Thank you for trying Sticky AMP!!

সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার

ইউক্রেনে রাশিয়া জিতলে কী হবে, যে উত্তর দেননি কিসিঞ্জার

সম্প্রতি ৯৯ বছর বয়সী যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার জার্মানির শীর্ষ সাপ্তাহিক ডের স্পিগেলকে ইউক্রেন যুদ্ধ ও এর পরিণতি নিয়ে দীর্ঘ কিন্তু সতর্ক সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। এই সাক্ষাৎকারে কিসিঞ্জার গত মে মাসে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামে ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে শান্তি প্রক্রিয়া শুরুর জন্য রাশিয়ার স্থিতাবস্থা রক্ষা করার যে তত্ত্ব দিয়েছিলেন, তাঁর স্বপক্ষে কথা বলেছেন। কিন্তু স্থিতাবস্থার জন্য ইউক্রেনের যতটুকু ভূমি রাশিয়ার কাছে ছেড়ে দেওয়ার কথা, সে সময় কিসিঞ্জার বলেছিলেন, তার চেয়ে বেশি এলাকা এখন মস্কো দখলে নিয়েছে। সমগ্র দনবাস অঞ্চল, যেটি ইউক্রেনের মোট ভূমির চার ভাগের একভাগ এবং দেশটির শিল্পসামর্থ্যের চার ভাগের তিন ভাগই, জয় করার পর্যায়ে পৌঁছে গেছে রাশিয়া। এখন যদি ২৪ ফেব্রুয়ারি যুদ্ধ শুরুর আগে রাশিয়ার যে যে সীমান্ত, সেখানে তাদের সৈন্যদের ফিরিয়ে নিয়ে না যায়, তাহলে কী ঘটবে? এ বিষয়ে ডের স্পিগেল কোনো প্রশ্ন করেনি, কিসিঞ্জারও সরাসরি উত্তর দেননি।

গত ১৪ এপ্রিল রাশিয়ার গণমাধ্যমে সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট আলেকসান্দার ভুসিকের বক্তব্য ধরে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ভুসিক বলেছেন, ‘আমরা জানি আমাদের জন্য কী অপেক্ষা করে আছে। দনবাস অঞ্চলের শহরগুলো জয় করার পর ভ্লাদিমির পুতিন আমাদের কাছে একটি প্রস্তাব নিয়ে আসবেন। তারা (পশ্চিম) যদি সেই প্রস্তাব গ্রহণ না করে, সেটা তারা (পশ্চিমা) করবেও না, সে ক্ষেত্রে বিশ্ব একটা নরকে পরিণত হবে।’ ডের স্পিগেল পত্রিকাটি ভুসিকের এই সতর্কবার্তা নিয়ে কিসিঞ্জারকে প্রশ্ন করেছে।

এর উত্তরে কিসিঞ্জার ১৬১৮-১৬৪৮ সালের ৩০ বছরব্যাপী যুদ্ধের প্রসঙ্গ তোলেন। সেই যুদ্ধে মধ্য ইউরোপের পাঁচ ভাগের দুই ভাগ জনগোষ্ঠী নিহত হয়েছিল। তিনি সতর্ক করে দেন, যদি যুদ্ধ চলতেই থাকে, তাহলে রাশিয়া আর খুব বেশি দিন ইউরোপের ইতিহাসের অংশ থাকবে না। এরপর কিসিঞ্জার বলেন, ‘আমি সেই ধারণার সঙ্গে একমত নই যে পুতিন ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত পতনের সময় মস্কো যে ভূমি হারিয়েছিল, তার সবটাই পুনরুদ্ধার করতে চান। কিন্তু তিনি এই বাস্তবতাটাও মেনে নিতে পারেন না যে বার্লিন ও রাশিয়ার মধ্যবর্তী পুরো ভূমিই ন্যাটোর হাতে চলে যাবে। এ কারণেই ইউক্রেন পুতিনের জন্য আঠার মতো লেগে থাকা একটা বিষয়।’

কিসিঞ্জারের শেষ উত্তর ছিল, ‘এর মানে যদি হয়, ইউক্রেন যুদ্ধকে ক্রমাগত রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরিণত করা এবং একই সঙ্গে চীনের সঙ্গে বৈরিতা বজায় রাখা, তাহলে সেটা খুব বোকামি হবে। রাশিয়ার আগ্রাসন থামাতে এবং রাশিয়া ও ইউক্রেনের সীমানা যুদ্ধ–পূর্ববর্তী অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার জন্য আমেরিকা ও ন্যাটোর প্রচেষ্টাকে আমি সমর্থন করি...’

স্পিগেলের পক্ষ থেকে কিসিঞ্জারকে প্রশ্ন করা হয়, ‘আপনি নতুন একটি বই লিখেছেন। প্রথম অধ্যায়টি সাবেক জার্মান চ্যান্সেলর কোনরার্ড আডেনিয়রকে নিয়ে। আপনি লিখেছেন তাঁর নীতি ছিল, জার্মানি যে ভাগ হয়েছে, সেটা সাময়িক। ইউক্রেন যুদ্ধ সমাপ্তির যে প্রস্তাব আপনি দিয়েছেন, সেটা কি সেই নীতি থেকেই এসেছে? ইউক্রেন নিজেদের ভূখণ্ডের সাময়িক বিভাজনটি মেনে নিক। একটি অংশকে পশ্চিমাপন্থী গণতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশ হিসেবে গড়ে তুলুক। অপর অংশ থিতু হওয়া এবং ইউক্রেনের সঙ্গে আবার যুক্ত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করুক।’

কিসিঞ্জার প্রশ্নটিকে এড়িয়ে যান। তিনি বলেন, ‘আমি যেটা বলেছি, সেটার মানে ভিন্ন। আমি বলেছি, স্থিতাবস্থা হতে পারে সবচেয়ে ভালো বিভাজক রেখা। রাশিয়া-ইউক্রেন সীমান্তকে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে, আগ্রাসনকে ব্যর্থ করে দেওয়া। সুতরাং এটা ২৪ ফেব্রুয়ারির যে সীমানা, তার ওপর ভিত্তি করে করা যুদ্ধবিরতি। সে সময় রাশিয়া ইউক্রেনের দনবাস ও ক্রিমিয়া উপদ্বীপে ইউক্রেনের আড়াই শতাংশ ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণ করছিল।’

হেনরি কিসিঞ্জার ও ভ্লাদিমির পুতিন

স্পিগেল পত্রিকা এবার কিসিঞ্জারকে চেপে ধরল, ‘আপনি বলেছেন ২৪ ফেব্রুয়ারির সীমানারেখায় রাশিয়া যদি তাদের সেনাদের ফিরিয়ে নিয়ে যায় এবং তারপরও যদি যুদ্ধ অব্যাহত থাকে, তাহলে সেটা আর ইউক্রেনের স্বাধীনতার বিষয় থাকবে না, সেটা হবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ।’ কিসিঞ্জার কৌশলে এ প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যান। তিনি উত্তর দেন, ‘আমি কখনো বলিনি ইউক্রেনের উচিত নিজেদের ভূখণ্ড রাশিয়ার হাতে ছেড়ে দিক।’

স্পিগেল–এর পক্ষ থেকে কিসিঞ্জারকে প্রশ্ন করা হয়, ‘আপনি কি মনে করেন, গণতন্ত্র ফেরি করা পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য হওয়া উচিত?’ উত্তরে কিসিঞ্জার বলেন, ‘আমার কাছে গণতন্ত্র খুবই কাম্য একটি ব্যবস্থা। কিন্তু বর্তমান বিশ্বে গণতন্ত্র প্রচারকে যদি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক লক্ষ্য করা হয়, তাহলে সেটা ধর্মপ্রচারের মতোই একটা ব্যাপার। এটা বিশ্বে ৩০ বছরব্যাপী যুদ্ধের মতো আরেকটি সামরিক সংঘাত ডেকে আনতে পারে। ঘটনাক্রমে, চীন যখন উদ্বেগ জানায়, তখন বাইডেন প্রশাসন ঠিকই বিবৃতি দেয়, সেখানে ব্যবস্থার পরিবর্তন আনতে পারে সে রকম কোনো সরকার প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা তাদের নেই। সুতরাং, বাইডেন এমন সব সমস্যার মুখে পড়েছেন, যেগুলোর মুখোমুখি সব বড় শক্তির নেতাদেরই হতে হয়। ইউক্রেন সংঘাতকে ইউরোপ কোন চোখে দেখছে, সেটা বিবেচনা করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রনায়কদের একই সঙ্গে তিনটি বিষয়কে বিবেচনায় নিতে হচ্ছে—ক্ষমতার ভারসাম্যের ঐতিহাসিক গুরুত্ব, নতুন উচ্চপ্রযুক্তির গুরুত্ব এবং মৌলিক মূল্যবোধের সুরক্ষা। এটা নতুন চ্যালেঞ্জ।’

স্পিগেল–এর প্রশ্নকর্তা আরও প্রশ্ন করে, ‘প্রেসিডেন্ট বাইডেন যে বলেছেন, প্রেসিডেন্ট পুতিন আর ক্ষমতায় থাকতে পারেন না, এটাকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন?’ কিসিঞ্জারের উত্তর ছিল, এটা মোটেই বুদ্ধিমানের মতো কথা নয়। প্রসঙ্গ পাল্টে স্পিগেল পত্রিকা চীনের বিষয়ে প্রশ্ন করে, ‘তাইওয়ান প্রশ্ন নিজেদের পক্ষে সমাধান করার জন্য কোনো পদক্ষেপ যদি চীন নেয়, তাহলে সেটা ইউক্রেন যুদ্ধের তীব্রতা বাড়াতে না কমাতে ভূমিকা পালন করবে?’

কিসিঞ্জারের উত্তর ছিল, ‘এর কোনোটাই নয়। পুতিন স্পষ্টত তাঁর প্রতিপক্ষের প্রতিরোধক্ষমতা সম্পর্কে ভুল ধারণা করেছেন। কিন্তু চীন যদি মনে করে, তাইওয়ান প্রশ্নের শান্তিপূর্ণ সমাধান আর সম্ভব হবে না, সঙ্গে সঙ্গে তারা তাইওয়ানের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক শক্তি নিয়োগ করবে। তবে আমি মনে করি না, চীন এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে।’ স্পিগেলের পক্ষ থেকে আবার প্রশ্ন করা হয়, ‘চীন যদি একদিন এই উপসংহারে এসে পৌঁছায় যে ইউক্রেন ঘিরে যে পরিস্থিতি, সেই একই পরিস্থিতির মুখে তারাও পড়তে পারে?’

হেনরি কিসিঞ্জার ও সি চিন পিং

কিসিঞ্জার উত্তর দেন, ইউক্রেন সংঘাতের বিশেষত্ব হলো, দুটি পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিপক্ষ তৃতীয় একটি ভূমিতে প্রথাগত যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে। অন্যদিকে তাইওয়ানে হামলার ঘটনা ঘটলে সেটা চীন ও যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি যুদ্ধে টেনে নিয়ে আসবে।

স্পিগেল–এর শেষ প্রশ্নটি ছিল, ‘ইউক্রেন যুদ্ধের আগে একটা আলোচনা বেশ চাউর হয়েছিল। সেটা হলো, প্রতিদ্বন্দ্বী চীনকে চাপে ফেলার জন্য যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করতে চায়। এখনকার প্রশ্ন হলো, রাশিয়ার হুমকি মোকাবিলার জন্য ওয়াশিংটন কি বেইজিংয়ের সঙ্গে উত্তেজনা কমাতে চায়? ৫০ বছর আগে আপনি ও নিক্সন যেটা করছিলেন! আপনি কি মনে করেন, একই সঙ্গে দুটি বৃহৎ প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করার ক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে?’

Also Read: ইউক্রেন যুদ্ধ যে কারণে শীত পর্যন্ত টেনে নিতে চান পুতিন

কিসিঞ্জারের শেষ উত্তর ছিল, ‘এর মানে যদি হয়, ইউক্রেন যুদ্ধকে ক্রমাগত রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরিণত করা এবং একই সঙ্গে চীনের সঙ্গে বৈরিতা বজায় রাখা, তাহলে সেটা খুব বোকামি হবে। রাশিয়ার আগ্রাসন থামাতে এবং রাশিয়া ও ইউক্রেনের সীমানা যুদ্ধ–পূর্ববর্তী অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার জন্য আমেরিকা ও ন্যাটোর প্রচেষ্টাকে আমি সমর্থন করি। আমি বুঝতে পারি, ইউক্রেনের দাবি আরও বেশি। এ সমস্যাকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভিত্তিতে সমাধান করতে হবে। কিন্তু এ প্রচেষ্টা সফল হলেও ইউরোপের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক কী হবে, সেটা পুনর্মূল্যায়ন করার প্রয়োজন হবে। সেটা হলো রাশিয়া কি ইউরোপের মানচিত্রের অংশ থাকবে, নাকি ভিন্ন মানচিত্রের অংশ হিসেবে চিরস্থায়ী প্রতিপক্ষ হবে!’

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে

ডেভিড পি গোল্ডম্যান আমেরিকান অর্থনীতিবিদ