Thank you for trying Sticky AMP!!

এরদোয়ানের বিশেষ সামরিক অভিযান নিয়ে এখন চুপ কেন পশ্চিমারা

বালিতে অনুষ্ঠিত জি–২০ সম্মেলনে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান

বিশ্বে আরেকটি বিশেষ সামরিক অভিযান চলছে। রাশিয়ার পরিচালিত ইউক্রেনকে ‘নাৎসি মুক্তকরণ’ কিংবা ‘নিরস্ত্রীকরণ’ অভিযান সেটা নয়; এ কারণে সেটা পশ্চিমাদের মনোযোগের বিষয় হতে পারেনি। তুরস্কের নাগরিকদের ওপর কুর্দি সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছে, এমন অভিযোগে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইপে এরদোয়ান অপারেশন ক্ল-সোর্ড বা তরবারি নখর নামে বিশেষ এই সামরিক অভিযান শুরু করেছেন। এ অভিযানে উজ্জীবিত করা হচ্ছে জাতীয় আবেগ। কুর্দিদের ওপর যে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হচ্ছে, সেগুলোর নামকরণ করা হচ্ছে কুর্দি হামলায় নিহত তুর্কিদের নামে।

আঙ্কারার কর্মকর্তারা বলছেন, সিরিয়ার উত্তরাঞ্চল ও ইরাকে কুর্দি অধ্যুষিত এলাকায় তুরস্কের বিমান হামলা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনেছে। সম্প্রতি ইস্তাম্বুলের সড়কে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর যে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে, তার জন্য কুর্দি সন্ত্রাসীদের দায়ী করেছেন তাঁরা। এ হামলার জন্য আরও বড় মূল্য চুকাতে হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন আঙ্কারার কর্মকর্তারা। ধারণা করা হচ্ছে, বিশেষ অভিযানের এটা প্রথম ধাপের হামলা। ২০২২ সালে কুর্দি অধ্যুষিত এলাকায় তুরস্কের এটা তৃতীয়বারের মতো হামলা। তুরস্কের ‘সুলতান’ এরদোয়ান সিরিয়ার কুর্দি অধ্যুষিত এলাকায় স্থলহামলারও প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন। যদিও কূটনৈতিক সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে, এ ধরনের স্থল-অভিযান এখনই শুরু হচ্ছে না। তবে তুরস্কের বিশেষজ্ঞরা এ ব্যাপারে অনড় যে আগে হোক বা পরে, সিরিয়ায় স্থলবাহিনীর অভিযান অনিবার্য।

চলমান যুদ্ধ যে ধোঁয়াশার জন্ম হয়েছে তাতে মনে হতে পারে, রাশিয়া কুর্দিদের তুরস্কের বোমার মুখে ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবে সেটা ঘটার সুযোগ কম। কেননা, সিরিয়ার কুর্দি অধ্যুষিত এলাকায় রাশিয়ানদের তুলনায় আমেরিকানদের প্রভাব অনেক বেশি। সে কারণে একমাত্র আমেরিকানরাই কুর্দিদের তুরস্কের কাছে বিক্রি করে দিতে পারে। পরাবাস্তব বলে মনে হলেও একটা বাস্তবতা হলো, আঙ্কারা ও মস্কো সিরিয়ার জনগণের ভাগ্যের বিপর্যয়ের জন্য একটা সমাধান ইতিমধ্যে খুঁজে পেয়েছে।

কৌশলী সুলতান এরদোয়ানের সামনে এখন বিবেচনার জন্য দুটি বিষয় রয়েছে। আগামী বছর নির্বাচন। সিরিয়ায় সামরিক অভিযান এ ক্ষেত্রে তাঁর পক্ষেই যাবে। দ্বিতীয়টি রাশিয়ার সঙ্গে তুরস্কের অতি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। এর একটা বড় তাৎপর্য হলো ভূরাজনৈতিক ও ভূ-অর্থনৈতিক। এরদোয়ান ভালো করেই জানেন যে তাঁকে নিরস্ত করতে মস্কো সম্ভাব্য সব পথেই এগোবে। দৃষ্টান্ত হিসেবে, রাশিয়া একেবারে শেষ মুহূর্তে ইন-আল-আরবে রাশিয়া-তুরস্ক যৌথ মহড়া বাতিল করেছে। ইউফ্রেটিস নদীর পূর্ব দিকের ইন-আল-আরব ভূকৌশলগত কারণে খুব গুরুত্বপূর্ণ।  

ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে রাশিয়ার মধ্যস্থতার ভূমিকা পালন করছেন এরদোয়ান। ফলে সর্বোচ্চ লাভবান হচ্ছে আঙ্কারা। তুরস্কের এই অবস্থান ঝুঁকির মধ্যে পড়ুক, তা চান না এরেদায়ান। তুরস্কের সুলতান ভেলকিবাজিতে ওস্তাদ। তিনি খুব গভীরভাবে বিশ্বাস করেন যে রাশিয়া ও ন্যাটোকে শেষ পর্যন্ত আলোচনার টেবিলে নিয়ে যেতে পারবেন তিনি। তাতে অবসান হবে ইউক্রেন যুদ্ধের। এরদোয়ানের ভাবনায় আরও বেশ কিছু বিষয় রয়েছে। তুরস্ক-ইসরায়েল সম্পর্ক, দামেস্কের পুনর্মিলন, দেশের মধ্যে ইরানের নাজুক পরিস্থিতি, তুরস্ক-আজারবাইজান সম্পর্ক, ভূমধ্যসাগর অঞ্চলের ক্রমাগত রূপান্তর, ইউরেশিয়ার একত্রকরণ—এসব ইস্যুতে শীর্ষে থাকতে চান এরদোয়ান। ন্যাটো ও ইউরেশিয়া ঘিরে যত বাজি আছে, তার সব কটিই ধরতে চান তুরস্কের সুলতান।

তরবারির নখর অভিযান শুরুর সবুজ সংকেত এরদোয়ান দিয়েছেন উড়োজাহাজে থাকা অবস্থায়। সে সময় বালিতে অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলন শেষে তিনি আঙ্কারায় ফিরছিলেন। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে দেখা হওয়ার পরদিনই এটি ঘটেছে। যদিও তুরস্কের প্রেসিডেন্টের কার্যালয় থেকে দেওয়া বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, বিশেষ অভিযানের ব্যাপারে বাইডেনের সঙ্গে এরদোয়ানের আলোচনা হয়নি। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘জনাব বাইডেন অথবা পুতিনের সঙ্গে অভিযানের ব্যাপারে আমাদের কোনো আলোচনা হয়নি। তাঁরা দুজনেই ইতিমধ্যেই জানতেন, আমরা এ অঞ্চলে এ ধরনের ঘটনা যেকোনো মুহূর্তে ঘটাতে পারি।’

বালিতে অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলনের এক ফাঁকে বাইডেন-এরদোয়ান বৈঠকে কিংবা আকস্মিকভাবে ডাকা জি-৭-এর সভায় এরদোয়ানের বিশেষ অভিযান নিয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কি না, এ বিষয়ে ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে কোনো বিবৃতি আসেনি। পোল্যান্ডে এস-৩০০ ক্ষেপণাস্ত্র বিধ্বস্তের ঘটনায় জি-৭-এর সেই তাৎক্ষণিক সভা ডেকেছিল ওয়াশিংটন। সভায় উপস্থিত কোনো পক্ষই এখন পর্যন্ত নিশ্চিত করেনি সেখানে তুরস্কের বিশেষ অভিযান নিয়ে কথা উঠেছিল কি না। সেই সভায় তুরস্ককেও ডাকা হয়নি। হতে পারে এটি এরদোয়ানকে গভীরভাবে ক্ষুব্ধ করেছে।

Also Read: যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া সংঘাতে সরু দড়ির ওপর হাঁটছেন এরদোয়ান

এ কারণেই এরদোয়ান যখন বলেছেন, ‘তরবারির নখর’ কেবল শুরু হলো, সেটা কোনো বিস্ময়কর ঘটনা নয়। আইনসভায় জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির (একেপি) আইনপ্রণেতাদের উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে এরদোয়ান বলেছেন, ‘আমাদের দক্ষিণের সব সীমান্ত আমরা বন্ধ করে দেব।...একটি নিরাপত্তা করিডর তৈরি করব, যেটা সম্ভাব্য সব ধরনের হামলা থেকে দেশকে রক্ষা করবে।’

