Thank you for trying Sticky AMP!!

বাংলাদেশের পাঠানো সাহায্য না পেয়ে হতাশ আরাকানবাসী

মোখা এমন এক সময় আরাকানে আঘাত হানে, যখন আরাকানসহ মিয়ানমারের বড় অংশজুড়ে কমবেশি গৃহযুদ্ধ চলছে।

বাংলাদেশ সরকার মিয়ানমারের ঘূর্ণিদুর্গতদের জন্য সহায়তা পাঠিয়েছিল জুনের প্রথম সপ্তাহে। পদক্ষেপটি ছিল অভিনন্দনযোগ্য। কিন্তু আরাকানের বিভিন্ন দুর্গত এলাকার নাগরিকেরা বলছে, তারা এ সাহায্য পায়নি। তারা সেখানকার সামরিক জান্তা সরকারের হাতে এ সাহায্য দেওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছে।

সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির শিকার পশ্চিম আরাকান

ঘূর্ণিঝড় মোখা বাংলাদেশের কক্সবাজার উপকূলও খানিকটা ছুঁয়ে যায়। তবে এটা ১৪ মে মূল আঘাত হানে মিয়ানমারের আরাকান উপকূলে। সেখানে আকিয়াব, রাথিডং, বুথিডং, ম্রাক-উ ইত্যাদি এলাকা ঝড়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছে। জাতিসংঘের হিসাবে এই ঘূর্ণিঝড়ে মিয়ানমারের প্রায় আট লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর মধ্যে আগে থেকে উদ্বাস্তু শিবিরে থাকা পরিবারগুলোও রয়েছে। আকিয়াবে এ রকম পরিবারগুলোর কয়েক শ রোহিঙ্গা নাগরিকও ঝড়ে মারা গেছেন। বুথিডংসহ অনেক এলাকা দীর্ঘ সময়ের জন্য যোগাযোগ থেকেও বিচ্ছিন্ন থাকে। ঝড়ের পরপর বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ায় পরিস্থিতি বাড়তি খারাপ হয়েছে।

আরাকানের নাগরিকেরা বলছেন, তাঁরা বাংলাদেশ থেকে আসা সহায়তার সামান্যই পেয়েছেন। কেন্দ্রীয় সরকার এই মানবিক সহায়তাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। তারা চাইছে, আরাকান আর্মি তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকা ছেড়ে চলে যাক, তাহলেই কেবল স্থানীয় রাখাইন ও রোহিঙ্গাদের সহায়তা দেওয়া হবে।

সাহায্য বিষয়ে আরাকান আর্মির চিঠি

মোখা এমন এক সময় আরাকানে আঘাত হানে, যখন আরাকানসহ দেশটির বড় অংশজুড়ে কমবেশি গৃহযুদ্ধ চলছে। চলমান এ গৃহযুদ্ধের মধ্যে গত নভেম্বর থেকে আরাকানে তুলনামূলকভাবে শান্ত অবস্থা যাচ্ছে স্থানীয় গেরিলা দল আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার যুদ্ধবিরতি কার্যকর থাকায়। তবে যুদ্ধবিরতি থাকলেও উভয় পক্ষ বিভিন্ন এলাকায় তাদের অবস্থান বজায় রাখছে এখনো। উভয়ের মধ্যে নানা ধরনের মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধও চলমান। এতে আরাকান জুড়ে বাসিন্দারা ঝড়ের আগে থেকে অর্থনৈতিকভাবে বিপন্ন অবস্থায় ছিল। তার মধ্যেই মোখা আঘাত হানে। এতে পুরো আরাকানের বাড়িঘর, অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি হয়। তবে পশ্চিম আরাকানে আগে থেকে যে এলাকায় যুদ্ধাবস্থা বেশি তীব্র, সেখানেই ঝড়ে ক্ষতি বেশি হয়েছে। রোহিঙ্গাদের বসবাসও এসব এলাকাতেই বেশি।

Also Read: আরাকানে মোখার দুর্গতরা প্রতিবেশী দেশের দিকে তাকিয়ে আছেন

মাঠপর্যায়ের পরিস্থিতি থেকে বোঝা যাচ্ছে, আরাকান আর্মি ও রাষ্ট্রীয় বাহিনী ‘তাতমা-দো’র মধ্যে এ দুর্যোগ মোকাবিলায় আগে থেকেই সমন্বয় ছিল না এবং এখনো নেই। বিশেষ করে আরাকান আর্মি নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোতে সামরিক বাহিনী সরকারি কোনো সাহায্য পৌঁছাতে দেয় না। ফলে সেখানকার দুর্গতরা খুব বিপদে পড়েছেন। এর মধ্যে আরাকান আর্মির প্রধান বাংলাদেশের কাছে ব্যক্তিগতভাবে সাহায্যের আবেদন জানান। এটা ছিল বেশ নাটকীয় একটা ঘটনা। তবে বাংলাদেশের পক্ষে অপর দেশের একটা গেরিলা দলের মানবিক সহায়তার আবেদনে প্রকাশ্যে সাড়া দেওয়ায় সমস্যা ছিল।

