Thank you for trying Sticky AMP!!

নিয়োগ পরীক্ষার যুদ্ধে হেরে যাওয়া গৌরি ভাইয়াদের স্থান কোথায় সরকারি নীতি ও সমাজে?

গৌরি ভাইয়াদের স্থান কোথায়

ভারতীয় উপমহাদেশের কোটি কোটি মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে গেছে ভারতের আইপিএস কর্মকর্তা মনোজ কুমার শর্মার জীবনভিত্তিক সিনেমা টুয়েলভথ ফেল।

মামা-চাচার সহায়তা ছাড়াও যে অধ্যবসায়, সততা ও নিষ্ঠার গুণে মানুষ কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে, মনোজ কুমার শর্মা তাঁর জলজ্যান্ত নজির। সেই সঙ্গে এই সিনেমার হৃদয়ছোঁয়া গল্পের ভেতর থেকে ভারতীয় শিক্ষা কাঠামো ও অর্থনীতির অনেক ফাঁকফোকর বেরিয়ে এসেছে, এই লেখায় সেদিকেই আলো ফেলার প্রয়াস।

এই ছবির গল্পে ভারতের মধ্যপ্রদেশের চম্বলের মোরেনার বাসিন্দা মনোজ সতীর্থদের সঙ্গে দ্বাদশ ক্লাসের পরীক্ষায় যেভাবে অবতীর্ণ হন, তার মধ্য দিয়েই ভারতীয় সমাজের এক করুণ চিত্র উঠে আসে। সেটা হলো, শিক্ষক ও অন্যান্য সম্পদ স্বল্পতার কারণে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার যে বারোটা বাজছে, তার চিত্র। ফলে সেখানে শিক্ষার্থীদের পাস করার একটাই তরিকা, সেটা হলো, নকল করা।

Also Read: বিসিএস নিয়ে এত মাতামাতি কি ঠিক হচ্ছে

সিনেমায় দেখা যায়, প্রধান শিক্ষকের সক্রিয় সহায়তায় নকল করতে বসেন মনোজ ও তাঁর সহপাঠীরা। আচমকা সেখানে উদয় হন এলাকার ডেপুটি পুলিশ সুপার দুষ্মন্ত সিংহ, হাতেনাতে ধরা পড়ে সবাই। গ্রেপ্তার হন ইমানদার কর্মকর্তাকে উৎকোচ দিতে গিয়ে ব্যর্থ প্রধান শিক্ষক। সেই পরীক্ষায় মনোজসহ সব ছাত্র অকৃতকার্য হন, সে কারণেই ছবির নাম টুয়েলভথ ফেল।

পাশাপাশি দুটি চিত্র কল্পনা করলে ভারতীয় সমাজের এই দিক পরিষ্কার হয়ে যায়। একদিকে ভারতীয় ছাত্ররা এমআইটি, হার্ভার্ডসহ বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে টপার হয়ে শীর্ষ করপোরেট প্রতিষ্ঠানে সুনামের সঙ্গে কাজ করেন, এমনকি অনেকে ভারতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেও শীর্ষস্থানীয় করপোরেট প্রতিষ্ঠানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন; আরেক দিকে মনোজের গ্রামের ছাত্ররা নকল করতে না পারলে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেন না।

এটা সমাজের চরম বৈষম্যের চিত্র, সেই সঙ্গে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার বেহাল চিত্রও বটে।

কথা হলো, ভারত ও বাংলাদেশের সমাজে মনোজ ও গৌরি ভাইয়াদের ছড়াছড়ি। সে জন্য সরকারি নীতি প্রণয়নের সময় এসব মানুষের কথা বিবেচনা করা উচিত। তা না হলে বিধু বিনোদ চোপড়ার উত্তরসূরিদেরও একই কাহিনি নিয়ে চলচ্চিত্র বানাতে হবে।

সিনেমায় দেখা যায়, নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠা মনোজের একমাত্র ধ্যানজ্ঞান আইপিএস কর্মকর্তা হওয়া। সেই লক্ষ্যে ছেলেটি যেকোনো ত্যাগ করতে প্রস্তুত, দিনমান এক করে তিনি অধ্যবসায় করে যান।

