Thank you for trying Sticky AMP!!

হিরোশিমায় জি–৭ সম্মেলনে বাইডেন ও জেলেনস্কি

ইউক্রেন যুদ্ধে বাইডেন যে পাঁচ ভুল করে ফেলেছেন

গত বছর ইউক্রেনে রাশিয়া সর্বাত্মক আগ্রাসন শুরুর পর অনেকে বলেছিলেন, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ভুল হিসাব থেকে এ যুদ্ধ শুরু করেছেন। গত বছরের অক্টোবরে আমি পুতিনের আত্মগরিমা ও হামবড়া মনোভাব নিয়ে লিখেছিলাম। সেই লেখায় বলেছিলাম, এই মনোভাবের কারণে রাশিয়ানদের সামরিক সামর্থ্য সম্পর্কে পুতিন অতিমূল্যায়ন করেছেন। একই সঙ্গে ইউক্রেনীয়দের প্রতিরোধ সক্ষমতা নিয়ে অবজ্ঞা এবং ন্যাটোর ঐক্য ও যুক্তরাষ্ট্রের কৌশল নীতি সম্পর্কে ভুল ধারণা পোষণ করেছেন।
 
কিন্তু ইউক্রেনে ধ্বংসাত্মক পরিণতির জন্য রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের  ভুল বিবেচনা একমাত্র দায়ী নয়। এই যুদ্ধ কবে শেষ হবে তার কোনো কিনারা যখন দেখা যাচ্ছে না, তখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও তাঁর পশ্চিমা মিত্রদের এখন ইউক্রেনে তাঁরা যেসব ভুল করেছেন, তার প্রতি মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন।

 এক. শুরু থেকেই ইউক্রেন সংঘাতে বাইডেন একটি উঁচু মানের নৈতিক অবস্থান নেন। ইউক্রেন সংঘাতকে তিনি বৈশ্বিক গণতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রের সংঘাত হিসেবে চিত্রিত করেন। রাশিয়ার আগ্রাসনের বিপরীতে আন্তর্জাতিক আইন ও জাতীয় সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের কথা তিনি বলেন। এখনো বাইডেন বিশ্বের স্বৈরতান্ত্রিক শিবিরের বিরুদ্ধে ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধের আবেদন করে চলেছেন। অথচ আমেরিকানদের অন্যায় যুদ্ধগুলোকে এ ক্ষেত্রে উপেক্ষা করা হচ্ছে।

বাইডেন রাশিয়ানদের জাতীয়তাবাদী ক্ষমতাকে অবজ্ঞা করেছেন। রুশ সাম্রাজ্যবাদের ভিত্তিহীন একটা অজুহাত তুলে দেশটির সীমান্ত পর্যন্ত ন্যাটোর সম্প্রসারণের প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। এ ক্ষেত্রে মস্কোর যে ভয়, সেটাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করেছেন তিনি।

দুই. যুদ্ধ যখন কয়েক মাস পড়েছে, তখন ইউক্রেনের দনবাস অঞ্চলে সংঘাত অবসানে ২০১৪ ও ২০১৫ সালের মিনস্ক চুক্তি বাস্তবায়নের একটি প্রচেষ্টাকে খারিজ করে দেয় বাইডেন প্রশাসন। এর মধ্য দিয়ে পূর্ব ইউক্রেনে দুটি স্বায়ত্তশাসিত রাশিয়ান অঞ্চল সৃষ্টি করার সুযোগ ছিল। ফলে ইউক্রেনে রাশিয়ানদের আগ্রাসনকে বন্ধ করার সুযোগ তৈরি হতো।

মিনস্ক চুক্তিতে ইউক্রেন ও রাশিয়া স্বাক্ষর করলেও দুই পক্ষকে চুক্তিতে পৌঁছাতে ও চুক্তির শর্ত পরিশীলিত করতে ফ্রান্স ও জার্মানি সহযোগিতা করেছে। কিন্তু সেই চুক্তি বাস্তবায়ন যাতে হয়, সে জন্য দেশ দুটি যথেষ্ট প্রচেষ্টা দিতে পারেনি। ইউরোপের এই ধ্বংসাত্মক যুদ্ধে অনেক বেশি হারাতে হলেও এই যুদ্ধের উন্মাদনা থামাতে ইউরোপীয় শক্তিগুলো তেমন কিছুই করেনি।

পরিশেষ, পুতিন যেমন ইউক্রেনকে সমর্থনের ব্যাপারে পশ্চিমা ঐক্যের প্রতি অবজ্ঞা করেছেন, বাইডেনও তেমন বাকি বিশ্ব ইউক্রেন সংঘাতকে যে ভিন্নভাবে দেখছে সেটার প্রতি অবজ্ঞা দেখিয়েছেন। দক্ষিণ বিশ্বের কাছে এটি একটি ইউরোপীয় সমস্যা। বাকি বিশ্ব মস্কোর সঙ্গে বাণিজ্য করে চলেছে, পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞার রাশিয়ার অর্থনীতির চাকা অচল করে দিতে পারেনি।

তিন. বাইডেন প্রশাসন রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর টিকে থাকার ক্ষমতা সম্পর্কেও অবমূল্যায়ন করেছে। আফগানিস্তানে সোভিয়েত বাহিনীকে সহযোগিতা দিয়ে পরাজিত করতে পেরেছিল যুক্তরাষ্ট্র। সেই ধারণা থেকেই ইউক্রেনে বাজি ধরেছিলেন বাইডেন।
কিন্তু আফগানিস্তানের চেয়ে ইউক্রেন কৌশল নীতির দিক থেকে মস্কোর কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার একই ইতিহাস ও ভৌগোলিক নৈকট্য রয়েছে। পুতিনের প্রেক্ষাপট থেকে বিবেচনা করলে ইউক্রেন রাশিয়ার জাতীয় নিরাপত্তা ও তার সরকারের অস্তিত্বের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আরও স্পষ্ট করে বললে, ইউক্রেন পশ্চিমা জোটের সঙ্গে যাচ্ছে, সেটা দেখার চেয়ে দেশটিকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতেই পছন্দ করবেন পুতিন।

যুদ্ধের প্রথম বছরে কিয়েভ ও খারকিভ থেকে রাশিয়ান সেনাদের পশ্চাদপসরণের ঘটনা ছিল ইউক্রেনীয়দের সংকল্প ও দৃঢ়তার প্রদর্শন। কিন্তু এ বছরে যুদ্ধের জোয়ার ঘুরে যেতে শুরু করে। কয়েক মাসের ভয়াবহ যুদ্ধের পর বাখমুতের পতন থেকে এটা স্পষ্ট যে যুদ্ধে জয় পেতে রাশিয়ানদের সংকল্প ও ত্যাগ স্বীকার করার ক্ষমতা কোনো অংশেই কম নয়। এটাই এই যুদ্ধের ধ্বংসাত্মক অচলাবস্থার মূল কারণ।

ইউক্রেনীয়দের যুদ্ধের সক্ষমতা নিয়েও অতিমূল্যায়ন করেছেন বাইডেন। এটা অবশ্য ইউক্রেনীয়দের সাহস ও দৃঢ়তার প্রশ্ন নয়, ইউক্রেনীয় বারবার করে সেই দৃষ্টান্তও দেখিয়েছে। গত বছর তারা সফল পাল্টা-আক্রমণও চালিয়েছিল।

কিন্তু যুদ্ধটা এখন পর্যন্ত ইউক্রেনের সীমানার মধ্যেই সংঘটিত হচ্ছে। ইউক্রেনীয়দের তুলনায় রাশিয়ানদের যে বিশাল সামরিক সক্ষমতা তাতে দেশটির অর্থনীতি অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

ইউক্রেনের এই বিপর্যয়ও যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের উৎসাহে ভাটা পড়েনি। ১৯ মে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন জি-৭ জোট হিরোশিমা সম্মেলনে, ‘ইউক্রেনের যত দিন প্রয়োজন তত দিন পর্যন্ত অর্থনৈতিক, মানবিক, সামরিক ও কূটনৈতিক সমর্থন দেওয়ার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত’ করে।

যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্ররা যে এখন আরেকটি ‘মিশন ক্রিপ’ বা অপরিকল্পিত লক্ষ্যের চোরাগলিতে ঢুকে পড়লে এ ঘটনা তারই ইঙ্গিত। ইউক্রেনে গোলাবারুদ পাঠানোর মধ্য দিয়ে যে সহযোগিতা শুরু হয়েছিল, এখন সেটা সাঁজোয়া যান, ট্যাংক, প্যাট্রিয়ট ডিফেন্স সিস্টেম ও ড্রোন পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছে।