তবে সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনায় বাংলাদেশ সরকার ৫ থেকে ৮ জুনের ভেতর চট্টগ্রাম থেকে ইয়াঙ্গুন নৌপথে প্রায় ১২০ টন সাহায্য-পণ্যের একটা চালান মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে হস্তান্তর করেছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের সমন্বয়ে এ সাহায্য যায় মিয়ানমারে।

বাংলাদেশের প্রশংসনীয় উদ্যোগের সুফল পাচ্ছেন না আরাকানের মানুষ

বাংলাদেশ যে আরাকানসহ মিয়ানমারের দুর্যোগকবলিত পরিবারের জন্য দ্রুত সহায়তা পাঠিয়েছে, এটা রেঙ্গুন ও নেপিডোতে কূটনীতিকদের মধ্যে প্রশংসিত হয়। ত্রাণসামগ্রীর মধ্যে ছিল বিভিন্ন ধরনের শুকনা খাবার, তাঁবু, ওষুধ ও পানি বিশুদ্ধ করার বড়ি। যেহেতু ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত লেগেছিল মূলত আরাকান অঞ্চলে, সে কারণে সেখানকার মানুষ বাংলাদেশের সাহায্য পাঠানোর সংবাদে উৎসাহবোধ করে এবং বাংলাদেশও সাধারণভাবে আশা করেছিল, আরাকানের দুর্গত এলাকাগুলোতেই মূলত এ সহায়তা বিতরণ করা হবে। কিন্তু বাস্তবে সে রকম ঘটেছে সামান্যই। যদিও জান্তা সরকারের তরফ থেকে সাহায্য বিতরণের কিছু ছবি নিয়মিতই প্রকাশ করা হচ্ছে।

আরাকানের নাগরিকেরা বলছেন, তাঁরা বাংলাদেশ থেকে আসা সহায়তার সামান্যই পেয়েছেন। কেন্দ্রীয় সরকার এই মানবিক সহায়তাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। তারা চাইছে, আরাকান আর্মি তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকা ছেড়ে চলে যাক, তাহলেই কেবল স্থানীয় রাখাইন ও রোহিঙ্গাদের সহায়তা দেওয়া হবে। এমনকি বেসরকারি সংগঠকগুলো সহায়তার ক্ষেত্রেও আর্মি অতি ধীরে চলো নীতিতে সাহায্য বিতরণের অনুমতি দিচ্ছে। এ রকম অবস্থা তৈরির মাধ্যমে তারা দুর্ভোগ প্রলম্বিত করে মাঠপর্যায়ে আরাকান আর্মির উপস্থিতিকে মানুষের কাছে বিরক্তিকর করে তুলতে চাইছে।

কেবল বাংলাদেশের সহায়তা নয়, ভারতসহ অন্যান্য দেশ থেকে আসা সহায়তা বিতরণের বেলায়ও মিয়ানমারের সামরিক সরকার একই কৌশল অবলম্বন করছে। জান্তা সরকারের এই কৌশল আরাকানের রোহিঙ্গা ও রাখাইন উভয় সম্প্রদায়ের জন্য বেশ বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। আরাকান আর্মির একার পক্ষে এখানকার বিশাল এলাকায় অবকাঠামো পুনর্গঠন প্রায় অসম্ভব। এ নিয়ে স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলোতে কড়া সেন্সরশিপ ফাঁকি দিয়েও কিছু লেখাজোখা হচ্ছে। যেমন ২০ জুন আকিয়াবভিত্তিক ‘বর্ডার নিউজ এজেন্সি’ নামের সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে, বাংলাদেশ ছাড়াও থাইল্যান্ডসহ আসিয়ানভুক্ত অনেক দেশ থেকে কিছু সাহায্য এলেও আরাকানের মানুষ শুকনা নুডলস ও কিছু চাল মাত্র বিতরণ হতে দেখেছে। এ রকম সাহায্যপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের সংখ্যা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের ১২ থেকে ১৫ শতাংশ মাত্র হবে। আরাকান আর্মির একটি সূত্র এ লেখককে বলেছে, তাঁদের প্রত্যাশা ছিল, বাংলাদেশের জনগণ কোনো না কোনো উপায়ে তাঁদের ইতিহাসের সবচেয়ে দুর্যোগময় এ সময়ে মানবিক সহায়তা পৌঁছাবে। কিন্তু কার্যত বাংলাদেশের জনগণের সেই সহায়তা পৌঁছাল সামরিক জান্তার হাতে।

  • আলতাফ পারভেজ লেখক ও গবেষক