Thank you for trying Sticky AMP!!

কুমলাই নদ হত্যায় সরকারি-বেসরকারি আয়োজন

নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার শুটিবাড়ি নামক স্থানে কুমলাই নদী। দখলে এ নদীর প্রাণ ওষ্ঠাগত।

একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ক্লিনিক, সরকারি মহিলা মার্কেট, একাধিক সরকারি কাঁচা–পাকা সড়ক, অনেক বাড়ি, অনেক দোকান তৈরি করা হয়েছে কুমলাই নদ ভরাট করে। পুকুর কিংবা আবাদি জমিও অনেকে বানিয়েছেন। সিএস নকশায় এ নদের নাম কামনাই। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবি) বইয়ে ‘কুমলাল-নাউতারা’ নামে ভুল তথ্য দেওয়া।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের প্রকাশিত বইয়ে ‘আপার কুমলাই’ ও ‘লোয়ার কুমলাই’ নামের একটি নদকে দুই নদ হিসেবে দেখানো হয়েছে। স্থানীয় লোকজনের কাছে এর নাম কুমলাই। নদটি নীলফামারী জেলার ডিমলা উপজেলার ছাতনাই ইউনিয়নের ঝাড় শিংহাসর নামের স্থানে তিস্তা থেকে উৎপন্ন হয়ে প্রায় ২০ কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে খালিসা-চাপানি ইউনিয়নের ছোটখাতা এলাকায় তিস্তা নদীতে আবার মিলিত হতো। বর্তমানে নদীখেকোদের কারণে নদটি মরণাপন্ন।

এ নদ অতীতে অনেকবার দেখেছি। এর ভাটিতে যে এত ভয়াবহ দখল আছে, জানা ছিল না। সম্প্রতি দুদিন গিয়েছিলাম। অসংখ্য মানুষ এ ব্যাপারে কথা বলেছিলেন। ‘নদটি সুরক্ষায় করণীয়’ শীর্ষক আলোচনা সভা করেছি। রিভারাইন পিপলের ‘কুমলাই নদ শাখা’ গঠন করা হয়েছে। স্থানীয় জনগণের আকুতি নদটি মুক্ত হোক।

কুমলাইকে মেরে ফেলতে পাউবোর প্রথম চেষ্টা

পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিজ্ঞ (!) প্রকৌশলীরা কুমলাই নদের উৎস ও মিলনস্থল তিস্তা রক্ষা বাঁধের নামে নির্মমভাবে বন্ধ করেছে। উৎসমুখ বন্ধ হলেও বর্ষায় প্রচুর পানি আসে। শুষ্ক মৌসুমেও ঝিরিঝিরি পানি প্রবাহিত হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ড নদটি খুন করার জন্য প্রথম অস্ত্র চালালেও নদটির মিলনস্থল থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার উজানে গয়াবাড়ি গ্রামে নতুন একটি প্রবাহ তৈরি করে নেয়। এ প্রবাহ প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে ধুম নদে মিলিত হয়।

নদটি মেরে ফেলতে পাউবোর দ্বিতীয় চেষ্টা

শক্তিশালী কুমলাই নদকে প্রথমে এর উৎস-মিলনস্থল ভরাট করে দুর্বল করা হয়। যখন নানা রকম অবৈধ দখল চলতে থাকে, তখন নদটি আরও দুর্বল হয়। এ সুযোগে পানি উন্নয়ন বোর্ড নদটির প্রায় ১০ কিলোমিটার মেরে ফেলার সব আয়োজন সম্পন্ন করে। মতিরবাজার নামের স্থানের কাছেই কুমলাই নদের ভাটির প্রায় ১০ কিলোমিটার নদকে বাদ দিয়ে উজানের পানি নাউতারা নদীতে নিয়ে যাওয়ার জন্য দুই কিলোমিটার কৃত্রিম খাল খনন করে সংযোগ স্থাপন করা হয়। এভাবে কুমলাই নদের ভাটির ১০ কিলোমিটার অবৈধ দখলদারের ভোগ করার সুযোগ করে দেওয়া হয়।

নদের ওপর সরকারি সড়ক

কুমলাই নদের ওপরে কয়েকটি সড়ক করা হয়েছে। ডিমলা উপজেলার গয়াবাড়ি ইউনিয়নের শুটিবাড়ি বাজারের ভেতরেই আছে দুটি সড়ক। সেখানকার প্রায় এক কিলোমিটার ভাটিতে আছে আরও একটি সড়ক। মতিরবাজারে আছে আরেকটি সড়ক। আড়াআড়ি এই সড়কগুলো নদের সর্বনাশ করার একেকটি পেরেক। সরকারের যে সংস্থাগুলো এসব সড়ক করেছে, তারা একবারও দেখেনি কোথায় হচ্ছে সড়ক

নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার শুটিবাড়ি বাজারের এই অবকাঠামোগুলো কুৃৃমলাই নদীর প্রবাহ বন্ধ করে অবৈধ ভাবে গড়ে উঠেছে।

ক্ষতির ধরন

কুমলাই তিস্তার শাখা নদ ও উপনদ। দুটি স্থলেই তিস্তা থেকে নদটিকে বিচ্ছিন্ন করার কারণে তিস্তা নদীর প্রাকৃতিক রূপ ক্ষুণ্ন হয়েছে। তিস্তার ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। গয়াবাড়ি গ্রামে নতুন সৃষ্ট প্রবাহটির দৈর্ঘ্য প্রায় ২৫ কিলোমিটার। এই ২৫ কিলোমিটার নদ প্রবাহিত হয়েছে সাধারণ কৃষকের জমিতে। সাধারণ কৃষকেরা এই জমির অধিগ্রহণবিষয়ক কোনো সুবিধাও পাননি।

পানি উন্নয়ন বোর্ড যে নতুন করে দুই কিলোমিটার খনন করেছে, সেটিও অর্থ অপচয়। নদটিতে আগে প্রচুর মাছ হতো। সেই মাছ আর এখন নেই। নদটি এককালে নৌপথ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ১০ নম্বর ছাতনাই ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান বলেনÑ ‘কুমলাই নদে নৌকা চলত, বাগাইড় মাছ পাওয়া যেত, শিশু (শুশুক) দেখা যেত, নদীটি অনেক প্রশস্ত আর অনেক গভীর ছিল।’ এখন সেসবের কিছুই নেই। অর্থনীতি ও পরিবেশ—দুই ক্ষেত্রেই ক্ষতি হচ্ছে।

সিএস রেকর্ড ও এসএ খতিয়ানে নদী, আরএস রেকর্ডে ব্যক্তিমালিকানা

একবার নদ–নদী হিসেবে কোনো প্রবাহের স্বীকৃতি মিললে সেই নদ–নদীর আর শ্রেণি পরিবর্তনের আইনগত কোনো সুযোগ নেই। ১৯৪০ সালের সিএস রেকর্ডে কুমলাই নদ হিসেবে রেকর্ডকৃত। এসএ খতিয়ানেও তা–ই। আরএস রেকর্ডে সেটি অনেকাংশে ব্যক্তির নামে রেকর্ড হয়েছে। অনেকেই অভিযোগ করে জানান, অবৈধ দখলদারেরা অবৈধ কাগজ তৈরি করে নিয়েছেন। কেউ কেউ বলেছেন, জেলা প্রশাসক কাউকে কবুলিয়াত দেননি, কিন্তু অবৈধ দখলদারেরা কাগজ তৈরি করে নদ দখলে নিয়েছেন।

নদ মারার পক্ষে রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠান!

যাদের এই নদ দেখভাল করার কথা ছিল, তাদের যৌথ প্রচেষ্টায় নদটির চরম ক্ষতি সাধন করা হয়েছে। প্রথমত, পানি উন্নয়ন বোর্ড ক্ষতি করেছে। তারপর স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে সেগুলো বিভিন্নভাবে ব্যক্তির নামে লিখে দেওয়া হয়েছে। যদি কোনো ব্যক্তি অবৈধভাবে কাগজ প্রস্তুত করেন, তাহলে সেগুলোর খাজনা নেওয়ার কথা নয়, খারিজ হওয়ার কথা নয়। যাঁরা খাজনা নিয়েছেন ও খারিজ করে দিয়েছেন, তাঁদের অপরাধও কম নয়।

যে কর্মকর্তা এই নদ ব্যক্তির নামে দেখিয়ে নতুন ভূমি জরিপে ব্যক্তির নামে লিপিবদ্ধ করার জন্য পাঠিয়েছেন এবং যাচাই-বাছাই করে রেকর্ড প্রকাশের জন্য অনুমোদন দিয়েছেন, তাঁরা সবাই অপরাধী। এমনকি ভূমি জরিপ বোর্ডের আওতায় যে কর্মকর্তারা সিএস রেকর্ডে নদ থাকার পরও আরএস রেকর্ডে ব্যক্তির নামে দাগ কেটেছেন, তাঁরাও দায় এড়াতে পারেন না।

স্থানীয়দের ভাষ্য

নদ ভরাট করে মার্কেট করার কথা স্বীকার করেন শাহের আলী। শুটিবাড়ি বাজারে তাঁর মোট পাঁচটি দোকান আছে। তিনি বললেন, ‘আমার দোকানগুলো কুমলাই নদীর ওপর। সামনের মহিলা মার্কেটও নদীর ওপর।’ নদ ভরাট করে এসব হয়েছে। বয়স্ক দুই ব্যক্তি ছবেদ আলী ও আবদুর রহমান তাঁদের ছোটবেলায় দেখা প্রবহমান কুমলাইয়ের কথা বলেন। তাঁরা বলেন, গয়াখড়িবাড়ি আদর্শ দ্বিমুখী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়টি নদ ভরাট করে নির্মাণ করা হয়েছে। যেহেতু এই নদ ভরাট করে স্থাপনা করার ইতিহাস অল্প দিনের, তাই অনেকের স্মৃতিতে এটি প্রবহমান কুমলাই।

উপসংহার

বেশ স্বাস্থ্যবান একটি নদ কুমলাই। সরকারি তালিকায় নদটিতে মোট অবৈধ দখলদারের সংখ্যা ২৭০। এ নদকে জীবন ফিরিয়ে দেওয়া খুবই সহজ কাজ। অবৈধ স্থাপনা তুলে দিয়ে নদটির উৎস ও মিলনস্থলে আধুনিক প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে পানির প্রবাহ সচল করতে হবে। যাঁরা অবৈধভাবে নদের শ্রেণি পরিবর্তনের সঙ্গে জড়িত, নদ ব্যক্তির নামে লিখে দিয়েছেন এবং যাঁরা ভোগ করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে শক্ত আইন প্রয়োগ করতে হবে।

  • তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক