Thank you for trying Sticky AMP!!

ব্যাংক খাতে ‘লাইসেন্স টু লুট’, বাংলাদেশ সংস্করণ

লাইসেন্স টু কিল মানেই জেমস বন্ড। ব্রিটিশ গোয়েন্দা গল্পের নায়ক জেমস বন্ডকে এই লাইসেন্স দেওয়া আছে। চরিত্রটি কাল্পনিক, তবে গোয়েন্দাদের আসলেই এই ক্ষমতা দেওয়া হয় কি না, এ নিয়েও অনেক আলোচনা আছে। কোনো দেশই অবশ্য তা স্বীকার করে না। যদিও দেশে দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড দেখে যে কেউ বলতেই পারেন লাইসেন্স টু কিলের অস্তিত্ব অবশ্যই আছে। যেমন আছে লাইসেন্স টু লুটের অস্তিত্ব।

‘লাইসেন্স টু লুট’ নামে দক্ষিণ আফ্রিকার অনুসন্ধানী সাংবাদিক স্টিফেন হফস্ট্যাটারের লেখা একটা বিখ্যাত বই আছে। দক্ষিণ আফ্রিকার এসকম হচ্ছে এমন একটি রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ কোম্পানি, যার সাফল্য বা ব্যর্থতার ওপর নির্ভর করে দেশটির উন্নতি বা অধোগতি।

সেই এসকমকে কেন্দ্র করে দক্ষিণ আফ্রিকায় দুর্নীতির জাল যেভাবে বিস্তার ঘটেছে, তার বর্ণনাই মূলত লাইসেন্স টু লুট বই। বইটি প্রকাশিত হয়েছে ২০১৮ সালে। যদিও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে লাইসেন্স টু লুট কথাটা ব্যবহার করা হয়েছিল আরও ২০ বছর আগে—১৯৯৮ সালে।

সেই ঘটনা বর্ণনার আগে অবশ্য একটু ভূমিকার প্রয়োজন আছে। বাংলাদেশে প্রথম বেসরকারি ব্যাংকের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৮৩ সালে; জেনারেল এরশাদ তখন ক্ষমতায়। কীভাবে পরিচালিত হবে, কারা মালিক হবেন এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি কেমন হবে—এসব ঠিক না করেই বেসরকারি ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল।

বেসরকারি ব্যাংকের মালিক হতে তখন নিজের পকেট থেকে অর্থ ব্যয়ও করতে হয়নি। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে অনেকেই বেসরকারি খাতের ব্যাংকমালিক হয়েছিলেন। আবার তঁারা নিজেদের ব্যাংক থেকেও নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়ে তা–ও ফেরত দেননি। ১৯৯৮ সালের পরে এসে নিয়ম করা হয় যে অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ব্যাংকের মালিক হওয়া যাবে না এবং নিজের ব্যাংক থেকে নিজের পরিশোধিত মূলধনের ৫০ শতাংশের বেশি ঋণ নেওয়া যাবে না। যদিও পরে দেখা গেছে, এসব নিয়মনীতিও অনেকেই মানেননি।

সেই ১৯৯৮ সালেই দেশের ব্যাংক খাত নিয়ে প্রথমবারের মতো বিস্তারিত একটি রিপোর্ট তৈরি করেছিল বিশ্বব্যাংক। সেই রিপোর্টে বিশ্বব্যাংক লিখেছিল, ‘এখানে বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে অভ্যন্তরীণ লেনদেন (ইনসাইডার লেনডিং) ব্যাপকভাবে হয়, যাকে ব্যাংকের মালিকেরা লুটপাটের লাইসেন্স (লাইসেন্স টু লুট) হিসেবে ব্যবহার করছে।’

এই লাইসেন্স টু লুটের একটা হিসাব পাওয়া যায় ১৯৯৬ সালে ব্যাংক সংস্কারে গঠিত ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ কমিটির প্রতিবেদনে। সেখানে বলা হয়েছিল, ‘অন্তত ১৫২ জন পরিচালক তাঁদের মালিকানাধীন ব্যাংক থেকে যে ঋণ নিয়েছেন, তার পরিমাণ ১ হাজার ৩৪৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ ওই সব পরিচালক যে পরিমাণ ঋণ গ্রহণ করেছেন, তা ওই সব ব্যাংকে তাদের বিনিয়োগ করা অর্থের ২০ গুণ। স্পষ্টতই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্যাংক পরিচালক আমানতকারীদের স্বার্থ উপেক্ষা করে তাদের মালিকানাধীন ব্যাংকসমূহকে নিজস্ব অর্থায়নের উৎস হিসেবে ব্যবহার করেছে। এসব ব্যাংকে সংঘটিত কতিপয় গুরুতর অনিয়মের সঙ্গে ব্যাংকের পরিচালকদের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে পরিচালকেরা ঋণ গ্রহণে জালিয়াতিরও আশ্রয় গ্রহণ করেছেন।’

’৯০ দশকের পরে বাংলাদেশে আসলে ব্যাংক খাত নিয়ে বড় কোনো সংস্কারই হয়নি। এ খাতে খেয়ালখুশিমতো নানা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি দুর্বল করে রাখা হয়েছে। ঋণখেলাপিদের দেওয়া হয়েছে নানা ধরনের সুবিধা। ঘটেছে একের পর এক ঋণ কেলেঙ্কারি। সংস্কারের দাবি উঠলেও অর্থমন্ত্রীরা পাশ কাটিয়ে গেছেন। ফলে ব্যাংক খাত নাজুক অবস্থায় আছে। বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ ও বেনামি ঋণ দেশের ব্যাংক খাতকে সংকটে ফেলে দিয়েছে।

প্রায় ২৫ বছর আগের সেই রিপোর্টে বিশ্বব্যাংক আরও লিখেছিল, ‘বৃহৎ খেলাপিদের কাছ থেকে ব্যাংকগুলোর যে কেবল বিপুল পাওনা আছে তাই নয়, তারপরও তারা অসহায় নিয়ন্ত্রকের প্রতি যেভাবে চরম ঔদ্ধত্য দেখায়, তা বিস্ময়কর।’ আর নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়ে বিশ্বব্যাংকের মন্তব্য ছিল, ‘একটি দুর্বল কেন্দ্রীয় ব্যাংক রাজনীতিবিদ ও আমলাদের জন্য যথেষ্ট সুবিধাজনক।’

কথাগুলো সেই ১৯৯৮ সালের। এর পরে চলে গেছে আরও ২৪ বছর। অর্থনীতির অনেক বদল হয়েছে। ব্যাংক খাত আরও বড় হয়েছে। কিন্তু সে সময় বলা অনেক কথাই অনায়াসে এখনকার বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। সত্যিকার অর্থেই ব্যাংক খাত এখন লুটপাটের ব্যাংকে পরিণত হয়েছে। পুরো খাত প্রভাবশালীদের দখলে চলে গেছে, তাদের কাছেই আছে ‘লাইসেন্স টু লুট’। দুর্বল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চোখের সামনে, কখনো কখনো সহযোগিতায় চলে এই লুটপাট, প্রভাবশালীদের ঔদ্ধত্যও এখন সীমাহীন। ২০১৯ সালেই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশের ব্যাংক খাত নিয়ে এক প্রতিবেদনে বলেছিল, ‘বাংলাদেশে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষের মধ্যে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়ার প্রবণতার শিকড় অত্যন্ত গভীরে। প্রভাবশালী, ওপর মহলে ভালো যোগাযোগ আছে এবং ধনী, এমন কিছু ব্যবসায়ী ঋণ ফেরত দেওয়ার কোনো তাগিদই অনুভব করেন না। এমনকি বাংলাদেশে আর্থিক খাতের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও এখন নিচ্ছেন প্রভাবশালী ও ক্ষমতাবান এই ঋণগ্রাহকেরা।’

বিশ্বব্যাংকই দেশের ব্যাংক খাতসহ সামগ্রিক অর্থনীতি নিয়ে আবারও একটি রিপোর্ট তৈরি করেছে ২০২২ সালের শেষে। এবার তারা সরাসরি ‘লাইসেন্স টু লুট’ কথাটা আর ব্যবহার করেনি ঠিকই, তবে পরিস্থিতির যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, তাতে আত্মপ্রসাদ লাভের কোনো সুযোগ নেই। সংস্থাটি বলেছে, ‘করপোরেট শাসনব্যবস্থার অভাব, দুর্বল নিয়ন্ত্রণ এবং স্বচ্ছতার অভাবে বাংলাদেশের ব্যাংক খাত অপব্যবহারের বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে। অসংখ্য জালিয়াতির ঘটনা এবং উচ্চ খেলাপি ঋণ এর প্রমাণ।’ বিশ্বব্যাংক আরও বলেছে, বাংলাদেশে ব্যাংক খাতে তিনটি বিষয়ে সুস্পষ্ট সংজ্ঞা নেই।

Also Read: ‘জামায়াতমুক্ত’ করার রাজনৈতিক প্রকল্প যে পরিণতি পেল

যেমন ‘নিয়ন্ত্রণকারী স্বার্থ (কন্ট্রোলিং ইন্টারেস্ট), চূড়ান্ত সুবিধাভোগী (আলটিমেট বেনিফিশিয়াল ওনারশিপ) এবং সংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহ (রিলেটেড পার্টিজ)। অর্থাৎ বেসরকারি খাতের ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে কতটা থাকবে, তাঁরা কী করতে পারবেন আর কী পারবেন না, ব্যাংক থেকে ঋণের নামে যে অর্থ নেওয়া হয় তার চূড়ান্ত সুবিধাভোগী কে বা কারা এবং নিজের এবং অন্য ব্যাংক থেকে কারা কত ঋণ নিতে পারবেন তার কোনো সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। এই সুযোগে এখানে লুটপাটের সুযোগ অনেক বেশি। আর এভাবেই সংশ্লিষ্ট পক্ষের নামে ঋণ নেওয়ার প্রবণতাও ব্যাপক।

বিশ্বব্যাংক উদাহরণ দিয়ে বলেছে, ‘এখানে রাজনীতি করা বিশিষ্টজন এবং বড় ব্যবসায়ী গ্রুপের মালিকেরা ব্যাংকের পরিচালক হয়ে বসে আছেন। ব্যাংকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পক্ষের নিজের ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার বিষয়ে কিছু বিধিনিষেধ আছে ঠিকই, তবে তা কেবল কাগজে-কলমে। তাঁরা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পাশ কাটিয়ে এত পরিমাণ ঋণ নিয়েছেন, যা বিপজ্জনক পর্যায়ে চলে গেছে। বেসরকারি ব্যাংকের মোট ঋণের ২০ শতাংশই এভাবে নেওয়া।’

দেশে এখনো নতুন ব্যাংকের অনুমোদন, বেসরকারি ব্যাংকে এক পরিবার থেকে কতজন পরিচালক থাকতে পারবেন, পরিচালকেরা কত বছর টানা পর্ষদে থাকবেন, এক শিল্প গ্রুপ কটি ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় থাকব, ঋণের সুদহার কত হবে—এর কোনোটাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্তের বিষয় নয়। বরং এখানে এসব রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়, যার অনেকগুলোই প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা তৈরি করে দিয়েছেন, যার কথা আইএমএফ আগেই বলেছে।

Also Read: ব্যাংক ও ব্যবসায়ীরা নিজের ভবিষ্যতই চুরি করছেন

’৯০ দশকের পরে বাংলাদেশে আসলে ব্যাংক খাত নিয়ে বড় কোনো সংস্কারই হয়নি। এ খাতে খেয়ালখুশিমতো নানা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি দুর্বল করে রাখা হয়েছে। ঋণখেলাপিদের দেওয়া হয়েছে নানা ধরনের সুবিধা। ঘটেছে একের পর এক ঋণ কেলেঙ্কারি। সংস্কারের দাবি উঠলেও অর্থমন্ত্রীরা পাশ কাটিয়ে গেছেন। ফলে ব্যাংক খাত নাজুক অবস্থায় আছে। বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ ও বেনামি ঋণ দেশের ব্যাংক খাতকে সংকটে ফেলে দিয়েছে।

তবে আইএমএফ থেকে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ চাওয়ার পর থেকে সংস্কার নিয়ে আবার আলোচনা শুরু হয়েছে। আর্থিক খাত সংস্কার আইএমএফের ঋণের অন্যতম শর্ত। সুতরাং প্রশ্ন হচ্ছে চাপে পড়ে এবার কি এই সংস্কার আসলেই হবে? নাকি গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির মতো সহজ শর্তগুলো পূরণ করে বাংলাদেশ ঋণ পাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাবে, আর প্রভাবশালীরা থেকে যাবে বহাল তবিয়তেই।

শেষ কথা হচ্ছে ব্যাংক খাত নিয়ে এখন চারদিকে যত ধরনের কথাবার্তা হচ্ছে, এর সুরাহা না হলে, লাইসেন্স টু লুট নাম দিয়ে এই দেশেও কেউ একজন নতুন একটা বই লিখে ফেলতেই পারবেন।

  • শওকত হোসেন প্রথম আলোর হেড অব অনলাইন

shawkat.massum@prothomalo.com