Thank you for trying Sticky AMP!!

বাজেট কি সব সমস্যার সমাধান দিতে পারে

গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে আগামী অর্থবছরের জন্য যে জাতীয় বাজেট পেশ করা হয়েছে, এটিকে অনেকেই চ্যালেঞ্জিং সময়ে গতানুগতিক বাজেট বলে মন্তব্য করছেন। অনেকে মূল্যস্ফীতির চাপ পরিহারে এই বাজেট অকার্যকর হবে বলে আগাম মন্তব্যও করছেন। অনেকে আবার টিন বা কর পরিচিতি নম্বর থাকলেই সরকারি সেবা নিতে ন্যূনতম দুই হাজার টাকা কর প্রদান নিতান্তই অযৌক্তিক মনে করছেন।

অনেকেই বলছেন, প্রস্তাবিত বাজেটের প্রায় সবকিছুই যেন চলমান বা বিদায়ী অর্থবছরের বাজেটের প্রতিলিপিমাত্র। বিশেষত, এক বছর ধরে অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক কিছু সুনির্দিষ্ট কারণে জাতীয় অর্থনীতি যে গভীর ও বিস্তৃত চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করে আসছে, তার কোনো প্রতিফলন প্রস্তাবিত বাজেটে নেই বলেই প্রতীয়মান।

গত দেড় দশকে যে দেশ উচ্চ প্রবৃদ্ধির ধারায় রয়েছে, বিভিন্ন অবকাঠামোর ক্ষেত্রে তার ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু একই সময়ে দেশে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্যও যে বেড়েছে, তা-ও অস্বীকার করা যাবে না

স্বীকার করতে হবে, সম্ভবত বিদ্যমান চ্যালেঞ্জের কারণেই প্রস্তাবিত বাজেটের আকার সংশোধিত বাজেটের তুলনায় জিডিপির মাত্র শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। যেখানে সংশোধিত বাজেট ৬ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি বা জিডিপির ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ, সেখানে প্রস্তাবিত বাজেট প্রায় ৭ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকা বা জিডিপির ১৫ দশমিক ২ শতাংশ।

অন্যদিকে বর্তমান অর্থবছরে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নিয়ে প্রায় সব মহল থেকে সংশয় প্রকাশের পরও প্রস্তাবিত বাজেটে এই লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে ৫ লাখ কোটি টাকা। রাজস্ব আহরণের এই উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা গ্রহণযোগ্য হতো, যদি ইতিপূর্বে প্রদত্ত বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ আমলে নিয়ে রাজস্ব বিভাগকে ঢেলে সাজানো হতো বা প্রয়োজনীয় সংস্কার কার্যক্রমকে জোরালো করা হতো। কিন্তু এ-সংক্রান্ত কিছুই প্রস্তাবিত বাজেটে নেই। গত ১০-১১ বছরের অভিজ্ঞতা বলে, অঙ্কে আগের বছরের তুলনায় কিছুটা বাড়লেও আমরা রাজস্ব আদায়ের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা কখনো অর্জন করতে পারিনি।

Also Read: কার টাকায় কার বাজেট

বিশেষভাবে বলতে হয় মূল্যস্ফীতি সম্পর্কে। সাম্প্রতিক সময়ে তা আক্ষরিক অর্থেই জনজীবন বিপর্যস্ত করে ফেলছে। গত বছর ঘোষিত বাজেটে বলা হয়েছিল, মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৬ শতাংশের মধ্যে রাখা হবে। বাস্তবে তা কয়েক মাস আগে দুই অঙ্কের ঘরে পৌঁছেছিল, যদিও বর্তমানে তা ৯ শতাংশের বেশি। প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের সুনির্দিষ্ট কোনো পদক্ষেপ ব্যতিরেকেই গত বছরের প্রস্তাবটিকে সামান্য বাড়িয়ে বলা হয়েছে, তা ৬ শতাংশের মধ্যে রাখা হবে।

প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নিয়েও প্রায় অভিন্ন প্রবণতা নতুন বাজেটে স্পষ্ট। বিদায়ী অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার সময় ‘উচ্চ প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরে আসার’ যে প্রত্যয় ব্যক্ত করে, তা ৭ দশমিক ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছিল। এবার একই কথা বলে একই প্রবৃদ্ধি ধার্য করা হয়েছে। অথচ এই সময়ে পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। যে কারণে অর্থমন্ত্রী স্বয়ং বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন, এ বছর প্রবৃদ্ধি হবে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ।

বিভিন্ন জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট খাতে বরাদ্দের বিবেচনায়ও প্রস্তাবিত বাজেটে যে উদ্ভাবনীমূলক উদ্যোগ নেই, স্বীকার করতেই হবে। গত দেড় দশকে যে দেশ উচ্চ প্রবৃদ্ধির ধারায় রয়েছে, বিভিন্ন অবকাঠামোর ক্ষেত্রে তার ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু একই সময়ে দেশে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্যও যে বেড়েছে, তা-ও অস্বীকার করা যাবে না।

আমরা জানি শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষায় উপযুক্ত বরাদ্দের মাধ্যমে এই বৈষম্য হ্রাস করা যায়। কারণ, এসব খাতে বরাদ্দ প্রত্যক্ষভাবে সীমিত ও নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর উপকারে আসে। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ আগের মতো বাজেটের ১২ শতাংশের নিচে রয়েছে। স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বিদায়ী অর্থবছরের চেয়ে সামান্য পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে সামাজিক সুরক্ষায় বরাদ্দ বৃদ্ধি পায়নি বললেই চলে। যেমন বয়স্ক ভাতার আওতা বেড়েছে মাত্র ১ লাখ, আর ভাতা বাড়িয়ে ৫০০ টাকার স্থলে করা হয়েছে ৬০০ টাকা; বিধবা ভাতাসহ অন্যান্য ভাতার চিত্রও তথৈবচ।

Also Read: বেকারত্ব ও মূল্যস্ফীতি কমানোর সদিচ্ছা কোথায়

কর্মসংস্থান বৃদ্ধির নিমিত্তে বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষ্যেও বাজেটে লক্ষণীয় কিছু নেই বলে অনেকে মন্তব্য করেছেন। দেশীয় শিল্প সুরক্ষায় অনেক খাতে আগের সুবিধাগুলো বজায় থাকলেও বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় বিশেষ কিছু এতে নেই। অনেকের প্রত্যাশা, আগামী দিনগুলোতে বাজেট বিষয়ে বিভিন্ন মহল থেকে যে সমালোচনা ও পরামর্শ আসবে, সেগুলো বিবেচনায় নিয়ে সরকার বাজেটকে প্রকৃতই জনবান্ধব করে তুলবে।

এবার কথা হলো, প্রচলিত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বা কাঠামোতে আসলেই কি একটি অভিনব বাজেট দেওয়া সম্ভব? যত দূর জানি, আগের বাজেটগুলোর প্রায় সবই উন্নয়ন সহযোগী বা বিশ্বব্যাংকের তত্ত্বাবধানে তৈরি করা হতো আর এখন তৈরি হয় অনেকটা বিদেশে প্রশিক্ষিত, চোখ-কান খোলা অর্থ বিভাগের প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের দ্বারা। শুরুর দিকে তাঁদের অনেকের মধ্যে নতুন কিছু করার কিছুটা উদ্যোগ থাকলেও পরিশেষে রাজনৈতিক বাস্তবতা, স্বজনতোষী পুঁজিবাদ বা গোষ্ঠীস্বার্থ, ক্রমবর্ধিত দুর্নীতি এবং শুধু নিজ নিজ ভাগ্য গড়ার প্রত্যয়ের কাছে তা হারিয়ে যায়।

গত কয়েক বছরে সংসদে বাজেট, বিশেষ করে সম্পূরক বাজেট নিয়ে কার্যকর আলোচনার অনুপস্থিতি, রাজনীতিবিদ, সরকারি আমলা, ব্যবসায়ী নেতৃত্ব এমনকি সংবাদপত্রের মালিক ব্যবসায়ীদের মধ্যে একধরনের আশ্চর্য সমঝোতা গড়ে ওঠায় তা আরও পেছনের সিটের ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে।

দেশ ও জাতির মৌলিক ইস্যুগুলো নিয়েও সরকারি ও বিরোধী দলের ভিন্নমত, এমনকি একশ্রেণির গভীরে যেতে না পারা বা অধিক ব্যবহৃত অদূরদর্শী বুদ্ধিজীবীও এর জন্য দায়ী। শিক্ষার গুণগত মানের একতরফা দরপতন কিংবা শক্তিশালী নজরদারি প্রতিষ্ঠানের অভাবে বাজার অর্থনীতির খারাপ প্রভাবের কথা নাই-বা বললাম।

  • মামুন রশীদ অর্থনীতি বিশ্লেষক