Also Read: ইউক্রেন যুদ্ধ যেভাবে ইউরোপের চরিত্র পাল্টে দিচ্ছে

চার. অতি সম্প্রতি, আকাশযুদ্ধে রাশিয়ার যে আধিপত্য আছে সেটাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র এফ-১৬ যুদ্ধবিমান দিতে সম্মত হয়েছে। মস্কো সতর্ক করে দিয়েছে যে ইউক্রেনকে যদি এফ-এফ বিমান দেওয়া হয়, তাহলে যুদ্ধ বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছে যাবে। অন্যদিকে বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলেছেন, বাইরের জনবলের সহযোগিতা ছাড়া এই মুহূর্তে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর পক্ষে এই বিমান চালানো কি সম্ভব?

যুদ্ধের এই মুহূর্তের যে বাস্তবতা তাতে পরাজয়ের জোয়াল থেকে কোনোভাবে ইউক্রেন যদি তাদের বহুল প্রত্যাশিত পাল্টা আক্রমণে নাটকীয় জয় পায়, তাহলে রাশিয়া পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করে তার জবাব দিতে পারে। ইউক্রেন ও বাকি ইউরোপের জন্য সেটা হবে ভয়াবহ এক বিপর্যয়।

এমনকি মস্কো যদি অপেক্ষাকৃত ছোট বিস্ফোরণ ক্ষমতার ট্যাকটিক্যাল পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করে সেটাও ইউরোপ ও বাকি বিশ্বের নিরাপত্তা ও শান্তির ওপর চরম মাত্রার হুমকি তৈরি করবে।

বাইডেন প্রশাসনের অনেকের বিবেচনা হলো, রাশিয়া পারমাণবিক অস্ত্রের মাধ্যমে প্রতিশোধের যে ঘোষণা দিয়েছে, সেটা পশ্চিমাদের ঠেকাতে ফাঁকা আওয়াজ ছাড়া কিছু নয়।

আমার আশা হলো, তাদের এই বিবেচনা যেন ঠিক হয়। কিন্তু আমার ভাবনা হলো, তাদের এই বিবেচনা ভুল।

২০০০ হাজার সাল থেকে ক্রেমলিন পারমাণবিক অস্ত্রের ভান্ডার কমিয়ে আনলেও এর কর্তাব্যক্তিরা বলে আসছেন, রাশিয়ার একবারে মৌলিক অস্তিত্ব বিপন্ন হতে পারে এমন ঘটনায় শুধু নয়, ‘কোনো একটি সংকটে সমাধানের আর যদি কোনো পথ না থাকে অথবা প্রচলিত সমরাস্ত্র যদি অকার্যকর হয়ে পড়ে’ তাহলেও তারা পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবে।

Also Read: ইউক্রেন যুদ্ধ যেভাবে বৈশ্বিক অস্ত্রবাজার ওলট–পালট করে দিচ্ছে

পাঁচ. পরিশেষ, পুতিন যেমন ইউক্রেনকে সমর্থনের ব্যাপারে পশ্চিমা ঐক্যের প্রতি অবজ্ঞা করেছেন, বাইডেনও তেমন বাকি বিশ্ব ইউক্রেন সংঘাতকে যে ভিন্নভাবে দেখছে সেটার প্রতি অবজ্ঞা দেখিয়েছেন। দক্ষিণ বিশ্বের কাছে এটি একটি ইউরোপীয় সমস্যা। বাকি বিশ্ব মস্কোর সঙ্গে বাণিজ্য করে চলেছে, পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞার রাশিয়ার অর্থনীতির চাকা অচল করে দিতে পারেনি।

সংক্ষেপে, রাশিয়া ও পশ্চিম কোনো পক্ষই এই যুদ্ধে কূটনীতিকে ব্যবহার করতে ব্যর্থ হয়েছে। যুদ্ধকে তারা এখন ‘বাঁচো অথবা মরো’ এই পর্যায়ে নিয়ে গেছে।

ইতিমধ্যে এই যুদ্ধ রাশিয়া ও পশ্চিমের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতাকে যখন হুমকির মুখে ফেলেছে, তখন চীনের উত্থান ঘটে চলেছে অক্ষতভাবে। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য পছন্দনীয় না হলেও চীন এখন বিশ্বে আগের চেয়ে আরও শক্তিশালী ও বিশ্বাসযোগ্য নেতা হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে।

  • মারওয়ান বিশারা আল-জাজিরার জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক বিশ্লেষক
    আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে