Thank you for trying Sticky AMP!!

প্রতিপক্ষকে থামিয়ে দেওয়াটাই কি রাজনীতির শেষ কথা

প্রতিদিনই মামলা ও গ্রেপ্তারের সংখ্যা বাড়ছে। পুরোনো মামলায় বিএনপির নেতা–কর্মীদের সাজা হচ্ছে।

১৫ নভেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি অচলাবস্থার আরেকটি স্তরে প্রবেশ করেছে। সরকারি দল আওয়ামী লীগ যেকোনো মূল্যে নির্বাচন করার যে অবস্থান নিয়েছিল, তারা সেই পথেই এগোচ্ছে। অন্যদিকে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো নির্বাচনে না আসার সিদ্ধান্তে অনড়।

অবশ্য আওয়ামী লীগের এই নির্বাচন প্রস্তুতি এ বছরের জুন-জুলাই থেকেই শুরু হয়েছিল। একে একে উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে বড় বড় সমাবেশ তারা করছিল। ১৮ নভেম্বর দলীয় সভানেত্রীর মনোনয়ন ফরম সংগ্রহের মধ্য দিয়ে নির্বাচন অভিমুখে যাত্রার আনুষ্ঠানিকতা শুরু করেছে দলটি।

মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ নিয়ে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের কার্যালয় ঘিরে উৎসব-উচ্ছ্বাসের পরিবেশ দেখা গেছে। ঢাকঢোল-বাঁশি বাজিয়ে, শোভাযাত্রা করে এবং স্লোগান তুলে দলের নেতা-কর্মীরা দলীয় মনোনয়ন ফরম কিনেছেন। এবারে ৩ হাজার ৩৬২টি মনোনয়ন ফরম বিক্রি হয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বীশূন্য নির্বাচনী মাঠে সবাই এমপি হতে চাইলেও দলীয় মনোনয়ন পাওয়াটাই তাঁদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

Also Read: হরতাল-অবরোধের অস্ত্র ভোঁতা হয়ে গেছে

বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ থেকে দেড় কিলোমিটার দূরত্বের নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের চিত্রটা পুরো বিপরীত। কাঁটাতারের বেষ্টনী আর পুলিশের কড়া পাহারায় কার্যালয়টি তালাবদ্ধ। তফসিল ঘোষণার পর বিএনপিসহ বেশির ভাগ বিরোধী দল নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছে।

গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির সমাবেশে সহিংসতার পর চতুর্থ সপ্তাহ চলছে। এ সময়ে সাপ্তাহিক ছুটির দুই দিন ও মঙ্গলবার বাদে বাকি চার দিন অবরোধ-হরতালের মতো কর্মসূচি তারা দিয়েছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিএনপির নেতা–কর্মীরা বিচ্ছিন্নভাবে পিকেটিং ও ঝটিকা মিছিল করেছেন। কিন্তু কর্মসূচি শুরুর আগের সন্ধ্যা থেকে রাতে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে বাস ও পণ্যবাহী যানবাহনে আগুন দেওয়ার ঘটনা নিয়মিত ঘটছে। ২৮ অক্টোবর–পরবর্তী বিএনপির কর্মসূচি যে একটা অচলাবস্থার বৃত্তে ঢুকে পড়েছে, সেটা বলা চলে।

অথচ ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি ঘিরে রাজনীতিতে উত্তেজনা থাকলেও সাম্যবস্থা ছিল, তাতে জনমতের সমর্থনের ভারকেন্দ্রটা বিএনপির দিকেই ঝুঁকে ছিল। গত বছরের আগস্ট থেকে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিএনপি সংগঠনের পুনর্জীবন দেওয়ার যে কৌশল নিয়েছিল, সেটা ধারাবাহিকভাবে উন্নতি হচ্ছিল। গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারি দল এবং পুলিশের বাধা ও প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে তারা বিভাগীয় পর্যায়ে সফল সমাবেশ করেছিল, তার নজির বাংলাদেশের রাজনীতিতে খুব একটা নেই।

চিড়া, মুড়ি, গুড় নিয়ে তৃণমূলের কর্মীরা দূরদূরান্ত থেকে হেঁটে সমাবেশগুলোয় যোগ দিয়েছিলেন। যেকোনো রাজনৈতিক দলের জন্য এ রকম সমর্থন পাওয়াটা সত্যিকার অর্থেই বড় অর্জন। কিন্তু এই অর্জন ধরে রাখতে বিএনপি কি তবে ব্যর্থ হলো? এ প্রশ্নের হ্যাঁ বা না–জাতীয় কোনো উত্তর নিশ্চয়ই নেই।

বাংলাদেশের অর্থনীতি, বাংলাদেশের কূটনীতি যে বড় একটা চাপের মধ্যে পড়তে যাচ্ছে, সেটা ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হচ্ছে। কিন্তু সেই চাপ সামাল দেওয়ার জন্য যে জাতীয় ও রাজনৈতিক ঐকমত্য এবং বিচক্ষণতা প্রয়োজন, তার কোনো নমুনাই দৃশ্যমান নেই, বরং রাজনৈতিক বিভক্তি সমাজকেও তীব্র মেরুকরণের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা কেউই জানি না, সামনে কী?

নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি করে, এমন কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি বেশি দিন চালিয়ে যাওয়া নানা কারণেই কঠিন। এরপর আবার ২৮ অক্টোবর বিএনপির সমাবেশে সহিংসতার ঘটনাকে দলটির কেন্দ্রীয় নেতাদের এবং বেছে বেছে জেলা-উপজেলা পর্যায়ের সংগঠকদের গ্রেপ্তারের সুযোগ হিসেবে নিয়েছে সরকারি দল। প্রতিদিনই মামলা ও গ্রেপ্তারের সংখ্যা বাড়ছে। পুরোনো মামলায় বিএনপির নেতা–কর্মীদের সাজা হচ্ছে।

বহু বছর ধরেই আমাদের রাজনীতিবিদেরা মনে করে আসছেন, রাজপথের লড়াইয়ে যে জিতবে, ভোটেও সেই দলই জিতবে। ক্ষমতায় যারা থাকে, তারা সংবিধান ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবহার করে ভোটে জেতার নানা কায়দাকানুন করে। এই দুই বাস্তবতা একসময় রাজপথে সহিংসতার জন্ম দেয়। রাজনীতির পুরোনো সেই সমীকরণ এখন কার্যকর, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। প্রথমত, বাংলাদেশের অর্থনীতি বড় হয়েছে। আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। ফলে হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি খুব বেশি মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে না।

দ্বিতীয়ত, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো একাকার হয়ে গেছে। ফলে প্রতিযোগিতা আর রাজনৈতিক দলের সঙ্গে রাজনৈতিক দলের মধ্যে হচ্ছে না। শক্তির ভারসাম্যে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে বিরোধীদের পার্থক্যটা দৃষ্টিকটুভাবে বেশি। ফলে রাজনীতির ফয়সালা রাজপথেই—সেই সূত্র কাজে আসছে না। সময়ের প্রবণতা আর জনসাধারণের মনোভাব ধরতে পারা রাজনীতিবিদদের প্রধান মুনশিয়ানা। বিএনপি ও বিরোধী দলগুলো কি সাদা-কালোর বাইরে একটা ধূসর অঞ্চলে দাঁড়িয়ে নিজেদের মূল্যায়ন করবে?

Also Read: রাজনৈতিক সংকট নিরসনে ব্যবসায়ীদের উদ্যোগ কাজে লাগতে পারে

ঢাকঢোল-বাঁশি বাজিয়ে, শোভাযাত্রা করে এবং স্লোগান তুলে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা দলীয় মনোনয়ন ফরম কিনেছেন

২৮ অক্টোবরকে ক্ষমতাসীনেরা নিজেদের বিজয় হিসেবে দেখছে। পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ থেকে আপাতভাবে সেটা কারও কারও কাছে রাজনৈতিক বিজয় বলে মনে হতেও পারে। কিন্তু প্রতিপক্ষকে সাময়িক সময়ের জন্য থামিয়ে দেওয়াটাই রাজনীতির শেষ কথা নয়। ভূরাজনৈতিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ বৈশ্বিক পরাশক্তি ও আঞ্চলিক শক্তিগুলোর যে ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়েছে, সামনের দিনগুলোয় নিঃসন্দেহে বড় চাপের মুখে পড়তে হবে। এই চাপ কেমন হতে পারে, তার কিছুটা আঁচ ওয়াশিংটনভিত্তিক ভূরাজনীতি বিশ্লেষক ও উইলসন সেন্টার’স সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যানের ভাষ্যে।

ডেইলি স্টারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র-চীন, ভারত-চীন ও যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার মধ্যকার বাড়তে থাকা প্রতিযোগিতার মধ্যে খুব তীব্রভাবে পড়ে গেছে। আগামী দিনগুলোয় দেশটির ওপর চাপ বাড়তে থাকবে। ঢাকা যদি ভারসাম্যমূলক ভূমিকা বজায় রাখতে পারে, সেটা হবে অপেক্ষাকৃত ভালো। আমি দেখছি যে ভারত খুব ভালোভাবে ভারসাম্য বজায় রাখার ভূমিকা পালন করতে পারছে।কঠিন সময়েও যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার সঙ্গে বলিষ্ঠ সম্পর্ক তারা বজায় রেখেছে। সুতরাং এই বিবেচনা থেকে বাংলাদেশেরও বড় সুযোগ রয়েছে। কিন্তু সেটা নির্ভর করছে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কী করতে পারছে, তার ওপর। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের দিক থেকে বাংলাদেশের জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জটা গণতন্ত্র। এটা স্পষ্ট যে ঢাকার প্রতিক্রিয়া খুব কূটনৈতিক হয়নি।’

Also Read: তফসিলের রাজনৈতিক হিসাব–নিকাশ

বাংলাদেশের অর্থনীতি, বাংলাদেশের কূটনীতি যে বড় একটা চাপের মধ্যে পড়তে যাচ্ছে, সেটা ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হচ্ছে। কিন্তু সেই চাপ সামাল দেওয়ার জন্য যে জাতীয় ও রাজনৈতিক ঐকমত্য এবং বিচক্ষণতা প্রয়োজন, তার কোনো নমুনাই দৃশ্যমান নেই, বরং রাজনৈতিক বিভক্তি সমাজকেও তীব্র মেরুকরণের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা কেউই জানি না, সামনে কী?

  • মনোজ দে প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী