Thank you for trying Sticky AMP!!

অমর গানের পোস্টমর্টেম ও উত্তরণের উপায়

‘কারার ঐ লৌহ-কবাট’ শত বছরের এক অবিনাশী অমর গান। সময়ের প্রয়োজনে লেখা হলেও গানটির লোকপ্রিয়তায় সামান্য ঘাটতি হয়নি। ব্রিটিশিবিরোধী মানসে লেখা গানটি সব ধরনের অন্যায়, অবিচার ও বিচারহীনতার বিরুদ্ধে সোচ্চার, ফলে এখনো সমানভাবে এটি প্রাসঙ্গিক।

একটু পেছনে ফেরা যাক। নিজের সবচেয়ে প্রিয় নেতা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের কারাবরণের পর তাঁরই পত্রিকা ‘বাংলার কথা’র জন্য দেশবন্ধুর সহধর্মিণী বাসন্তী দেবীর অনুরোধে তাৎক্ষণিকভাবে কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন এই গান। বলা প্রয়োজন, গানটি ১৯২১ সালে লেখা হলেও ‘বাংলার কথা’য় প্রকাশিত হয় ১৯২২ সালের ২০ জানুয়ারি।

কবি হুগলি জেলে থাকাকালীন অসংখ্য কারাবন্দী বিপ্লবীদের সঙ্গে বজ্রকণ্ঠে গাইতেন এই গান। যার প্রভাবে তৎকালীন স্বাধীনতাকামী ভারতীয় যুবসমাজ স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে আপামর মানুষকে এভাবে আর কোনো গান উদ্দীপ্ত করতে পারেনি। এরপর যা হওয়ার তা–ই হলো। ভীত-শঙ্কিত ব্রিটিশরাজ এই গানকে বাজেয়াপ্ত করল।

Also Read: এ আর রাহমান ভুল করলেন নাকি ঠিক করলেন?

বাকিটা ইতিহাস। স্বাধীনতা আন্দোলন দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ল। ১৯৪২ সালে কবি তাঁর ব্যস্ততম সময়ে নির্বাক হয়ে গেলেন। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট হলো দেশভাগ। ততদিনে গানটি বাংলাভাষী সব মানুষের হৃদয়ে স্থায়ী আসন তৈরি করে নিয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৪৯ সালের জুন মাসে কলম্বিয়া রেকর্ড কোম্পানি থেকে প্রথম প্রকাশিত হয় গানটি। যার লেবেলে কথা ও সুরের জায়গায় লেখা ছিল কাজী নজরুল ইসলামের নাম। শিল্পী হিসেবে গিরীন চক্রবর্তী ও সংগীত পরিচালকের জায়গায় নিতাই ঘটকের নাম মুদ্রিত ছিল।

এর পরের বছরেই হিজ মাস্টার্স ভয়েস (এইচএমভি) থেকে দ্বিতীয় রেকর্ড প্রকাশিত হয়। যে গানটি ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন’ চলচ্চিত্রে ব্যবহার করা হয়। মজার ব্যাপার হলো, দ্বিতীয় রেকর্ডে সুরকার ও সংগীত পরিচালক হিসেবে কারও নামই মুদ্রিত হয়নি। ফলে ভবিষ্যতে অনেক তথাকথিত গবেষক ও শিল্পী তাঁদের জ্ঞানগর্ভ লেখা ও বক্তৃতায় এই রেকর্ডের বরাত দিয়ে গানটির সুরকার হিসেবে নজরুলের নাম স্বীকার করেননি। নজরুলের অবদান অস্বীকার করার এই প্রবণতা—এমন কথা এ মুহূর্তে নজরুলবিরোধী অনেক দুর্জনের কণ্ঠেও শোনা যাচ্ছে।

আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৪৯ সালের জুন মাসে কলম্বিয়া রেকর্ড কোম্পানি থেকে প্রথম প্রকাশিত হয় গানটি। যার লেবেলে কথা ও সুরের জায়গায় লেখা ছিল কাজী নজরুল ইসলামের নাম।

মূল বিষয়ে আসা যাক। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের পর বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে মুক্তিসংগ্রামীদের সবচেয়ে বেশি শক্তি জুগিয়েছিল যেসব গান, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম কারার ঐ লৌহ-কবাট। এমন জনপ্রিয় গানটি ভারতের রাজা কৃষ্ণ মেনন তাঁর ‘পিপ্পা’ চলচ্চিত্রে ব্যবহার করেছেন। তবে যেভাবে ব্যবহার করেছেন, তা বিরক্তির জন্ম দেয়, জন্ম দেয় হাজারো প্রশ্নের।

এই গানের সংগীতায়োজনের নামে ভারতের অন্যতম আলোচিত ও কুশলী সংগীত পরিচালক এ আর রাহমান ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করেছেন। মূল সুরের ধারেকাছে না গিয়ে একেবারে ভিন্ন একটি সুর তৈরি করে এই অমর গানকে মূল জায়গা থেকে সরিয়ে দিয়েছেন তিনি।

স্বাভাবিকভাবেই সারা পৃথিবীর অগণিত মানুষ এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছেন। বাংলাদেশের অনেক গবেষক, শিল্পী ও নজরুলপ্রেমীর সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের অগণিত শিল্পী ও বিদগ্ধজনও সমানভাবে এই কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে তাঁদের অবস্থান সুদৃঢ় করেছেন।

Also Read: ‘কারার ঐ লৌহ–কবাট’ কি ভাঙতে পারলেন এ আর রাহমান

সারা পৃথিবীর মানুষ যখন এই অপকর্মের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন, ঠিক তখনই কবি পরিবারের ছোট ছেলে কাজী অনিরুদ্ধের বড় ছেলে কাজী অনির্বাণ একটি ফেসবুক পোস্ট দিয়েছেন। যাতে তিনি উল্লেখ করেছেন, তাঁর মা কাজী অনিরুদ্ধের সহধর্মিণী কল্যাণী কাজী (সদ্য প্রয়াত) সারা দেশে নজরুলের গানটি যেন নতুনভাবে প্রচার পায়, সে জন্য নাকি ২০২১ সালে দুই লাখ রুপির বিনিময়ে ‘পিপ্পা’ ছবির প্রযোজকদের অনুমতি দিয়েছেন গানটি ব্যবহারের।

যেহেতু এখনো কাজী নজরুল ইসলামের সৃষ্টিকর্মের ‘রয়্যালটি’ কবি পরিবার সংরক্ষণ করেন, ‘শর্ষের মধ্যে ভূত’ সন্দেহে আপাতদৃষ্টে আন্দোলন, প্রতিবাদ ও ধিক্কার স্তিমিত হয়েছে। যদিও কাজী অনির্বাণ এখনো চুক্তিপত্রের কোনো অনুলিপি প্রকাশ করেননি।
কাজী নজরুল ইসলামের বড় ছেলে আবৃত্তিকার কাজী সব্যসাচীর দুই মেয়ে খিলখিল কাজী ও মিষ্টি কাজী এই ঘটনার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছেন, এই চুক্তির ব্যাপারে তাঁরা কিছুই জানেন না। আবার কাজী অনিরুদ্ধের মেয়ে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী অনিন্দিতা কাজীও একইভাবে তাঁর অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন, তীব্র প্রতিবাদ করেছেন।

এমন অবস্থায় আমাদের করণীয় কী? আমাদের অনেকেই আবেগের আতিশয্যে এ আর রাহমান ও রাজা কৃষ্ণ মেননের বিরুদ্ধে মামলা করার কথা বলছেন। কেউ কেউ এই সিনেমা থেকে গানটা বাদ দেওয়ার পক্ষে। আবার কারোর মতে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ভারতীয় হাইকমিশনে প্রতিবাদলিপি পাঠানো উচিত। আমি বিনয়ের সঙ্গে বলতে চাই, পদক্ষেপগুলোর একটিতেও কি আসল সমস্যার সমাধান হবে? কাজী নজরুল ইসলামের গানটির প্রতি যে অসম্মান করা হয়েছে, সেটির কি সমাধান হবে? আমার মনে হয় না।

এখানে একান্তভাবে আমার মতামত ও পর্যবেক্ষণ তুলে ধরতে চাই, যা কয়েক দিন ধরে আমি বলে যাচ্ছি। এ বিষয়ে ১১ নভেম্বর একটি সংবাদ সম্মেলন হয়, যেখানে বিভিন্ন ধারার শিল্পী, গবেষক, সংস্কৃতিকর্মী একত্র হয়ে এ কাজের তীব্র প্রতিবাদ করেন। সেখানে আমার প্রস্তাব ছিল—উত্তপ্ত বাক্যবাণ, অকারণ ক্ষুব্ধ প্রস্তাবনা দিয়ে কোনো লাভ হবে না।

আমার ধারণা, এ আর রাহমান মূল গানটি শোনেননি, তাঁকে শোনানোর ব্যবস্থাও করা হয়নি। বাংলা ভাষাও তিনি জানেন না। তাই এই গানের মূল স্পিরিট বা আবেগ তিনি অনুধাবন করতে পারেননি।

আক্ষেপের বিষয়, এ আর রাহমান না জানলেও এই গানের সঙ্গে জড়িত অনেকেই গানটির মূল সুর ও স্পিরিট সম্পর্কে নিঃসন্দেহে জানতেন। তাঁরাই বা কেন এ ব্যাপারে তাঁকে জানানোর উদ্যোগ নিলেন না—প্রশ্ন উঠেই যায়।

আমার বিশ্বাস, এ আর রাহমানের মতো আন্তর্জাতিক মানের সংগীত পরিচালককে যদি গানটার মূল সুর শোনানো হয়, গানটার মূল আবেগটি বোঝানো যায়, তাহলে তাঁর কাছ থেকে অসাধারণ সংগীতায়োজনের মাধ্যমে এই গানকে আবারও নতুনভাবে আবিষ্কার করতে পারব আমরা। যা হবে বিশ্বজোড়া কোটি কোটি নজরুলপ্রেমী মানুষের হৃদয়ের ক্ষত নিবারণের উপলক্ষ।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এই ‘পিপ্পা’ সিনেমার কাহিনি আবর্তিত হয়েছে, তাই গানটি বাদ দিলে সত্যের অপলাপ যেমন হবে, তেমনি নজরুলকে আরও অসম্মান করা হবে। কাজেই আমার মনে হয়, আবারও প্রমিত বাণী ও সুরে যদি গানটিকে রেকর্ড করে ছবিতে ব্যবহার করা হয়, তাহলে আমরা এ সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে পারব। আর তাতে কুল-মান দুটিই বাঁচবে।

  • সালাউদ্দিন আহমেদ উচ্চাঙ্গ ও নজরুলসংগীতশিল্পী, শিক্ষক ও স্বরলিপিকার