আঙ্কারা এরই মধ্যে ড্রোন হামলা চালিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেসের সদর দপ্তরের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করেছে। গোষ্ঠীটির কমান্ডাররা খুব দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, তুরস্কের স্থল অভিযানের অন্যতম লক্ষ্যবস্তু হলো কোবান অঞ্চল। খুব তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, এই প্রথমবারের মতো এমন একটি এলাকায় তুরস্ক হামলা করল, যার খুব কাছেই মার্কিন ঘাঁটি অবস্থিত। কোবানের প্রতীকী গুরুত্ব অনেক। কেননা, এখানেই আইএসআইএসের বিরুদ্ধে লড়তে আমেরিকানরা কুর্দিদের সঙ্গে জোট বেধেছিল।

তুরস্কের হামলার পরও যুক্তরাষ্ট্রের নিশ্চুপ অবস্থান এখন আতঙ্কিত করছে সিরিয়ার কুর্দিদের। তারা এখন আর কাকে দায়ী করবে? ২০২৩ সালের নির্বাচনের আগে জাতীয়তাবাদী আবেগ চাঙা করার এমন সুযোগ কেন হাতছাড়া করবেন এরদোয়ান। তুরস্কে অর্থনৈতিক বিপর্যয় সত্ত্বেও নির্বাচনে জেতার বড় মওকা এখন সুলতানের সামনে। বর্তমানে পরিস্থিতিতে বিমান হামলা ছাড়া কোবানে স্থলবাহিনীর উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে রাশিয়ার সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্কের সমীকরণটা প্রাধান্য পাচ্ছে। অবশ্য কোবানের চেয়ে ইউফ্রেটিস নদীর পশ্চিম তীরের মানবিজ ও তেল রিফাত রাশিয়ার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সম্ভাব্য সালাফি-জিহাদি হামলা থেকে আলেপ্পোকে রক্ষা করতে হলে এ দুটি এলাকা নিয়ন্ত্রণে রাখা গুরুত্বপূর্ণ।

Also Read: বিরোধীরা একজোট হওয়ায় কতটা কাবু এরদোয়ান

চলমান যুদ্ধ যে ধোঁয়াশার জন্ম হয়েছে তাতে মনে হতে পারে, রাশিয়া কুর্দিদের তুরস্কের বোমার মুখে ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবে সেটা ঘটার সুযোগ কম। কেননা, সিরিয়ার কুর্দি অধ্যুষিত এলাকায় রাশিয়ানদের তুলনায় আমেরিকানদের প্রভাব অনেক বেশি। সে কারণে একমাত্র আমেরিকানরাই কুর্দিদের তুরস্কের কাছে বিক্রি করে দিতে পারে। পরাবাস্তব বলে মনে হলেও একটা বাস্তবতা হলো, আঙ্কারা ও মস্কো সিরিয়ার জনগণের ভাগ্যের বিপর্যয়ের জন্য একটা সমাধান ইতিমধ্যে খুঁজে পেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদের উপস্থিতি তাদের জন্য বাধা। কেননা, মার্কিন সেনারা সিরিয়া থেকে তুরস্কে চুরি করে বিক্রির জন্য নিয়ে যাওয়া তেলের বহর আটকে দেন। রাশিয়ান ও সিরিয়ানরা বিষয়টি সব সময় আলোচনা করেন। মার্কিনিদের হটিয়ে দেওয়ার মতো শক্তি দামেস্কের নেই।

ভূরাজনীতি ও ভূ-অর্থনীতির সবটাই নিজের পক্ষে নেওয়ার জন্য যা যা করার দরকার, সবটাই করবেন এরদোয়ান। সিরিয়ার কুর্দিদের ওপর এখন তাঁর নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। সিরিয়া থেকে তুরস্কে তেল পৌঁছতে কোনো বাধা থাক, সেটা চান না এরদোয়ান।

  • পেপে এসকোবার, ব্রাজিলের ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষক
    এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে