Thank you for trying Sticky AMP!!

‘দুঃখ করো না, বাঁচো’

‘দুঃখকে স্বীকার করো না,-সর্বনাশ হয়ে যাবে।/দুঃখ করো না, বাঁচো, প্রাণ ভ’রে বাঁচো।/বাঁচার আনন্দে বাঁচো। বাঁচো, বাঁচো এবং বাঁচো।/জানি মাঝে-মাঝেই তোমার দিকে হাত বাড়ায় দুঃখ,/তার কালো লোমশ হাত প্রায়ই তোমার বুক ভেদ করে/চলে যেতে চায়, তা যাক, তোমার বক্ষ যদি দুঃখের/নখরাঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়; যদি গলগল করে রক্ত ঝরে,/তবু দুঃখের হাতকে তুমি প্রশ্রয় দিও না মুহূর্তের তরে।/তার সাথে করমর্দন করো না, তাকে প্রত্যাখান করো।’ (দুঃখ করো না, বাঁচো—নির্মলেন্দু গুণ)

মানুষের জীবনে তো দুঃখ আসবেই। এমন দুঃখ আসে, মনে হয়, আর সামলাতে পারব না। কিন্তু 'সৃষ্টিকর্তা মানুষকে এমন বোঝা দেন না, যা সে বইতে পারবে না।' দুঃখ সামলে নিয়ে বাঁচার আনন্দে বাঁচতে হবে। প্রাণভরে বাঁচতে হবে।

রবীন্দ্রনাথের বোঝাপড়া কবিতায় আছে:
’তোমার মাপে হয়নি সবাই/তুমিও হওনি সবার মাপে,/তুমি মর কারো ঠেলায়/কেউ বা মরে তোমার চাপে—  /তবু ভেবে দেখতে গেলে/এমনি কিসের টানাটানি?/তেমন করে হাত বাড়ালে/সুখ পাওয়া যায় অনেকখানি।/আকাশ তবু সুনীল থাকে,/মধুর ঠেকে ভোরের আলো,/মরণ এলে হঠাৎ দেখি/মরার চেয়ে বাঁচাই ভালো।/যাহার লাগি চক্ষু বুজে/বহিয়ে দিলাম অশ্রুসাগর/তাহারে বাদ দিয়েও দেখি/বিশ্বভুবন মস্ত ডাগর।/মনেরে তাই কহ যে,/ভালো মন্দ যাহাই আসুক/সত্যেরে লও সহজে।’

মরার চাইতে তো বাঁচাই ভালো। আমার যখন মন খারাপ থাকে, তখন আমি রবীন্দ্রনাথের বোঝাপড়া কবিতাটা পড়ি। তাতে তিনি বলছেন, ‘কেউ বা তোমায় ভালোবাসে/কেউ বা বাসতে পারে না যে,/কেউ বিকিয়ে আছে, কেউ বা/সিকি পয়সা ধারে না যে।’ এটা মান্ধাতার আমল থেকে চলে আসছে। সব জখম থেকে কেউই নিজেকে বাঁচাতে পারবে না। ‘মনেরে তাই কহ যে,/ভালো মন্দ যাহাই আসুক/সত্যেরে লও সহজে।’

আইনস্টাইন বলেছেন, ‘জীবন হলো বাইসাইকেলের মতো, সব সময় চালাতে হয়, তা না হলে পড়ে যেতে হয়।’ রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, আইনস্টাইন, বিল গেটস কেউই ভালো ছাত্র ছিলেন না। এপিজে আবদুল কালাম বিমানবাহিনীর পাইলট হতে চেয়ে পরীক্ষা দিয়ে ফেল করেছিলেন। তাতে কি তাঁর জীবন ব্যর্থ হয়ে গেছে?

দুই.

আঁচল ফাউন্ডেশনের গবেষণা-প্রতিবেদনের শিরোনাম: ‘বেড়েই চলেছে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার হার, আমাদের উদ্বিগ্ন হওয়া কতটা জরুরি’। ওই প্রতিবেদনের সংবাদ পড়ে তাঁদের তোলা প্রশ্নের একটাই উত্তর পাচ্ছি, আমাদের উদ্বিগ্ন হওয়া অত্যন্ত জরুরি। ৮ মাসে ৩৬৪ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। এর মধ্যে ৫৩ ভাগ স্কুল শিক্ষার্থী। এর চেয়ে উদ্বেগজনক খবর আর কী হতে পারে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক কামাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেছেন, ‘এক বছরে এতগুলো প্রাণ চলে যাওয়ার খবর ভীতিকর। তার মতোই ভীতিকর হলো বিষয়টি নিয়ে কেউ কিছু ভাবছে না। অথচ আমাদের দেশে প্রতিবছর আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে।’

অধ্যাপক কামাল চৌধুরী বলছেন, একই রকম ভীতিকর হলো বিষয়টা নিয়ে কেউ কিছু ভাবছে না। যাদের ভাবার, তাঁরা কি একটু ভাববেন? যারা হাতে তুলে নিয়েছেন আমাদের নির্ভরতার চাবি, তাঁরা কি কিছু করবেন? প্রতিটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পেশাদার কাউন্সেলর চাই। যে কোনো মানসিক সমস্যায় ২৪ ঘণ্টার যে কোনো সময়ে ফোন করতে পারি, পরামর্শ নিতে পারি, এমন হটলাইন নম্বরের নির্ভরযোগ্য সেবা চাই, অ্যাপ চাই।
আঁচল ফাউন্ডেশন বলছে, শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার কারণের মধ্যে আছে, ‘পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া, পড়াশোনার চাপ, সেশনজট, অভিমান, প্রেমঘটিত বিষয়, পরিবার থেকে কিছু চেয়ে না পাওয়া, পারিবারিক কলহ, ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি, চুরি বা মিথ্যা অপবাদ, মানসিক সমস্যা, বিয়েতে প্রত্যাখ্যাত, স্বামী পছন্দ না হওয়া, মোটরবাইক কিনে না দেওয়া ইত্যাদি।’ (প্রথম আলো, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২২)।

অভিভাবকদের বলব, নিজেদের অপূর্ণ সাধের বোঝা, প্রত্যাশার চাপ সন্তানের ওপরে চাপাবেন না। জিপিএ ফাইভ পেতেই হবে, ক্লাসে ফার্স্ট হতেই হবে, ডাক্তারি পড়তেই হবে—এই জাতীয় চাপ আপনার সন্তানের জীবন ধ্বংস করে দিচ্ছে। কতবার এ কথা বলব যে, ভালো ছাত্ররাও জীবনে সফল হয়, খারাপ ছাত্ররাও জীবনে সফল হয়। কোনো জীবনই ব্যর্থ নয়। কবি রবার্ট ফ্রস্ট বলেছেন, জীবন সম্পর্কে আমার সারা জীবনের উপলব্ধি আমি মাত্র তিন শব্দে বলে দিতে পারি, ‘জীবন চলেই যায়।’ লাইফ গোস অন। আর আইনস্টাইন বলেছেন, ‘জীবন হলো বাইসাইকেলের মতো, সব সময় চালাতে হয়, তা না হলে পড়ে যেতে হয়।’ রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, আইনস্টাইন, বিল গেটস কেউই ভালো ছাত্র ছিলেন না। এপিজে আবদুল কালাম বিমানবাহিনীর পাইলট হতে চেয়ে পরীক্ষা দিয়ে ফেল করেছিলেন। তাতে কি তাঁর জীবন ব্যর্থ হয়ে গেছে?

শিক্ষার্থীদের বলব, প্রেম জীবনে অনেকবার আসে। একজন চলে গেছে, চলে যেতে দাও, আরেকজন আসবে। চাই কি সেও ফিরে আসতে পারে। হাসো, বাঁচো, নিজেকে এগিয়ে নাও। কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, ‘প্রতিটি ব্যর্থ প্রেমই আমাকে নতুন অহংকার দেয়/আমি মানুষ হিসেবে একটু লম্বা হয়ে উঠি।’ একটা চমৎকার কথা দেখেছিলাম ফেসবুকে, ‘কেউ তোমার চোখের জলের যোগ্য নয়, যে তোমার অশ্রুর যোগ্য, সে তোমাকে কাঁদাবে না।’

কোনো উপলক্ষেই আত্মহত্যা করা যাবে না। কথা বলতে হবে। পরামর্শ নিতে হবে। বন্ধুর সঙ্গে কথা বলা যেতে পারে, পরিবারের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলা যেতে পারে। মানসিক চিকিৎসক বা পরামর্শকের কাছে যাওয়া যেতে পারে।

আরেকটা কথা। আমাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এবং আমাদের মূলধারার গণমাধ্যমে অনেক সময় আত্মহত্যাকে মহিমান্বিত করে খবর পরিবেশন করা হয়। এটা একদমই ঠিক নয়। গণমাধ্যমে আত্মহত্যার খবর পরিবেশন বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইনের চুম্বক অংশ আমি অনুবাদ করে দিচ্ছি:
১. আত্মহত্যা সম্পর্কে মানুষকে শিক্ষিত করে তুলতে সুযোগ গ্রহণ করুন।
২. আত্মহত্যাকে চাঞ্চল্যকর কিংবা স্বাভাবিক কিংবা সমস্যার সমাধান হিসেবে তুলে ধরে, এমন ভাষা পরিহার করুন।
৩. গণমাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ পৃষ্ঠায় বা অংশে আত্মহত্যার খবর প্রকাশ করবেন না। অকারণে আত্মহত্যার খবর পুনরাবৃত্তি করবেন না।
৪. আত্মহত্যা কিংবা আত্মহত্যাচেষ্টার পদ্ধতির বিশদ বর্ণনা দেওয়া থেকে বিরত থাকুন।
৫. আত্মহত্যার স্থানের পরিপূর্ণ তথ্য দেওয়া থেকে বিরত থাকুন।
৬. শিরোনামের শব্দগুলো খুব সতর্কতার সঙ্গে বাছাই করুন।
৭. ছবি কিংবা ভিডিও ফুটেজ দেওয়ার ব্যাপারে খুবই সাবধান থাকুন।
৮. তারকাদের আত্মহত্যার খবর পরিবেশনের সময় অতিরিক্ত এবং বিশেষ রকম সতর্কতা অবলম্বন করুন।
৯. শোকগ্রস্ত পরিবারগুলোর কথা সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনায় রাখুন।
১০. কোথায় সাহায্য পাওয়া যাবে, সে তথ্য পরিবেশন করুন।
১১. মনে রাখবেন, গণমাধ্যমে কর্মরত মানুষও এ ধরনের খবর দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। (সূত্র: প্রিভেন্টিং সুইসাইড: আ রিসোর্স ফর মিডিয়া প্রফেশনালস)

অভিভাবকদের বলব, আপনার সন্তানকে সময় দিন। ও যেন সারাক্ষণ দরজা বন্ধ করে একা একটা ঘরে না থাকে। সারাক্ষণ যেন মোবাইল ফোন বা গ্যাজেটের দিকে তাকিয়ে না থাকে। হাসুক, খেলুক, গান করুক, ছোটাছুটি করুক, কবিতা পড়ুক, ছবি আঁকুক, স্কুল কলেজে বিজ্ঞান ক্লাব, বিতর্ক ক্লাব, ফটোগ্রাফি ক্লাব ইত্যাদি নিয়ে মেতে থাকুক।
আরেকটা কথা। আমাদেরকে প্যারেন্টিং নিয়েও পরামর্শ দেবার মতো মানুষ চাই, প্রতিষ্ঠান চাই। আমরা কিন্তু ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না, সন্তানকে বেশি আদর দিয়ে ফেলছি না তো! বেশি শাসন করে ফেলছি না তো! মানসিক পরামর্শ দেবার সংগঠনগুলো এই দিকটাও গুরুত্বের সঙ্গে ভেবে দেখতে পারে।

আমার নিজের জীবন থেকে একটা টিপ আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারি। যখন খুব বড় আঘাত আসে, তখন আমি স্টেডিয়ামে গিয়ে বাংলাদেশের জন্য লাফাতে থাকি, ব্রাজিল আর্জেন্টিনা নিয়ে প্রায় অকারণে মাতামাতি করি। কোনো একজন ক্যানসার রোগীর জন্য তহবিল সংগ্রহ করতে দিনরাত পরিশ্রম করি। এগুলো আমার সারভাইভাল স্ট্রাটেজি। টিকে থাকার কৌশল।

বাংলাদেশ হেরে গেলে আমি কাঁদি। কারণ, তাতে সুখ পাওয়া যায়। আমি তো দেশের জন্য কাঁদছি।

  • আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক