Thank you for trying Sticky AMP!!

তিশা–মুশতাক বিতর্ক, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও নীতি পুলিশিং

ষাটোর্ধ্ব খন্দকার মুশতাক আহমেদ তাঁর স্ত্রী তিশাকে নিয়ে মেলা প্রাঙ্গণ ছেড়ে রীতিমতো দৌড়ে পালাচ্ছেন। পেছনে শত শত কিশোর-তরুণ, তাঁদের গলায় স্লোগান, ‘করছে কি ভাই, লজ্জা! কামডা কি ভাই, লজ্জা। ১৮-৬৫ লজ্জা। কেমনে মিলে? লজ্জা! ভাইরে ভাই, লজ্জা। সারা দেশের লজ্জা। বিশ্ববাসীর লজ্জা। জবাব দাও!’

অসম বিয়ের জন্য আলোচিত এই দম্পতিকে ধাওয়া দিয়ে মেলা ছাড়া করার পর কে যে এবার নিশানায় কে জানে। বস্তুত এবারের বইমেলায় ‘তিশার ভালোবাসা’ নিয়ে এই দম্পতি যেমন আলোচনার কেন্দ্রে আছেন, তেমনি ‘বন্দিনী’ নিয়ে আলোচনায় আছেন ডাক্তার সাবরিনা। চিকিৎসক হয়ে করোনা সার্টিফিকেট জালিয়াতি করে নিজেকে মহান চরিত্র হিসেবে উপস্থাপন করা নিয়ে ফেসবুকজুড়ে বিস্তর সমালোচনা চলছে।

এই আলোচনা-সমালোচনা স্বাভাবিক। সন্দেহ নেই, অভিভাবক প্রতিনিধি হিসেবে খন্দকার মুশতাক আহমেদের একজন ছাত্রীকে বিয়ে করার ঘটনা এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁদের উপর্যুপরি সাক্ষাৎকার ও উপস্থিতি অভিভাবকদের মনে অস্বস্তি ও উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে।

Also Read: দোষ কি প্রিন্স মামুন ও লায়লার, না আমাদের কপালের?

এ ধরনের ঘটনায় মেয়ের মা-বাবাদের উৎকণ্ঠা অমূলক নয়। এই তো দিন কয়েক আগে খুব সরল ভাষায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক বাবাকে দেখলাম তাঁর উদ্বেগের কথা জানাতে। তিনি বলছিলেন, তাঁর মেয়েসন্তানটি স্কুলে গিয়ে এমন তথাকথিত অভিভাবকের খপ্পরে পড়ে কি না সেই চিন্তা তাঁকে গ্রাস করছে।

হাইকোর্টও খন্দকার মুশতাক আহমেদকে উদ্দেশ করে বলেছেন, ‘আপনি নৈতিকভাবে কাজটি ঠিক করেননি।’ আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের দাতাসদস্য খন্দকার মুশতাক আহমেদকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরে যাওয়ার ওপরও নিষেধাজ্ঞা দেন আদালত। এমন ঘটনা সমাজের ভারসাম্য নষ্ট করে।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কে বই লিখবেন, কী লিখবেন, মেলায় কে আসবেন, কীভাবে বই বিক্রি করবেন জবাব চাইবার আপনি-আমি কে? বড়জোর আমরা আলোচনা-সমালোচনা করতে পারি। তাই বলে মিছিল-স্লোগান দিয়ে ধাওয়া করা? বইমেলায় নাকি পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা আছে! সত্যি? ভ্রম হয়।

মুশতাক-তিশাকে ধাওয়া দিয়ে যখন মেলা থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে অসংখ্য ক্যামেরার সামনে, হাতে হাতে মুঠোফোন, সেই মুঠোফোনে অনেকেই ভিডিও ধারণ করেছেন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করেছেন। তার নিচে হাজারো মন্তব্য।

এ সময় এক মেয়েবন্ধু ছিল তাঁর সঙ্গে। ছেলেটি পাঁচ দিন নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন থেকে সম্প্রতি ছাড়া পেয়েছে। চোখটা পুরো সারেনি এখনো। ছাত্রীর আতঙ্ক কখনো কাটবে কি না, জানি না। একটি অডিও রেকর্ডে কাঁপা কাঁপা গলায় তাঁকে বলতে শোনা যায়, ‘আমার গায়ে ওরা হাত দিচ্ছে। আর বলছে ওই লোকগুলা না থাকলে তোমাকেও রেপ করতাম। একটা গাছের ডাল দিয়ে এত জোরে আমাকে মেরেছে...।’

মোটের ওপর সব মন্তব্যই ধাওয়াকারীকের পক্ষে। যার সার কথা হলো বাংলার তরুণেরা জেগে উঠেছে। এর বাইরেও অবশ্য দু-একটি মন্তব্য আছে। যেখানে কেউ কেউ বলেছেন, বিবাহিত দম্পতি এমন করতেই পারেন। তাঁদের ধাওয়া দেওয়া ঠিক হয়নি। মানে বিবাহিত না হলে ধাওয়া দেওয়ায় ক্ষতি নেই? দেওয়াই যায়। তাই তো? বাহ। আবার কেউ কেউ ‘নীতি পুলিশিং’–এর সমালোচনা করেছেন।

মোটাদাগে পুরো ঘটনায় দুটো গুরুতর বিষয় আলোচনা আছে। এক. মতপ্রকাশের অধিকার এবং দুই. নীতি পুলিশিং।

যেমন জাহিদ হোসেইন নামের একজন মন্তব্য করেছেন, ‘একুশের বইমেলা যদি একটা শরীর হয়, তাহলে এর আত্মা হলো মতপ্রকাশ। মতপ্রকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হলে বইমেলার গলার হার, কানের দুল, ফুল, বেলুন মূর্খ আর ছাপানো কাগজ ছাড়া আর কিছু থাকবে না। নীতি পুলিশ আর নৈতিকতার দফাদারদের হাতে বইমেলা ছেড়ে দিলে বাঙালির শক্তির জায়গা নড়বড়ে হয়ে যায়।’

এই মন্তব্যের নিচে তিনি নৈতিকতার দফাদারি কেমন তার একটা উদাহরণ দিয়েছেন। ঘটনাটি ২০২২ সালের। যদিও এমন দফাদারি আমরা আজকাল হরদম দেখছি।

Also Read: ফুড আপ্পি নিয়ে কেন এত মাতামাতি

জাহিদ নরসিংদীর পলাশে ঘটে যাওয়া একটি খবরের লিংক দিয়েছেন। স্বামী-স্ত্রী বেড়াতে বের হয়েছিলেন। বখাটেরা তাঁরা স্বামী-স্ত্রী কি না চ্যালেঞ্জ করে বসে। তারপর স্বামীকে মারধর করে গৃহবধূকে তাঁরা পালাক্রমে ধর্ষণ করে।

তবে অত দূরে যাওয়ার দরকার নেই। বইমেলা যেখানে চলছে, সেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই গত বছরের ৮ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রলয় গ্যাংয়ের ছেলেরা নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মীর আলভী আরসালানকে বেদম পেটায়।

এ সময় এক মেয়েবন্ধু ছিল তাঁর সঙ্গে। ছেলেটি পাঁচ দিন নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন থেকে সম্প্রতি ছাড়া পেয়েছে। চোখটা পুরো সারেনি এখনো। ছাত্রীর আতঙ্ক কখনো কাটবে কি না, জানি না। একটি অডিও রেকর্ডে কাঁপা কাঁপা গলায় তাঁকে বলতে শোনা যায়, ‘আমার গায়ে ওরা হাত দিচ্ছে। আর বলছে ওই লোকগুলা না থাকলে তোমাকেও রেপ করতাম। একটা গাছের ডাল দিয়ে এত জোরে আমাকে মেরেছে...।’

আলভী প্রথম আলোকে বলেন, পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর গিটার বাজানোর কথা ছিল। তিনি তাঁর বন্ধুকে নিয়ে অপর বন্ধুদের অপেক্ষায় ছিলেন। আচমকা একদল ছেলে এসে তাঁর কাছে পরিচয় জানতে চায়। তাদের কথা হলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ছেলে তার মেয়ে বন্ধুকে নিয়ে বসতে পারবে না। এই অপরাধে ওরা শুধু ওকে পিটিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, আটকে রেখে পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায়ের চেষ্টা করে।

হামলাকারীদের সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, যাদের নাকি আবার গৌরবোজ্জ্বল অতীত আছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও চিকিৎসক রেহেনা আক্তার আলভীর মা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি শুধু চাই, আর কারও সন্তান যেন এ ধরনের হামলার শিকার না হয়। আলভীকে তিন ঘণ্টা ধরে পেটানো হয়, কিডনি বিকল হয়ে ও মরতে বসেছিল।’

এলোপাতাড়ি এমন মারধরেই বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবরার মারা যায়। আবরারের অপরাধ কী ছিল মনে আছে তো? বিবিসির করা একটি সংবাদের লিংক শেয়ার করে ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে একটি পোস্ট দেওয়া।

এমন ঘটনা কি চলতেই থাকবে? একদিকে সাংবিধানিক অধিকারের টুঁটি চেপে ধরা আইনকানুনের বাড়াবাড়ি, অন্যদিকে নীতি পুলিশিং। বাংলাদেশের মানুষ তো একরকম প্রেশার কুকারে আটকা পড়েছে। মানুষ যাবেটা কোথায়? বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ এ দেশের মানুষকে বাক্‌ ও ভাবপ্রকাশ এবং চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিয়েছে। এই সংবিধানেই বলা আছে, জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতা থেকে কোনো ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাবে না। তার স্বাধীনভাবে চলাচলের, সভা–সমাবেশের অধিকার আছে। সেই অধিকার হরণ করার আপনি-আমি কে?

Also Read: শরীফার গল্প: তর্ক–বির্তকে কেন আমি পক্ষে কেন বিপক্ষে

ভেবে দেখুন, এই বাংলার তরুণেরাই ১৯৫২ সালে স্লোগান তুলেছিলেন, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। তাঁরা কথা বলতে চেয়েছিলেন। আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর সেই কবিতা পড়েনি এমন মানুষ কম, ‘চিঠিটা তার পকেটে ছিল ছেঁড়া আর/রক্তে ভেজা।/মাগো, ওরা বলে সবার কথা কেড়ে নেবে।/তোমার কোলে শুয়ে গল্প শুনতে দেবে না।/বলো, মা, তাই কি হয়?’ আর এই যুগে আমাদের তরুণেরা তাঁদের পূর্বসূরিদের স্মরণে অনুষ্ঠিত বইমেলায় স্লোগান তুলছেন, তিশা-মুশতাক দম্পতিকে কথা বলতে দেওয়া যাবে না।

এ ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার কিন্তু সুযোগ নেই। কথা বলতে দিতে চাই না বলেই হুমায়ুন আজাদকে হত্যার চেষ্টা হয়েছিল ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি। একই কারণে ১১ বছর পর নিহত হন বিজ্ঞানমনস্ক লেখক অভিজিৎ রায় এবং তাঁর বন্ধু ও প্রকাশক ফয়সাল আরেফীন দীপন। ২০১৭ সালে বইমেলা প্রাঙ্গণ থেকে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ সন্দেহের বশে ১১ জনকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।

বইমেলার আগে সব বই পড়ে মেলায় প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হবে বলে পুলিশের চোখ রাঙানিও আমরা দেখে থাকি । শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় একাডেমিক স্বাধীনতা সংকুচিত হয়ে এসেছে। আমরা এখন আর কেউ কাউকে সহ্য করতে পারি না। আমাদের আসলে সর্বনাশ হয়ে গেছে।

  • শেখ সাবিহা আলম প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক