Thank you for trying Sticky AMP!!

ফেমেনের নগ্ন প্রতিবাদ যে কারণে ইরানের নারী আন্দোলনের জন্য ক্ষতিকর

ইরানের নৈতিকতা পুলিশের হেফাজতে কুর্দি তরুণী মাসা আমিনির মৃত্যু হয়। এ ঘটনার প্রতিবাদে দেশে–বিদেশে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ইস্তাম্বুল, তুরস্ক।

ইরানের নারীদের বিপ্লবকালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নগ্ন প্রতিবাদের বেশ কিছু ছবি ঘুরে বেড়াচ্ছে। যাঁরা সেগুলো শেয়ার করছেন, তাঁদের বেশির ভাগই জানেন না, এসব ছবি ইউরোপের নানা দেশের। এসব নারী ইরানের বাসিন্দা নন। ‘ফেমেন’ নামের একটি বিখ্যাত নারী সংগঠনের আয়োজনে ইউরোপজুড়ে প্রতিবাদগুলো চলছে। সেগুলোয় ইরানের প্রবাসী নারীদের একটি ক্ষুদ্র অংশও হয়তো যোগ দিয়ে থাকতে পারে। অন্যথায় নগ্ন প্রতিবাদকারীদের মোটামুটি শতভাগের কাছাকাছিই পশ্চিমা নাগরিক। তাঁরা ‘ফেমেন’-এর সদস্য।

ফেমেন একটি নারী অধিকারবাদী সংগঠন। জন্ম ২০০৮ সালে ইউক্রেনে। তাদের উদ্দেশ্য নগ্নবক্ষে ও নগ্ন শরীরে প্রতিবাদ জানানো। ইউক্রেনের ‘সেক্স টুরিজম’ ও যৌনকর্মের জন্য ইউক্রেনীয় বালিকাদের ইউরোপে পাচারের বিরোধিতা দিয়ে তাদের যাত্রা শুরু। দ্রুতই ইউরোপের সব কটি দেশে তাদের শাখা কর্মকাণ্ড চালু হয়। এখন তাদের নগ্ন আন্দোলনের অ্যাজেন্ডায় প্রায় সব রকম দমন-পীড়নবাদী ব্যবস্থার প্রতিবাদই রয়েছে বলে তারা মনে করে। সদস্যরা নিজেদের পরিচয় দেয় ‘সেক্সটিভিস্ট’ হিসেবে। নারীর শরীরকেই পোস্টার হিসেবে ব্যবহার করলে খুব সহজেই বিশ্বদৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়। দ্রুত জনমতও তৈরি করা যায়। তাদের এসব আদর্শিক অবস্থান নিয়ে কথা নেই। কিন্তু ইরানের নারীদের আন্দোলনকে সমর্থন দান ও জোরদার করার বেলায় তাদের নিরাভরণ প্রতিবাদ ‘বুমেরাং ইফেক্ট’ তৈরি করেছে।

২.

২০১৪ সালে গবেষক টমাস ডেভিস বিখ্যাত ‘আরব বসন্তসহ’ অন্যান্য গণ-আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণ জানতে একটি গবেষণা করেন। গবেষণাটির ফলাফল গ্লোবাল চেঞ্জ, পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি জার্নালে প্রকাশিত হয়। তিনি ধরে ধরে দেখালেন বাহরাইন, মিসর, সিরিয়া ও লিবিয়ায় কেন গণ-আন্দোলনগুলো ব্যর্থ হলো এবং ব্যর্থতার পরিণতি কী হলো। ন্যায্য ও ন্যায়সংগত দাবিতে তৈরি হওয়া গণ-আন্দোলনও কেন ব্যর্থ হয়—এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে নেমে অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব ওলোংগোংয়ের অধ্যাপক ব্রায়ান মার্টিন অনেকগুলো কেস স্টাডি করেন। দুজনের গবেষণার সিদ্ধান্ত কাছাকাছি। ২০০৭ সালে মার্টিন তাঁর বইটি লিখলেন। শিরোনাম ‘জাস্টিস ইগনাইটেড: ডায়নামিকস অব ব্যাকফায়ার’। তিনি জানালেন, সফল হতে চলা আন্দোলনও দুটি কারণে মুখ থুবড়ে পড়ে। এক, আন্দোলনে ক্ষতিকর কোনো উপাদানকে যদি প্রতিপক্ষ (শাসকেরা) শক্তিশালী ছুতো বা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। দুই. ক্ষতিকর উপাদানের ছুতোটিকে যদি ব্যাপক জনগণের মধ্যে যদি বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পারে। ভুল বা হঠকারী বিষয়গুলোকে রাজনীতিবিজ্ঞানের অন্যান্য তাত্ত্বিকদের পরিভাষা ধার করে তিনি ‘বুমেরাং ইফেক্ট’, ‘ব্যাকফায়ার ইফেক্ট’, ‘পলিটিক্যাল জিউ-জিৎসু ইফেক্ট’ ইত্যাদি নামে ব্যাখ্যা করেছেন।

ইরানি ডায়াসপোরার অনেক সদস্য যাঁরা ইরানের নারীদের অধিকারের পক্ষে, মোল্লাতন্ত্রবিরোধী এবং গণতন্ত্র চান, তাঁদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও হতাশা দেখা যাচ্ছে। ফেমেনের নগ্ন প্রতিবাদ ইরানে পরিবর্তনের সম্ভাবনাকে সম্ভবত আরও দূরবর্তী করে তুলেছে।

নীতি-পুলিশ তৈরি করে ইরান সরকার নিজের ভঙ্গুরতা বাড়িয়েছিল। শাসক অবদমন যত বেশি বাড়ায়, ভঙ্গুরতাও তত বেশি বাড়ে। মাশা আমিনির হত্যাকাণ্ড রাষ্ট্রীয় অবদমনব্যবস্থার সব সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার স্মারক। সে কারণে এবারের গণজাগরণ সামাল দেওয়া রাইসি সরকারের জন্য কঠিন ছিল। ইরানে নারীরা চুল কাটছেন, চুল দিয়ে পতাকা বানিয়ে ওড়াচ্ছেন, হিজাব পোড়াচ্ছেন। পুরুষেরাও তাঁদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছেন। পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল নতুন প্রজন্ম—ইরানের তরুণ যুবারা। ইরানের নারীদের ভয় কেটে গেছে—এ রকম বাঁধ ভাঙা সাহসী দৃশ্যগুলো বিশ্বময় মানবিক অন্তরে সহানুভূতি-সহমর্মিতা জাগিয়ে তুলছিল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ঘাঁটলে দেখা যায়, প্রবাসী ইরানিরা ব্যাপক সমর্থন জোগাচ্ছেন। আন্দোলনরত ব্যক্তিদের জন্য অর্থকড়ির সংস্থানও করছেন। মানবাধিকার সংগঠন থেকে শুরু করে জাতিসংঘেরও দৃষ্টি আকৃষ্ট হচ্ছে। বিভিন্ন পিটিশনে লাখো মানুষ স্বাক্ষর করছেন। এই অধম লেখকও পিটিশনে স্বাক্ষর করেছিল।

বিশ্বব্যাপী সুচিন্তার মানুষেরাও সমর্থন জোগাতে এগিয়ে আসছিলেন। বিশ্বময় মুসলিম দেশগুলোর নারীরাও একাত্মতা বোধ করতে শুরু করেছিলেন। ইরানি ডায়াসপোরা, অর্থাৎ প্রবাসী ইরানিদের অনেকেই ইউরোপ-আমেরিকায় আন্দোলনের পক্ষে জনমতও গড়ে তুলছিলেন। তাঁরা অন্যান্য এশীয় ও মধ্যপ্রাচ্যের ডায়াসপোরা সদস্যদেরও ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার রাস্তায় সংহতিমূলক প্রতিবাদে নামাতে সক্ষম হচ্ছিলেন।

৩.

রাস্তার প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ আন্দোলন স্বতঃস্ফূর্তভাবে জন্ম নিলেও সাফল্য মেলার অসংখ্য নজির রয়েছে। সাফল্যের জন্য সাধারণভাবে পাঁচটি শর্তের উপস্থিতি দরকার বলে ধরে নেওয়া হয়। এক. আন্দোলনকারীদের অখণ্ড ও অবিভাজিত থাকা, আন্দোলন প্রতিবিপ্লব ও ষড়যন্ত্রমূলক ভাঙন এবং হঠকারিতাপূর্ণ কর্মসূচি মুক্ত রাখা। দুই. ক্যারিশম্যাটিক, দৃঢ়চিত্ত ও জীবন বাজি রাখা নেতৃত্বকে সুরক্ষা দেওয়া। তিন. বুদ্ধিদীপ্ত ও কার্যকর কৌশল। চার. রাষ্ট্রীয় এক বা একাধিক প্রতিষ্ঠানের সরব বা নীরব সমর্থন এবং পাঁচ. আন্দোলনকারীদের সীমাহীন ক্ষোভ ও দৃঢ়চিত্ততা।

পাঁচটি শর্তের ভারসাম্যে ঘাটতি দেখা দিলে আন্দোলন বিফল হয়। ভারসাম্য খুব দ্রুত তৈরিও হচ্ছিল। যাঁরা ঘটনাপঞ্জিতে চোখ রাখছিলেন, তাঁরা স্পষ্ট বুঝতে পারছিলেন যে পাঁচটি শর্তই প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পথে। পুলিশ, মিলিটারিসহ শক্তি প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো অনেকটাই পিছু হটছিল, তাঁদের ভেতরও হয়তো জনতার প্রতি সহমর্মিতা গড়ে উঠছিল। সোজা কথা, ইরানে গণতন্ত্রহীনতা, শাসকমহলের মোল্লাতন্ত্র, দমনতন্ত্র ও পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে এই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন সফল হয়ে ওঠার অনেক সম্ভাবনাই তৈরি হয়েছিল। এখন সে সম্ভাবনা অনেকটাই কমেছে, কারণ ইরানের বাইরের ফেমেন-কাণ্ড একটি পরিবর্তনের সম্ভাবনাকে অনেকটাই নষ্ট করেছে বলে মনে হয়। মাঠের সংঘাত-সংঘর্ষ হয়তো চলবে বা বাড়বে-কমবে, তবে পরিস্থিতি ইরান সরকারের নিয়ন্ত্রণে। এবারের প্রতিরোধ আন্দোলনটিও ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা প্রতিদিনই বাড়ছে। ইরান সরকার প্রতিবাদীদের প্রতিপক্ষ হিসেবে হিজাবের পক্ষেও জনগণকে নামিয়ে দিতে পেরেছে। তারা সংখ্যায় ও তেজে যত বাড়ছে, রাস্তার আন্দোলনকারীদের মনোবল ততই কমছে। এই মুহূর্তে পঞ্চম শর্ত অর্থাৎ ‘আন্দোলনকারীদের সীমাহীন ক্ষোভ ও দৃঢ়চিত্ততা’ ছাড়া অন্য একটিও অবশিষ্ট নেই। স্বাভাবিকভাবেই, ইরান সরকার বিশ্বময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফেমেনের আয়োজনে ছড়িয়ে পড়া ছবিগুলো ব্যবহার করে রক্ষণশীল ও মধ্যমপন্থী ইরানি নাগরিকদের আন্দোলনকারীদের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানোর কৌশল নিয়েছ।

৪.

ইরানি ডায়াসপোরার অনেক সদস্য যাঁরা ইরানের নারীদের অধিকারের পক্ষে, মোল্লাতন্ত্রবিরোধী এবং গণতন্ত্র চান, তাঁদের অনকের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও হতাশা দেখা গেছে। ফেমেনের নগ্ন প্রতিবাদ ইরানে পরিবর্তনের সম্ভাবনাকে সম্ভবত আরও দূরবর্তী করে তুলেছে।

  • হেলাল মহিউদ্দীন অধ্যাপক, রাজনীতিবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান। সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়