শুধু মনোজ নন, তাঁর মতো লাখ লাখ ছাত্রছাত্রী সরকারি কর্মকর্তা হওয়ার আশায় উদয়াস্ত পরিশ্রম করেন। বাংলাদেশেও একই বাস্তবতা দেখা যায়; বরং বলা ভালো, আমাদের দেশে এই পরিস্থিতি ক্রমেই আরও তীব্র আকার ধারণ করছে।

সরকারি চাকরির জন্য তরুণেরা হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন; সেই সময় অন্য কোনো কাজ তাঁরা করেন না। ফলে বিপুলসংখ্যক কর্মক্ষম তরুণ শ্রমশক্তির বাইরে থেকে যান। দেশে সরকারি চাকরি আকর্ষণীয় হয়ে ওঠায় তরুণদের স্বকর্মসংস্থানের প্রবণতায়ও প্রভাব পড়ছে বলে জানা যায়। বাস্তবতা হলো, বিসিএসে দুই লাখ ছাত্রছাত্রী অংশ নিলেও কৃতকার্য হন মাত্র হাজার দুয়েক; বাকিদের বড় অংশ একূল-ওকূল দুই-ই হারায়। সিনেমায় মনোজের সবচেয়ে বড় সহায় গৌরি ভাইয়া ঠিক তেমন এক নজির। আইপিএস হতে না পেরে শেষমেশ দোকান খুলে বসেন তিনি।

Also Read: এত বিসিএস পরীক্ষার্থী লইয়া দেশ কী করিবে!

আবার শিক্ষার প্রসঙ্গে আসা যাক। বাস্তবতা হলো, শিক্ষা খাতে জিডিপির ২ শতাংশের কম বিনিয়োগ করে বিশেষ ফল লাভ করা সম্ভব নয়। জনসাধারণের এক বিপুল অংশের শিক্ষাপ্রাপ্তির, বিশেষ করে, গুণগত শিক্ষাপ্রাপ্তির বিষয়টি অবহেলা করা হলে সমাজে একধরনের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক কুফল সৃষ্টি হয়। এটা মানুষের মৌলিক স্বাধীনতা হরণের শামিল; এর মধ্য দিয়ে তাঁদের মানবিক অধিকার লঙ্ঘিত হয়। এ কারণে মানুষের কাজের সুযোগ, আইনি সুরক্ষা, রাজনৈতিক কণ্ঠস্বর, পারিবারিক স্বাস্থ্য, প্রজননসংক্রান্ত স্বাধীনতা ও বঞ্চিত মানুষের সামাজিক প্রভাব—সবকিছুই ব্যাহত হয়।

বাস্তবতা হলো, ভারতীয় অর্থনীতি অনেক দিক থেকে এখন ভালো করছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও চীনের মতো দেশের তুলনায় কম শিক্ষিত সাধারণ শ্রমশক্তির জন্য ভারতীয় অর্থনীতিকে অনেক বড় মূল্য দিতে হচ্ছে বলে মনে করেন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন (বিশেষ দক্ষতা ও প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণের অভাবে)। একই কথা বাংলাদেশের বেলায়ও শতভাগ খাটে, রপ্তানি পণ্যের ঝুড়ি দেখলে বিষয়টি পরিষ্কার হয়।

কান্ট্রি অব ফার্স্ট বয়েজ গ্রন্থে অমর্ত্য সেন বলেন, ভারতের রপ্তানি খাত সেই সব চিরাচরিত পণ্যের ওপর নির্ভরশীল, যেগুলোর উৎপাদনে শিক্ষার খুব একটা প্রয়োজন হয় না; সেই সঙ্গে আছে বিশেষ দক্ষতাসম্পন্ন কিছু সুবিধাভোগী ভারতীয়দের দ্বারা প্রস্তুত বিভিন্ন পণ্য (যেমন তথ্যপ্রযুক্তিগত পণ্য, ইলেকট্রনিক সফটওয়্যার বা কল সেন্টার পরিষেবা ও যেখানে ইংরেজি ভাষার ওপর দখল ও কেতাদুরস্ত বাচনভঙ্গি হচ্ছে প্রধান চাহিদা, ভারতীয় মধ্যবিত্ত শ্রেণি, যা খুব সহজেই আয়ত্ত করতে পারে)।

বিপুলসংখ্যক অত্যন্ত সাধারণ পণ্যদ্রব্য, যেগুলো উৎপাদনে মৌলিক শিক্ষার (এবং লিখিত নির্দেশ পড়ে উঠতে পারা, তার বেশি নয়) মতো দক্ষতা লাগে, সে ক্ষেত্রে ভারতের সমস্যা অনেক বেশি।

এ ধরনের পণ্যের মধ্যে পড়ে ঘড়ি, ক্যালকুলেটর, এমনকি কম্পিউটার হার্ডওয়্যার (এতে বড় ধরনের গাণিতিক দক্ষতার প্রয়োজন হয় না) ইত্যাদি জিনিসপত্র, যেগুলোর উৎপাদনে চীন অনেক এগিয়ে আছে। বাস্তবতা হলো, পূর্ব এশীয় বিস্ময় বলতে আমরা যা জানি, অর্থাৎ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর উত্থানের পেছনে মূল ভূমিকা পালন করেছে এসব পণ্য উৎপাদন।

Also Read: বিসিএস কেন তরুণদের ধ্যানজ্ঞান হয়ে উঠছে?

টুয়েলভথ ফেল প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। ফার্স্ট বয় বা টপারদের নিয়ে উচ্ছ্বাসের আতিশয্য এই সিনেমায়ও দেখা যায়। কান্ট্রি অব ফার্স্ট বয়েজ বইয়ে অমর্ত্য সেন বলেন, ‘কেবল ফার্স্ট বয়দের নিয়ে উচ্ছ্বাসের কারণে সমাজের বড় ক্ষতি হচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘শিক্ষার অসাম্য কেবল বাদ পড়ে যাওয়া বা পিছিয়ে যাওয়া মানুষের প্রতি অন্যায় নয়, এ কারণে সামাজিক ব্যবস্থায় বড় ধরনের অদক্ষতা তৈরি হয়। এই দক্ষতা ব্যক্তিগত নৈপুণ্য নয়, এটা সামাজিক দক্ষতা। অর্থাৎ, সামগ্রিকভাবে সমাজ যতটা করতে পারে, তার চেয়ে কম করছে। এটাই সামাজিক অদক্ষতা।’

টুয়েলভথ ফেল এর সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হলো, হার না মানার মানসিকতা ও সততার সঙ্গে বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা। ইন্টারভিউ বোর্ডে কড়া কড়া প্রশ্নের মুখেও সৎসাহস নিয়ে জবাব দেয় মনোজ।

চতুর্থ, তথা শেষবারেও সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় ব্যর্থ হলে কী করবে—এমন প্রশ্নের জবাবে মনোজ বলেন, ‘হার নেহি মানুঙ্গা, রার নেহি ঠানুঙ্গা..’। ‘আইপিএস হওয়া আমার লক্ষ্য নয়; লক্ষ্য দেশের সংস্কার। আইপিএস না হলে গ্রামে গিয়ে শিক্ষক হব। শিশুদের শেখাব, চিটিং ছাড়তে হবে। ওই বয়সে ওরা এটা শিখে গেলে জীবনে আর কোনো দিন ঠকানোর রাস্তা নেবে না’—এই জবাব দেন মনোজ।

কথা হলো, ভারত ও বাংলাদেশের সমাজে মনোজ ও গৌরি ভাইয়াদের ছড়াছড়ি। সে জন্য সরকারি নীতি প্রণয়নের সময় এসব মানুষের কথা বিবেচনা করা উচিত। তা না হলে বিধু বিনোদ চোপড়ার উত্তরসূরিদেরও একই কাহিনি নিয়ে চলচ্চিত্র বানাতে হবে।

  • প্রতীক বর্ধন প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক