোঝা চাপানো হয়েছে, এর ফল উল্টো হতে পারে। এটি শিক্ষকদের সৃজনশীলতা এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও দক্ষতা অর্জনের ইচ্ছাকে সীমিত করে দিতে পারে। শিক্ষকদের মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতা আছে। নির্দেশিকার উচিত সেই বাস্তবতার ওপর ভিত্তি করে শিক্ষকেরা যেন পাঠদান-শিখনপ্রক্রিয়াকে ক্রমাগত উন্নত করার উপায় উদ্ভাবন করতে পারেন, সেভাবে উৎসাহিত করা।

শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের জন্য পাঠ্যপুস্তকে দুটি পৃথক বার্তা রচনা করা ভালো হবে। বার্তাগুলো পাঠ্যক্রমের নকশার ধারণা ও উদ্দেশ্যগুলোকে তুলে ধরতে পারে। পাঠদান ও শেখার প্রয়োজনীয়তা এবং শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রত্যাশাগুলো সংক্ষিপ্তভাবে বার্তাগুলোতে বলা উচিত। এই স্বচ্ছতার ফলে শিক্ষার্থী ও শিক্ষক উভয়েই উপকৃত হবে। এ ছাড়া পাঠ্যপুস্তকে পর্যাপ্তসংখ্যক নমুনা প্রশ্ন এবং কিছু নমুনা উত্তর থাকতে হবে, যা শিক্ষার্থীদের দক্ষতা, সৃজনশীলতা ও কল্পনাশক্তি বিকাশে সহায়তা করতে পারে।

নতুন পাঠ্যক্রম সফলভাবে বাস্তবায়নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হবে পাঠ্যক্রমের ওপর শিক্ষকদের স্বত্বাধিকার প্রতিষ্ঠিত ও সুরক্ষিত করা। তা করা যেতে পারে শিক্ষকদের দক্ষতার ওপর আস্থা রাখলে এবং ওপরের প্রস্তাবনা অনুসারে শুধু বাছাইকৃত বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে। ২০১০ থেকে ২০২০ ধরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গ্রামীণ উচ্চবিদ্যালয়ের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। তাতে দেখেছি, শিক্ষকদের মানসম্পন্ন শিক্ষা দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে, যদি তাদের ওপর বিশ্বাস রাখা হয়, শিক্ষার্থীদের সাহায্য করার জন্য তাদের যে সহজাত আকাঙ্ক্ষা থাকে, তাকে জাগ্রত করা হয় এবং তাদের সেভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। আমাদের ক্ষেত্রে, আমরা শিক্ষকদের সঙ্গে অংশগ্রহণমূলক আলোচনার মাধ্যমে একটি শিক্ষাপদ্ধতি স্থির করি এবং বাস্তব জীবনের শ্রেণিকক্ষ সেটিংয়ে সেই শিক্ষাপদ্ধতির উৎকর্ষতা প্রদর্শন করি।

Also Read: সপ্তম শ্রেণির বিজ্ঞান বই: হুবহু চুরি আর গুগলের অনুবাদে শিক্ষার্থীরা কী শিখবে?

মানসম্মত শিক্ষা নিয়ে আমাদের কাজে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা এবং জীবনে দক্ষতা—উভয়ের ওপরই জোর দিয়েছি। আমরা বর্তমানে ‘শিক্ষার সামাজিক দায়িত্ব’—এসএসডি (শিক্ষার জন্য সমাজের দায়বদ্ধতা) ধারণাটি প্রয়োগ করে সম্প্রদায় ও স্কুলকে জড়িত করছি। শিশুদের জন্য মানসম্মত শিক্ষা সম্প্রদায়ের সবার স্বার্থ পূরণ করে, এই বিষয়ে এসএসডি একটি ঐকমত্য তৈরি করে। যদিও মানসম্মত শিক্ষার প্রাথমিক দায়িত্ব বিদ্যালয়ের (ছাত্র, শিক্ষক এবং ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যদের)। কিন্তু বিদ্যালয় একা তা সম্পন্ন করতে পারে না এবং পিতা–মাতা, অভিভাবক, সম্প্রদায়ের সদস্য, সম্প্রদায়ের নেতা ও সম্প্রদায়ের জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে সহায়তা (অর্থ ও উপকরণ) প্রয়োজন আছে। এসএসডি সম্প্রদায়কে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানের জন্য অনুপ্রাণিত করে। এসএসডি সম্প্রদায়ের দ্বারা প্রোগ্রামের স্বত্বাধিকার প্রতিষ্ঠা করে এবং স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষার গুণমানের স্থায়িত্ব অব্যাহত রাখার জন্য সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি প্রত্যাশা ও চাহিদা তৈরি করে।

Also Read: পাঠ্যবইয়ে ভুলের দায় আসলে কার?

আমরা বিশ্বাস করি যে ‘শিক্ষার সামাজিক দায়িত্ব’-এর ওপর একটি জাতীয় সচেতনতামূলক প্রচারাভিযান নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নে অনেক সহায়ক হবে। এই সামাজিক সংযোগ সরকারের উদ্দেশ্যকে বাস্তবে রূপায়ণে সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

  • জসিমুজ্জামান ও মতিলাল পাল গ্রামীণ উচ্চবিদ্যালয়ে ১২ বছর ধরে কাজের ওপর ভিত্তি করে “গ্রামীণ বাংলাদেশের জন্য মানসম্মত শিক্ষা” বইয়ের সহগ্রন্থকার লেখকদ্বয়।