Thank you for trying Sticky AMP!!

তাসের জোকার ‘হিরো’ ও এলিট রুচির দুর্দিন

২০২০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত হিরো আলম প্রযোজিত এবং অভিনীত ‘সাহসী হিরো আলম’ ছবির পোস্টার

হিরো আলম হলো তাসের প্যাকেটের সেই এক্সট্রা জোকার। কোনো তাস হারিয়ে গেলে জোকারের কার্ডকে সেই তাসের রোল দিয়ে খেলা চালিয়ে নেওয়া হয়। আমাদের রাজা-রানি খেলায় একটা কার্ড হারিয়ে গেছে। সেই কার্ড বা সেই হারানো চরিত্র হলো ‘হিরো’। খেলা জারি রাখতে আমাদের একজন হিরো লাগবে। হিরো আলম হলো সেই জোকার। রিয়েল হিরো নাই বলে তাঁকে আমরা হিরোর রোল দিয়েছি। কিন্তু রুচির এলিটরা তা মানতে চায় না।

চার্লি চ্যাপলিনের সিনেমাগুলোতে আমরা কী দেখি? একটা ভাগ্যসন্ধানী বোকা লোককে সহ্য করতে পারছে না অভিজাতেরা। কুটিল-জটিল জগতে সরলেরা তো উপদ্রবই বটে। আর ত্যাঁদোড় চ্যাপলিনও তাঁর বোকামি-গাধামি দিয়ে বড়লোকি মজমা ভন্ডুল করে দিচ্ছেন। তাঁকে তারা বড় রেস্টুরেন্ট থেকে বের করে দিচ্ছে। অপমান করছে যত্রতত্র। চ্যাপলিনকে সবচেয়ে তাড়া করত কে? পুলিশ। অভিজাতদের পুলিশ চ্যাপলিনের পেছনে ছুটছে, আর বেচারা তাঁর বেঢপ জামা-কাপড়-জুতা নিয়ে দৌড়াচ্ছেন। আমাদের হিরো আলমও এ রকম এক ধাওয়া খাওয়া চরিত্র। তিনি তাঁর বোকামি দিয়ে এলিটদের দুধ-ভাতে উৎপাত ঘটিয়ে চলছেন। বেসুরো গাইছেন না শুধু, ভোটকেন্দ্রে গিয়ে প্রতিবাদ করে গলাধাক্কাও খেয়েছেন। অন্য অনেকেই গোপনে মুচলেকা দিয়ে এসে চুপ হয়ে গেলেও হিরো আলম তাঁর সঙ্গে কী করা হয়েছে, তা সাহস করে বলেছেন। এখানেই হিরো আলম সত্যিকার হিরো।

Also Read: হিরো আলমের রবীন্দ্রসঙ্গীত এবং আমাদের সাংস্কৃতিক রুচির সংজ্ঞা

চ্যাপলিন তাঁর অসাধারণ অভিনয়ের গুণে যে মামুলি মানুষদের জীবনকে ফুটিয়ে তোলেন, হিরো আলম নিজে সেই জীবনেরই লোক। তাঁকে তাই আলাদা করে অভিনয় করতে হয় না। তিনি যা–ই করেন, তা–ই ট্র্যাজি-কমিক। তাঁর বিখ্যাত হওয়ার চেষ্টা, মধ্যবিত্ত জীবনে ওঠার কসরত, মিডিয়া সিনে যেভাবে পারে, সেভাবে হাজির থাকার আইডিয়ার মধ্যে করুণ এক জীবন-সংগ্রাম আছে। আবার একই সঙ্গে উচ্চ সমাজের হাসির খোরাক জোগাতে জোগাতে তিনি হয়ে পড়েন বায়ান্নটি জরুরি তাসের বাইরের একটা এক্সট্রা তাস, একটা কমিক–চরিত্র। তা সত্ত্বেও যে আত্মবিশ্বাস আর সারল্য নিয়ে হিরো আলম কথা বলেন, সেটা কিন্তু বিরল।

নিজেকে বিশ্বাস করার কথা কি আমরাই বলিনি তাঁর মতো তরুণদের? বলিনি যে সেলিব্রিটি হওয়ার কত মজা? যা পারো একা একা, সেটা করার নামই সফলতা। বলেনি কি মোটিভেশনাল স্পিকারেরা? তাহলে, এ রকম একটা চরিত্রকে কেন ডিবি পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে? আর রবীন্দ্রসংগীত না গাওয়ার মুচলেকা দিতে হবে তাঁকে?

তাঁর নাম বদলানোর শাসানি খেতে হবে? কারণ, হিরো আলম মধ্যবিত্ত নয়, তাই শিল্পীর সামান্য সম্মানও তাঁকে দেওয়া হবে না। মূলধারার কোনো সেলিব্রিটি শিল্পীর সঙ্গে এমন করলে নাটকপাড়া, মিডিয়ামহল্লা, বিবেকপুর হই হই করে উঠত না? আমাদের মনে থাকতে পারে, ঠিক এভাবেই সমাজের পতি ও মাতবরেরা বাউল-ফকির এবং লোককবিদের চুল-দাড়ি কেটে দিতেন, এলাকা ছাড়া করতেন, তাদের গানের আসর ভেঙে দিতেন। বিখ্যাত ‘যদি থাকে নসিবে’ গানের স্রষ্টা চিশতি বাউলের সঙ্গেও এমনটা করা হয়েছিল। রেডিমেড প্রতিবাদীদের অনেকে তখন চুপ ছিলেন। ঠিক একইভাবে সংস্কৃতির পাহারাদারির নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে কাওয়ালি গাওয়ার অনুষ্ঠানে হামলা করা হয়েছিল।

যাঁরা বাক্‌স্বাধীনতার প্রয়োগ কেবল সংখ্যাগুরুর ধর্ম বা সংখ্যালঘুর দেব-দেবীর বেলায় করে থাকেন, নন-এলিট শিল্পীর বাক্স্বাধীনতা রক্ষার বেলায় তাঁরা কেন উদাসীন?
অর্থাৎ দেশে যেমন রাজনীতি শাসনকারী শক্তি রয়েছে, রয়েছে তাদের শর্তে রাজনীতি করার বাধ্যবাধকতা। তেমনি আছে সংস্কৃতি ও রুচিরও শাসন। ধর্মের নামে হোক অথবা রাবীন্দ্রিক প্রতিষ্ঠানের নামে হোক, এই ক্ষমতা ও রুচির বাইরে আর কিছুই চলবে না। এই উচ্চ মধ্যবিত্তের হাতে আর কিছু না থাকলেও রুচি শাসনের ক্ষমতা আছে। তারা যে গান, বই, সিনেমা বা ব্যক্তিত্বকে ভালো বলবে, সুন্দর বলবে, সেটাই ভালো ও সুন্দর। কিন্তু ডিজিটাল মিডিয়ার যুগে এই বনেদিয়ানার দাপট আর চলতে পারছে না।

Also Read: ...স্পন্দিত বুকে মনে হয় আমিই হিরো আলম

এই গল্পের শেষ কোথায় আমরা জানি না, তবে ট্র্যাজি–কমিক হিরো আলম সংস্কৃতির এই এলিটীয় পবিত্রকরণের খায়েশের গুড়ে বালি মিশিয়ে দিতে পেরেছেন। যে উচ্চমধ্যবিত্তীয় রুচি হিরো আলমকে তাঁর অন্যান্য পরিবেশনায় ধরতে পারেনি, রবীন্দ্রসংগীতের আংটা দিয়ে তারা তাঁকে ধরে ফেলে কী বেজায় খুশি?

ফেসবুক-টিকটক-ইউটিউবের যুগে সংস্কৃতি ও বিনোদনকে আর ভারী বাটখারায় মাপাও যাচ্ছে না, সেসবকে দমানোও যাচ্ছে না। যে এলিটেরা আর জনতার প্রতিনিধিত্ব করে না, জনতা বিশেষ করে তরুণেরা কি তাদের বকাবকি শুনবে? সংস্কৃতির ময়দানে এলিট মহলের এই পরাজয়েরই প্রমাণ পুলিশ দিয়ে গান থামানোর চেষ্টায়। অর্থাৎ, তাদের নিষেধ ও তুচ্ছতাচ্ছিল্য পাত্তা পাচ্ছে না বলেই পুলিশ ডাকতে হচ্ছে। এবং ভারি মজাদার ঘটনা হলো, হিরো আলমের হেনস্তার পেছনে এক পদচ্যুত মন্ত্রীরও অভিযোগ ছিল। যিনি কিনা নৈতিক অসদাচরণের জন্য ধিক্কৃত, বিকৃত রুচির জন্য ঘৃণিত, তিনিও রবীন্দ্রনাথের গানের পবিত্রতা রক্ষার সৈনিক?

আরও ভয়াবহ হলো, পুলিশকে ‘সংস্কৃতিমাপকযন্ত্র’ বানানো। এর আগে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে মামলা কার বিরুদ্ধে করা হবে বা হবে না, সেটা ঠিক করার ভার তাঁদের দেওয়া হয়েছিল। গান, কবিতা, ক্লাস লেকচার কিংবা যেকোনো লিখিত বা উচ্চারিত কথার মধ্যে ওই আইনে বর্ণিত অপরাধ ঘটেছে কি না, তা পুলিশ কীভাবে জানবে? তারা আইনবিশারদও নয়, সর্ববিদ্যার পণ্ডিতও নয়। হিরো আলমের বেলায় পুলিশের এই বে-এখতিয়ার আর দমনমূলক আইনের ব্যাখ্যাকারী হিসেবে তাদের অবস্থান এটাই বোঝায় যে এখানে সমাজ নেই, স্বাধীনতা নেই, সৃষ্টির আনন্দ নেই, কেবল নিষেধাজ্ঞা আছে।

আশরাফুল আলম ওরফে হিরো আলম

এ রকম নিষিদ্ধতাবাদী দেশে সবকিছুই ধর্ম হয়ে উঠতে চায়। অনেকের কাছে রবীন্দ্রনাথ, তাঁর গান ইত্যাদিও ধর্মের মতো পবিত্র। রাষ্ট্রনায়কও মহাপুরুষ, কবিও মহাপুরুষ, গানও পবিত্র বাণী! যা ঈশ্বরপ্রেরিত নয়, তাকে ধর্মের মর্যাদা দেওয়া ধর্মেরও অপমান, ওই বিষয়েরও তা ভুল এক ব্যাখ্যান। সে কারণেই বলতে হয়, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন ব্লাসফেমি আইনের চেয়ে কম কিসে। একসময় জামায়াতে ইসলামী প্রস্তাবিত ব্লাসফেমি আইনে কেবল ধর্মের কথা বলা হয়েছিল। আমরা তার প্রতিবাদ করেছি। এখন ডিএসএ-তে একটি পক্ষের সবকিছুকে এমনকি সরকারের কর্তাব্যক্তি ও মন্ত্রী আমলাদেরও ওই রকম পবিত্র মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। যেমন রবীন্দ্রনাথের গানকেও ভাবানো হচ্ছে পবিত্র বাণী বলে!

এই গল্পের শেষ কোথায় আমরা জানি না, তবে ট্র্যাজি–কমিক হিরো আলম সংস্কৃতির এই এলিটীয় পবিত্রকরণের খায়েশের গুড়ে বালি মিশিয়ে দিতে পেরেছেন। যে উচ্চমধ্যবিত্তীয় রুচি হিরো আলমকে তাঁর অন্যান্য পরিবেশনায় ধরতে পারেনি, রবীন্দ্রসংগীতের আংটা দিয়ে তারা তাঁকে ধরে ফেলে কী বেজায় খুশি? তবে মিনিং-জেনারেটিং পাওয়ার বা সংস্কৃতির অর্থ ও মান নির্ধারণের ওই ক্ষমতা যে তাদের আর নেই, তাদের কোনো প্রতিষ্ঠানের নেই, হিরো আলম কাণ্ডে সেটা কিন্তু সবাই জেনে গেল। রুচির জোর থাকলে কি আর পুলিশ ডাকতে হতো?

ফারুক ওয়াসিফ, লেখক ও প্রতিচিন্তার নির্বাহী সম্পাদক।
faruk.wasif@prothomalo.com