Thank you for trying Sticky AMP!!

রাশিয়ার শীতযুদ্ধে ইউরোপের রাজনীতি জমে বরফ

প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি একটি শান্তি পরিকল্পনা করেছেন, সেটি নিয়ে তিনি ওয়াশিংটনেও যান।

ইউরোপজুড়ে এ বছর বড়দিনের উৎসব অন্যান্য বছরের তুলনায় নিষ্প্রভ ছিল। রাশিয়া গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দেওয়ার পর ইউরোপের একের পর এক সরকার তাদের দেশে বিদ্যুৎ ব্যবহার কমানোর ঘোষণা দিয়ে চলেছে।

প্যারিসের আইকনিক অনেক ভবনে কিংবা লন্ডনের অক্সফোর্ড স্ট্রিটের বড়দিনের বিখ্যাত আলোকসজ্জা এবার হয়নি। জার্মানির সরকার জ্বালানি ব্যবহার কমানোর জন্য প্রচারাভিযান চালিয়েছে। ইউরোপের একেবারে পূর্ব সীমান্তের যুদ্ধ পশ্চিম ইউরোপের প্রতিটি ঘরবাড়িতে আছড়ে পড়েছে।

জ্বালানিকে অস্ত্রে পরিণত করা রাশিয়ার শীতকালীন যুদ্ধকৌশলের অংশ। ক্রেমলিন আশা করছে, শীতকাল পশ্চিমাদের নৈতিকতায় চপেটাঘাত করবে এবং ইউরোপকে বিভক্ত করবে। মাসের পর মাস ধরে চলা এই যুদ্ধের কারণে বিশ্বে খাদ্যপণ্যের সরবরাহ শৃঙ্খল ভেঙে পড়েছে এবং প্রধান খাদ্যশস্যের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। এতে আরব ও আফ্রিকার দেশগুলোতে আতঙ্কজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।  

কিন্তু মস্কো মনে করে শীতকালীন যুদ্ধ তাদের কাছে এক গোপন অস্ত্র। ইউরোপের সরকারগুলো মস্কোর ওপর যে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, তার পাল্টায় তাদের ঠান্ডায় জমিয়ে রেখে এবং ইউক্রেনজুড়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির অবকাঠামো ধ্বংস করে দিয়ে ইউক্রেনীয়দের মনোবল গুঁড়িয়ে দিতে চায় রাশিয়া।

ধরা যাক, স্থবির এই যুদ্ধে মস্কো কিছুটা লাভবান হচ্ছে, কিন্তু বাস্তব সত্য হচ্ছে, রাজনৈতিক স্থবিরতায় কেউই লাভবান হচ্ছে না। এই যুদ্ধ বিশ্বরাজনীতি ও বাণিজ্যে বিশাল বদল নিয়ে আসছে। নতুন নতুন জোট গড়ে উঠছে। রাষ্ট্র ও কোম্পানিগুলো তাদের হাজার হাজার কোটি ডলার সরিয়ে নিয়ে কোথায় বিনিয়োগ করব, তা নতুন করে নির্ধারণ করছে। এই যুদ্ধ বিশ্ববাজারকে উপড়ে ফেলেছে।

রাশিয়ার এই কৌশল কি কাজ করছে? উত্তর হলো, না। এর কারণ এই নয় যে ইউরোপিয়ানদের সংকল্প খুব দৃঢ়; বরং এর কারণ হলো, বাস্তবে পশ্চিমের অধিবাসীরা এখন পর্যন্ত রাস্তায় নামেনি। একটি সত্যি কথা হলো, ইউরোপের কাছে কোনো পরিকল্পিত শান্তি পরিকল্পনা নেই। মীমাংসা আলোচনা শুরু হতে পারে, এমন কোনো পথরেখাও তাদের হাতে নেই। প্রকৃতপক্ষে ইউরোপের রাজনীতিই জমে বরফ হয়ে গেছে। আবার রাশিয়া যদি তাদের শীতকালীন যুদ্ধকৌশল সফল করতে চায়, তাহলে প্রথমে তাদের এই যুদ্ধ পরিসমাপ্তির একটা পথ খুঁজে বের করতে হবে।

সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলেও দেখা যাচ্ছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ স্থবির হয়ে পড়েছে। গত সপ্তাহে অবশ্য ইউক্রেনের সামরিক গোয়েন্দারা বড় সফলতা পেয়েছেন। কিন্তু সম্মুখসারির সেনাদল যুদ্ধক্ষেত্রে বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে আর অগ্রসর হতে পারছে না। অচল এই পরিস্থিতি মস্কোর জন্য অনুকূল। কেননা, এই ফাঁকে রাশিয়া ইউক্রেনের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ অবকাঠামো ধ্বংস করতে এবং ইউক্রেনীয়দের মনোবল ভেঙে দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে।

কিন্তু সবচেয়ে বড় বিষয়, এই যুদ্ধ রাজনৈতিকভাবে অচলাবস্থা সৃষ্টি করেছে। ইউক্রেনের দিক থেকে দেখলে প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি একটি শান্তি পরিকল্পনা করেছেন, সেটি তিনি ওয়াশিংটনেও নিয়ে যান। যদিও মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সরাসরি এটি অনুমোদন দেননি।

এর কারণ হলো, পরিকল্পনার মূল প্রস্তাব ইউক্রেনের সব ভূখণ্ডের সার্বভৌমত্ব ফিরিয়ে আনার বিষয়টি রয়েছে। যৌক্তিকভাবে এই ধারার মানে হচ্ছে, রাশিয়া সাম্প্রতিক যুদ্ধে ইউক্রেনের পূর্ব ও দক্ষিণ অঞ্চলের যে চারটি ভূখণ্ড দখল করে নিয়েছে, শুধু তার পুনরুদ্ধার নয়, ২০১৪ সালে তারা যে ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখলে নিয়েছিল, তারও পুনরুদ্ধার। রাশিয়া যে এই প্রস্তাব মানবে না, তা কল্পনা করা খুব একটা কঠিন বিষয় নয়। এরই মধ্যে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেটি খারিজ করে দিয়েছেন।

একইভাবে, ইউক্রেনের চারটি অঞ্চল রাশিয়ার অংশ বলে দাবি করছে ক্রেমলিন। কিয়েভের পক্ষ থেকে সেটা মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। ইউক্রেন সরকারকে এ ধরনের কিছু মানাতে হলে বাইরের বিশ্বের চাপ প্রয়োজন হবে।

আবার দুই পক্ষের বিশ্বাসেও অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন দুই পক্ষই বিশ্বাস করে, এখন পর্যন্ত যুদ্ধে না জিতলেও জেতার সক্ষমতা তাদের রয়েছে। ইউক্রেনের দিক থেকে বিবেচনা করলে, আগ্রাসন শুরুর পর প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি প্রথম বিদেশ সফরে ওয়াশিংটনে গেলেন। পরাশক্তি কিয়েভের পক্ষে আছে এবং জয় সুনিশ্চিত—এ রকম একটা অনুভূতি প্রকাশ করতে চাইলেন তিনি।

রাশিয়ার দিক থেকে বিবেচনা করলে দেখা যায়, এই যুদ্ধে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সেনা হারিয়েছে তারা। আবার ইউক্রেনীয় বাহিনী তাদের কাছ থেকে বেশ কিছু ভূখণ্ড পুনর্দখলেও নিয়েছে। তা সত্ত্বেও দীর্ঘদিন লড়াই চালিয়ে যাওয়ার মতো সামরিক সক্ষমতা রাশিয়ার রয়েছে। এমনকি পশ্চিমারা রাশিয়ার ওপর বড় ধরনের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের পরও দেখা যাচ্ছে, তাদের অর্থনীতি খুব একটা সংকুচিত হয়নি। প্রথম দিকে মনে করা হয়েছিল, নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার অর্থনীতি ১০-১৫ শতাংশ সংকুচিত হবে। কিন্তু বছর শেষে দেখা গেল, মাত্র ৩ শতাংশ সংকুচিত হয়েছে।

প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধ যত দীর্ঘায়িত হবে, রাজনৈতিক মীমাংসার সুযোগ ততই হাতছাড়া হতে থাকবে। কিয়েভ সরকার এখন স্পষ্ট করে বুঝতে পারছে, শান্তি প্রতিষ্ঠার বিনিময়ে চারটি অঞ্চল যদি তাদের মস্কোর কাছে ছেড়েই দিতে হয়, তাহলে বৃথাই এত মানুষের প্রাণবিসর্জন হলো। আর লাখ লাখ সৈন্য নামিয়ে যুদ্ধ করে ন্যূনতম কিছু অর্জন না দেখাতে পারলে যুদ্ধের যৌক্তিকতা প্রমাণ করা মস্কোর পক্ষে কঠিন।

এখন এমনকি ইউরোপিয়ান নেতারাও বুঝতে পারছেন, এ যুদ্ধ থেকে বেরিয়ে আসার পথ বের করা কতটা কঠিন। বাস্তবে কারও হাতেই কোনো রাজনৈতিক বিকল্প নেই। একটা দিকই কেবল খোলা আছে, সেটা যুদ্ধের বিরোধিতা। আর সব বিকল্পই এখন জমে বরফ হয়ে গেছে। যুক্তরাজ্যের ঋষি সুনাক কিংবা জার্মানির ওলাফ শলৎজের দিকে মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করুন। ইউরোপীয় নেতারা কেমন নিরুপায় হয়ে হাত গুটিয়ে বসে আছেন। অর্থনীতির কথা চিন্তা করে সমাধানের জন্য তাঁরা ওয়াশিংটনের দিকে চেয়ে আছেন।

আবার এটাও সত্য যে বন্ধ্যা সময়েও বিরল কোনো রাজনৈতিক বিকল্প সামনে আসতে পারে। গত মাসে যেমন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ প্রস্তাব করেন, যুদ্ধ বন্ধের জন্য রাশিয়াকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেওয়া উচিত। অবশ্য তাঁর এই প্রস্তাব সঙ্গে সঙ্গে ইউক্রেন ও ইউরোপীয় নেতারা প্রত্যাখ্যান করেন।

Also Read: ‘জেনারেল শীত’ ইউক্রেন যুদ্ধকে কী ডিপ ফ্রিজে রাখবে?

ধরা যাক, স্থবির এই যুদ্ধে মস্কো কিছুটা লাভবান হচ্ছে, কিন্তু বাস্তব সত্য হচ্ছে, রাজনৈতিক স্থবিরতায় কেউই লাভবান হচ্ছে না। এই যুদ্ধ বিশ্বরাজনীতি ও বাণিজ্যে বিশাল বদল নিয়ে আসছে। নতুন নতুন জোট গড়ে উঠছে। রাষ্ট্র ও কোম্পানিগুলো তাদের হাজার হাজার কোটি ডলার সরিয়ে নিয়ে কোথায় বিনিয়োগ করব, তা নতুন করে নির্ধারণ করছে। এই যুদ্ধ বিশ্ববাজারকে উপড়ে ফেলেছে।

সমাধানটা রাশিয়া অথবা ইউক্রেনের পক্ষ থেকে আসতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। কিন্তু অন্য যেকোনো জায়গা থেকে হলেও সেটা আসতে হবে।

  • ফয়সাল আল ইয়াফি মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে লেখক এবং বিবিসি, গার্ডিয়ানের মতো সংবাদমাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে কাজ করেছেন
    এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে