Thank you for trying Sticky AMP!!

কেন গুণী মানুষেরা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পান না

অভিমান করে চলে গেলেন আমাদের একজন অতিগুণী মানুষ, শহীদসন্তান এবং আমাদের রক্তধারা ’৭১-এর উপদেষ্টা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক কথাবার্তা হচ্ছে, কিন্তু মূল একটা প্রশ্ন—কেন গুণী মানুষেরা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পান না বা কারা কীভাবে পান?

ফেসবুকে একজন প্রশ্ন করলেন ২০২৪ স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের নিয়ে। তিনি বললেন, দুজন ছাড়া আর কাউকে চেনেন না অথবা কোন কৃতিত্বের জন্য তাঁরা এ সম্মান পেতে যাচ্ছেন, তা-ও জানা নেই। কিন্তু সাদি ভাই এবং তাঁর মতো আরও অনেকে হতবাক হচ্ছেন, কষ্ট পাচ্ছেন।

সাদি ভাই অবহেলিত, অপমানিত বোধ করেছেন বলে নিজেই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন।

অপমানবোধটা এতই তীব্র ছিল যে তিনি বেঁচে থাকার ইচ্ছাটুকু হারিয়ে ফেলেন। কাউকে দোষ দেননি, শুধু ধুঁকে ধুঁকে কেঁদেছেন নিভৃতে।

হয়তো বলার মতো কোনো নীতিনির্ধারকদের কাউকে পাননি বা বলতে লজ্জা বোধ করেছেন। কী করে নিজের কথা বলা যায়! সাদি ভাই সেখানেই ভুল করেছেন।

গ্যাজেট আমার কাছে আছে, কিন্তু তখন সার্টিফিকেট ছিল না। কারণ, আমার মা তাঁর প্রয়োজন মনে করেননি। এ ছাড়া তিনি সরকার বা অন্য কোনো সূত্র ধরে টাকা বা অন্য কিছুই নেননি শহীদ পরিবার হিসেবে। শুধু ডিওএইচএসে একটা জমি চেয়েছিলেন করাচি ডিওএইচএসের পরিত্যক্ত জমির বিপরীতে। তা-ও আজ অবধি হয়নি। কদিন আগে রহস্য উদ্‌ঘাটন করলাম সেই ‘কেন’র, কিন্তু আজ অবধি আর কোনো সংবাদ মেলেনি।

শোনা যায়, মেধা নয়, রাজনীতি বা অন্যান্য বিষয় প্রাধান্য পেয়ে থাকে এ ধরনের পুরস্কারপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে। রাজনীতি বিষয় হলে সাদি ভাইয়ের সমস্যা ছিল না। তাহলে অন্য কোনো ব্যাপার আছে। কী ব্যাপার, তা খতিয়ে দেখা দরকার।

আজ আমি নিজের একটি অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে চাই। কারণ, ব্যাপারটা শুধু বেদনাদায়কই নয়, বরং হতাশাজনক, অপমানজনক।

২০১৯ সাল। আমি কয়েক বছরের স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের তালিকা দেখলাম, সঙ্গে তাঁরা কী কারণে সম্মানিত হলেন, তা-ও দেখলাম। মনে হলো আমার বাবা শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বুদ্ধিজীবী লে. কর্নেল মো. আবদুল কাদীরের কথা, যিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে ‘ভাষানী’ বলে পরিচিত ছিলেন তাঁর বাঙালিয়ানার জন্য।

আমি তৎকালীন ইঞ্জিনিয়ার-ইন-চিফ মেজর জেনারেল সিদ্দিকুর রহমান সরকারকে অনুরোধ করলাম বাবার জন্য আবেদন করতে। তাঁরা করেছিলেন, কিন্তু আশ্চর্যজনক কারণে তাঁর নাম তালিকাতেই ছিল না ২০২০ সালে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বলেছিলাম আবেদনের কথা। তিনি পরে বললেন, আবেদনটি তাঁর টেবিল পর্যন্ত পৌঁছায়নি। খোঁজ নিলাম এর রহস্য সম্পর্কে। কেউ একজন জানাল, তাঁর গেজেট আর মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট ফাইল ছিল না। কেন ছিল না? যাঁরা পাঠালেন কষ্ট করে, তাঁরাই বলতে পারবেন।

গ্যাজেট আমার কাছে আছে, কিন্তু তখন সার্টিফিকেট ছিল না। কারণ, আমার মা তাঁর প্রয়োজন মনে করেননি। এ ছাড়া তিনি সরকার বা অন্য কোনো সূত্র ধরে টাকা বা অন্য কিছুই নেননি শহীদ পরিবার হিসেবে। শুধু ডিওএইচএসে একটা জমি চেয়েছিলেন করাচি ডিওএইচএসের পরিত্যক্ত জমির বিপরীতে। তা-ও আজ অবধি হয়নি। কদিন আগে রহস্য উদ্‌ঘাটন করলাম সেই ‘কেন’র, কিন্তু আজ অবধি আর কোনো সংবাদ মেলেনি।

Also Read: রাষ্ট্রীয় পুরস্কার: জিব কাটো লজ্জায়

কর্নেল কাদীর অ্যাকটিভ সার্ভিসে ছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমার মাকে বলেছিলেন, তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন কর্নেল কাদীর। জাতির পিতা কেঁদেছিলেন আবেগপ্রবণ হয়ে।

মার্চের প্রথম দিকে কর্নেল কাদীর অফিস আর বাসায় (পাঁচলাইশ, চট্টগ্রাম) বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করলেন, বিদ্রোহ করলেন পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে। আশপাশে বিহারিদের রাগের কারণ হলেন।

কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে যেতে পারলে তিনি বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা পাঠ করতেন, কিন্তু তিনি যেতে না পেরে চলে যান রামগড়, খাগড়াছড়িতে।

এর আগে কর্নেল কাদীর এক্সক্লুসিভ পাচার করেন, যা দিয়ে শোভাপুরসহ অন্যান্য সেতু উড়িয়ে দেন মুক্তিযোদ্ধারা।

এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে, খুব সম্ভবত ১৫ এপ্রিলে বাসায় কর্নেল কাদির হাজির হলেন অন্তঃসত্ত্বা বেগমকে দেখতে, তারপর ১৭ এপ্রিল তাঁকে পাকিস্তানি সেনারা ধরে নিয়ে গেল তাঁর বিহারি পিএর সাহায্যে। লুকিয়ে লুকিয়ে মিটিং করেছেন মেজর রফিকুল ইসলাম বীর উত্তমদের সঙ্গে; (‘আ টেইল অব মিলিয়ন্স’, পৃষ্ঠা ৪৬/ ‘মুক্তিযুদ্ধ: অজানা অধ্যায়’ (জাগৃতি প্রকাশনী)।

কেউ কি বলতে পারবেন, অ্যাকটিভ সার্ভিস থেকে আর কোনো সেনা অফিসার বাংলাদেশের জন্য এত সাহসী কাজ করেছেন? উত্তর—আর কেউ না। তাহলে কেন তাঁকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত করা হলো?

এ বেদনায় আমি সাদি ভাইয়ের পথ বেছে নিলে কি রাষ্ট্র খুশি হবে?

গ্রামে (বদরগঞ্জ, রংপুর) জীবনের সঞ্চয় দিয়ে স্মৃতিসৌধ করলাম অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে। কিন্তু পাঁচ বছর হলো সামনের রাস্তা নানা কারণে হয়নি এখনো। এই কি আমাদের শ্রদ্ধা শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য? যদি শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় এই হয়, তাহলে আমরা কোথায় যাব?

আমি মনে করি, পদক বাছাই কমিটি সভাসদদের নাম ঘোষণা করতে হবে এবং একটা ঠিকা দিতে হবে, যেখানে সবাই আবেদন করতে পারবে। কমিটি সভাসদদের প্রশ্ন করার অধিকার থাকতে হবে জনগণের—কেন পদক পেল আর কেন পেল না।

সরকারকে অনুরোধ করব, অনুমোদন দেওয়ার আগে ভাববেন এবং অনৈতিক কার্যক্রম থেকে পদক প্রদান কার্যক্রমকে বাঁচান।

  • নাদীম কাদির জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও লেখক