Thank you for trying Sticky AMP!!

সৌরবিদ্যুতে মিলবে সংকটের সার্বিক সমাধান

বিশ্ব পরিবেশ ও জ্বালানি-সংকটে সমূহ দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায় নবায়নযোগ্য উৎস। পৃথিবীর প্রতিটি দেশ এখন সেদিকেই ঝুঁকছে। বাংলাদেশও অন্তত ১০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনে এ পরিকল্পনা করেছিল, কিন্তু প্রভাবশালী তেল-গ্যাস লবির দৌরাত্ম্যে সে ক্ষেত্রে সাফল্য এসেছে সামান্যই। তবে ছোট একটা দেশে অকৃষিজমি খুঁজে পাওয়াও সহজ নয়। ১ মেগাওয়াট সোলার ফার্ম স্থাপনে ৩ একর জমির প্রয়োজন হয়। তা ছাড়া মরুভূমির অনেক দেশে সারা দিনে গড়ে ৬ ঘণ্টা পর্যন্ত সূর্যের আলো পাওয়া যায়, বাংলাদেশে যা মাত্র ৪ ঘণ্টা। তবে সোলার প্যানেলের দক্ষতা দিন দিন বাড়ছে, দামও কমছে পাল্লা দিয়ে। প্রচলিত সেন্ট্রাল ইনভার্টারের পরিবর্তে ডিস্ট্রিবিউটেড প্রযুক্তির ‘স্ট্রিং ইনভার্টার’ সৌর প্রকল্পের ডাউন টাইম ব্যাপকভাবে কমিয়ে এনেছে।

বাংলাদেশে বর্তমানে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে পাওয়া গ্যাস দিয়ে কম্বাইন্ড সাইকেল পদ্ধতিতে উৎপাদিত বিদ্যুতের প্রতি কিলোওয়াট-ঘণ্টার খরচ ক্যাপাসিটি চার্জসহ ১৪-২২ টাকা পড়ে, যেখানে জ্বালানি খরচ ১২ টাকা। চুক্তি অনুযায়ী পাওয়ার প্ল্যান্টটি ২০ ঘণ্টা চালালে ক্যাপাসিটি চার্জ আসে ২ টাকা, তবে কেবল ৪ ঘণ্টা চললে তা ১০ টাকায় পৌঁছায়।

যত ঘণ্টাই চলুক না কেন প্রতিদিন প্রতি ইউনিট ৪০ টাকা হারে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতেই হবে। অন্যদিকে এখনকার বাজারদরে ‘স্পট মার্কেট’ থেকে গ্যাস কিনলে, চালানো ভেদে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ২৪ টাকা গ্যাসের দামসহ ২৬-৩৪ টাকা পড়বে। ৪ ঘণ্টা থেকে ২০ ঘণ্টা চলা ফার্নেস অয়েলভিত্তিক প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের ব্যয় ১৩ টাকার তেলসহ ১৫-২৩ টাকা দাঁড়াচ্ছে। নোংরা কয়লা বিদ্যুতের মূল্যও ১৫ টাকার কম নয়।

ফসিল ফুয়েল ব্যবহারের বিপরীতে ‘কপ-২৭’ জলবায়ু সম্মেলনে ঘোষিত ‘কার্বন সারচার্জ’ হিসেবে নিলে এ খরচ আরও অন্তত ১০-২০ শতাংশ বাড়বে।

অথচ গ্রিড কানেকশন ও লাইন লসসহ প্রতি কিলোওয়াট-ঘণ্টা সৌরবিদ্যুৎ ১০ টাকার মধ্যে পাওয়া সম্ভব। এখন আপরুট-মোমেন্ট সহিষ্ণু উঁচু খুঁটির ওপরে সালোকসংশ্লেষণ উপযোগী নির্দিষ্ট দূরত্বে সোলার প্যানেল স্থাপন করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি সবজি ও ফলের চাষ অব্যাহত রাখা সম্ভব। বর্ষা মৌসুমে মাছের খামারও চলতে পারে নির্বিঘ্নে। সরকারের নর্থওয়েস্ট পাওয়ার কোম্পানির সিরাজগঞ্জ সৌর প্রকল্পে প্যানেলের নিচের পতিত জমিতে এখন সফলভাবে চাষাবাদ চলছে। তারপরও গ্যাসস্বল্পতাকে পুঁজি করে চিহ্নিত গোষ্ঠী আবারও আমাদের পরিবেশ দূষণকারী ফার্নেস অয়েলের ফাঁদে ফেলার ষড়যন্ত্র করছে। তাদের হাত থেকে বাংলাদেশকে বাঁচাতেই হবে!

এ মুহূর্তে বাংলাদেশের উচিত সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া। এ ক্ষেত্রে বেজ প্ল্যান্টগুলোর জন্য ৫ হাজার মেগাওয়াট বরাদ্দ রেখে, সকাল ৯টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত, ৬ ঘণ্টায় আরও ১০ হাজার মেগাওয়াট করে প্রয়োজনীয় ৬০ হাজার মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা তৈরি করাই হবে আমাদের লক্ষ্য। গড়ে ৪ ঘণ্টায় সূর্যের আলো প্রাপ্তি বিবেচনায় এ পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ১৫ হাজার মেগাওয়াট ক্যাপাসিটির সোলার প্যানেল স্থাপন করতে হবে, যা ৫ হাজার মেগাওয়াট ছাদ–বিদ্যুৎ ব্যবস্থা (রুফটপ সিস্টেম) ও ১০ হাজার মেগাওয়াট ‘সোলার ফার্ম’ স্থাপনের মাধ্যমে সহজেই অর্জন করা সম্ভব।

এ উদ্যোগে ট্রান্সমিশন লাইনেও নতুন করে খুব বেশি বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে না, কেননা দেশজুড়েই এ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় চাহিদা মাথায় রেখেই সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর স্থান নির্ধারণ করতে হবে, যাতে করে এক এলাকার উৎপাদিত বিদ্যুৎ অন্য কোনো এলাকায় পরিবহন করে নিতে না হয়। সৌরবিদ্যুতের ক্ষেত্রে সকাল ১০টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত সময়টায় বেশি রেডিয়েশন পাওয়া যায়; তাই ট্যারিফ সুবিধা দিয়ে দিনের বেলার বেশির ভাগ চাহিদা এ সময়টাতেই ঠেলে দিতে হবে। সরকারের বিদ্যুৎ বিভাগ ‘অটোমেটেড মিটারিং ইনফ্রাস্ট্রাকচার’ বা ‘এএমআই’ স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে, যার ফলে ঘণ্টা ধরে ধরে এমনকি বিলাসী শীতাতপ নিয়ন্ত্রণযন্ত্রের জন্যও পৃথক হারে বিলিং করা যাবে। তবে ডিপিডিসির স্থাপিত ‘আরএফ মেশ’, নেসকোর ব্যবহৃত ‘ন্যারো-ব্যান্ড পিএলসি’ কিংবা ডেসকোর প্রস্তাবিত ‘জিপিআরএস’ প্রযুক্তি নিয়ে এখনো সন্দেহ কাটেনি।

বাংলাদেশে অতীতেও ইমারতের নকশা অনুমোদনের শর্ত হিসেবে বিধিবদ্ধভাবে রুফটপ সোলার স্থাপনের চেষ্টা হয়েছে, যা সফল হয়নি ‘নেটমিটারিং’ পদ্ধতি ঠিকভাবে চালু না থাকায় এবং ভর্তুকি দেওয়া গ্রিড বিদ্যুতের দাম সৌরবিদ্যুতের চেয়ে কম হওয়ায়। তবে এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে গেছে। যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া হলে এবং জীবাশ্ম-বিদ্যুতে সাবসিডির সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এলে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে তিন বছরের মধ্যেই ৫ হাজার মেগাওয়াট ‘ছাদ বিদ্যুৎ’ উৎপাদন করা সম্ভব। এ সুযোগে ছাদে ছাদে পড়ে থাকা সোলার সিস্টেমগুলোও সচল করতে হবে।

প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষম সোলার প্যানেল বসাতে ৪ বর্গমিটার বা ৪৩ বর্গফুট জায়গা লাগে। শুধু সরকারের ‘আশ্রয়ণ’ প্রকল্পের প্রতিটি বাড়ির ৪৩০ বর্গফুট ছাদের ওপর, পৃথক ফ্রেম তৈরি করে, ১০ কিলোওয়াট করে সোলার প্যানেল স্থাপন করা সম্ভব। আর এ রকম দুই লাখ ছাদেই ২ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে। একইভাবে ৫০ হাজার স্কুল-কলেজে আরও ২ হাজার মেগাওয়াট সৌর প্যানেল বসানোর সুযোগ রয়েছে। ঢাকা, জেলা শহর, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে প্রতিটি সরকারি স্থাপনায় ‘পাওয়ার পারচেজ অ্যাগ্রিমেন্ট’ বা ‘পিপিএ’র আওতায় সোলার প্যানেল স্থাপন করা হলে ৫ হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতা অর্জন একেবারেই দুঃসাধ্য কিছু নয়। ‘ত্রি-ফেস’ ও ‘সিঙ্গেল-ফেস’ উভয় ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য ‘নেটমিটারিং’ পদ্ধতি চালু থাকলে বেসরকারি উদ্যোক্তারাও নিশ্চয়ই এগিয়ে আসবেন। এ কাজে গতিশীলতা আনতে ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিগুলোর সঙ্গেও যৌথভাবে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়।

এবার আসা যাক, ১০ হাজার মেগাওয়াট সোলার ফার্মের হিসেবে। তাতে প্রতি মেগাওয়াটে ৩ একর করে মোট ৩০ হাজার একর অকৃষিজমির প্রয়োজন হবে, যদিও সোলার প্যানেল স্থাপনের পরও মৎস্য কিংবা সবজি-ফলমূল চাষের সুযোগ থেকেই যাবে। এ ক্ষেত্রে নদীর বুকে জেগে ওঠা স্বল্প ফলনশীল চরগুলোকেই সবার আগে বিবেচনায় আনতে হবে। সুবর্ণচর, আলোকদিয়া চর, হাইমচরসহ সারা দেশের ৩০টি চরেই প্রয়োজনীয় ৩০ হাজার একর জমি পাওয়া সম্ভব। বর্তমানে জলাভূমিতেও ভাসমান সোলার প্যানেল স্থাপনের পরীক্ষিত প্রযুক্তি রয়েছে। মহাসড়কের আল-বরাবর এবং রাস্তা-নদী-খালের দুই পাশেও সোলার প্যানেল স্থাপন করা যায়।

বাংলাদেশ যখন নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে জোরেশোরে এগোতে চাইছে, ঠিক তখনই অন্য দেশ থেকে সৌরবিদ্যুৎ রপ্তানির প্রস্তাব আসতে শুরু করেছে। এ সুযোগ আমাদের অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে, তবে তা কিছুতেই নিজের সক্ষমতা বিসর্জন দিয়ে নয়। রাশিয়ার গ্যাসের ওপর নির্ভর করেই জার্মানি আজ এত বড় বিপদে পড়েছে। নিজস্ব গ্যাস উত্তোলনে জোর না দেওয়ার খেসারত তো আমরা এখন দিচ্ছিই!

তবে এ উদ্যোগের ক্ষেত্রে কিছুতেই সরকারের নিজস্ব অর্থায়ন কিংবা ব্যবস্থাপনা নয়, বরং ‘আইপিপি’র আওতাতেই ১০ টাকায় প্রতি ইউনিট সৌরবিদ্যুৎ পাওয়া সম্ভব। এখানে বসিয়ে বসিয়ে কোনো ‘ক্যাপাসিটি চার্জ’ও গুনতে হবে না। যত ইউনিট বিদ্যুৎ গ্রিডে আসবে সে হিসেবেই বিল পরিশোধ করা হবে। এ ক্ষেত্রে ‘ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট’ বা ‘এফডিআই’ই আমাদের কাম্য, কেননা তাতে রিজার্ভের ওপর চাপ না পড়ে বরং ব্যাপক বৈদেশিক মুদ্রার আমদানি ঘটবে এবং অর্থনীতিতে ব্যাপক চাঞ্চল্য তৈরি হবে। সৌরবিদ্যুতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ তার ভারসাম্যের পররাষ্ট্রনীতিই অনুসরণ করতে পারে। ১৫ হাজার মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ স্থাপনের ১৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, জাপান, চীন, ভারত ও আরব বিশ্বের প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সক্ষমতা অনুযায়ী ভাগ করে দেওয়া যায়।

১৫ হাজার মেগাওয়াট সোলার প্যানেল স্থাপনের কার্যক্রম হাতে নেওয়া হলে কংক্রিট পোল নির্মাণ ও স্থাপনের কাজে রড-সিমেন্ট শিল্প ও শ্রমবাজার ব্যাপকভাবে উপকৃত হবে, যা জিডিপিতে বছরে অন্তত ১ শতাংশ যোগ করবে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে স্থাপিত ইকোনমিক জোন ও হাইটেক পার্কে সোলার প্যানেল, ইনভার্টার ও ব্যাটারি তৈরি কিংবা সংযোজন করা গেলে প্রচুর নারীর কর্মসংস্থান ঘটবে এবং বৈদেশিক মুদ্রারও সাশ্রয় হবে।

ইউরোপ বর্তমানে ‘উইন্ড পাওয়ার’ প্রযুক্তির ওপর বড় আকারে নির্ভর করছে। আমাদের সেদিকেও নজর রাখতে হবে, সে ক্ষেত্রে ‘অনশোর’ সুবিধাজনক না হলে প্রয়োজনে ‘অফশোর’ বিকল্প খুঁজতে হবে। চীনসহ বহু দেশ ব্যাপক আকারের ইলেকট্রিসিটি পাচ্ছে জলবিদ্যুৎ থেকে। আমাদের এ ধরনের খুব বেশি জলপ্রবাহ নেই, তথাপি এত বড় কাপ্তাই প্রকল্প থেকে এখনকার মতো মাত্র ৭০ মেগাওয়াটে সন্তুষ্ট থাকলে চলবে না। এ প্রকল্পটি রি-ইঞ্জিনিয়ারিং করে অন্তত ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। এ ছাড়া আন্তদেশীয় নদীগুলোতেও যৌথ উদ্যোগে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। কেবল ভারতের মণিপুর রাজ্যে বরাক নদের ওপর প্রস্তাবিত ‘টিপাইমুখ জলবিদ্যুৎ প্রকল্প’ থেকেই ১ হাজার মেগাওয়াট ‘ক্লিন পাওয়ার’ পাওয়া যেতে পারে, যে উদ্যোগ হাওর অঞ্চলে বন্যা নিয়ন্ত্রণেও বড় ভূমিকা রাখবে। ইতিমধ্যে স্থাপিত পাওয়ার প্ল্যান্টগুলোর অলস সময় কাজে লাগিয়ে উঁচু জলাধারে পানি উত্তোলন করে ‘পাম্প স্টোরেজ’ পদ্ধতিতেও বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়।

বাংলাদেশ যখন নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে জোরেশোরে এগোতে চাইছে, ঠিক তখনই অন্য দেশ থেকে সৌরবিদ্যুৎ রপ্তানির প্রস্তাব আসতে শুরু করেছে। এ সুযোগ আমাদের অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে, তবে তা কিছুতেই নিজের সক্ষমতা বিসর্জন দিয়ে নয়। রাশিয়ার গ্যাসের ওপর নির্ভর করেই জার্মানি আজ এত বড় বিপদে পড়েছে। নিজস্ব গ্যাস উত্তোলনে জোর না দেওয়ার খেসারত তো আমরা এখন দিচ্ছিই! তা ছাড়া গ্যাসের দাম যখন কম ছিল তখন ৫ ডলারে ‘অফশোর পিএসসি’, ব্রেন্টের ১২ শতাংশ দরে অর্থাৎ সর্বোচ্চ ১২ ডলারে আরও ৫০০ এমএমসিএফডি দীর্ঘমেয়াদি গ্যাস চুক্তি এবং সুদিনে সাঙ্গুর মতো ফুরিয়ে যাওয়া গ্যাস স্টোরেজগুলো ‘রিগ্যাসিফাই’ করে নেওয়ার সুযোগও আমরা হাতছাড়া করেছি। এখন সে গ্যাসের বাজারমূল্য ইউনিটপ্রতি ৩০-৪০ ডলার।

সৌরবিদ্যুতের বিরুদ্ধে ‘গ্রিড ইনস্ট্যাবিলিটি’র অভিযোগটিরও এখানে জবাব দেওয়া প্রয়োজন। ঝড়বৃষ্টি এমনকি আকাশ মেঘে ঢেকে গেলেও সৌরবিদ্যুতের সরবরাহ থমকে যায়, যাতে আকস্মিক পাওয়ার কাটসহ গ্রিড বিপর্যয় পর্যন্ত ঘটে যেতে পারে। এ বিপদ মোকাবিলায় প্রতিটি সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের সঙ্গে অন্তত ৫ শতাংশ ‘এনার্জি স্টোরেজ সিস্টেম’ বা ‘ইএসএস’ প্রযুক্তি এখন সারা পৃথিবীতে সফলভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সূর্যকিরণের ওঠানামাসহ প্রাকৃতিক যেকোনো দুর্যোগের ক্ষেত্রে এ আধার থেকে বিদ্যুৎ সঞ্চালন করে সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখা যায়। রাতের বেলার পিক আওয়ারেও এ জমানো বিদ্যুৎ কাজে লাগবে।

গ্রিডে প্রয়োজনীয় ব্যাটারি স্টোরেজ মোতায়েনের মাধ্যমে, গরমকালে সন্ধ্যা ৭টা ৩০ মিনিট থেকে রাত ১১টা ৩০ মিনিট এবং শীতকালে সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১০টা—৪ ঘণ্টা পিক আওয়ারের ৮ হাজার মেগাওয়াট-ঘণ্টার অতিরিক্ত চাহিদা মোকাবিলা করে রেন্টাল-কুইক রেন্টাল চুক্তির আওতায় স্থাপিত তেলভিত্তিক ইউনিটপ্রতি কার্বন ক্ষতিপূরণসহ অন্তত ৪০ টাকা খরচের ২ হাজার মেগাওয়াট রক্তক্ষয়ী ‘পিকিং প্ল্যান্ট’গুলোকে চিরতরে বিদায় দেওয়া সম্ভব! ১৫ বছর মেয়াদের ‘রিসাইকেল’যোগ্য এ ব্যাটারি বাবদ খরচ এখনই প্রতি কিলোওয়াট-ঘণ্টা ২০ টাকার চেয়ে কম পড়ছে।

সৌরকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ সংগ্রহ করা হলে এ বাবদ মোট ব্যয় ৩০ টাকা ছাড়াবে না। ২৪ ঘণ্টায় গ্রিডে থেকে যাওয়া অতিরিক্ত বিদ্যুৎ সঞ্চয় করেও এ প্রয়োজনের অন্তত অর্ধেক মেটানো সম্ভব, তাতে ইউনিটপ্রতি ব্যয় ২৫ টাকায় নেমে আসবে। ‘এএমআই’ ব্যবহার করে এ সময়টায় ট্যারিফ বাড়িয়ে দিয়েও অনেকখানি ‘পিক সেভ’ করা যেতে পারে।

সরকারের গত ১৪ বছরের প্রচেষ্টায় আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা এখন ২২ হাজার মেগাওয়াটে দাঁড়িয়েছে, যা বাস্তবায়নাধীন বড় কেন্দ্রগুলোসহ ৩০ হাজার মেগাওয়াটে পৌঁছাবে। তবে বিশ্ব জ্বালানিযুদ্ধের বাস্তবতায় নির্মাণাধীন গ্যাসভিত্তিক প্রকল্পগুলোর ‘সিওডি’ আমাদের অবশ্যই অন্তত দুই বছর পিছিয়ে দিতে হবে। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, ১৫ হাজার মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হলে, বিদ্যমান বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো কি কাজে লাগবে? বস্তুত আগামী তিন বছরে ঘণ্টায় ১৫ হাজার মেগাওয়াট গড়ে, আমাদের দৈনিক মোট বিদ্যুতের প্রয়োজনীয়তা দাঁড়াবে ৩ লাখ ৬০ হাজার মেগাওয়াট-ঘণ্টা। আমরা এতক্ষণ সৌরবিদ্যুৎ দিয়ে, দিনের বেলার সকাল ৯টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত সময়ে, শুধু ৬০ হাজার মেগাওয়াট-ঘণ্টা বিদ্যুতের প্রয়োজন মেটানোর হিসাব করেছি, যা মোট প্রাক্কলিত চাহিদার মাত্র ১৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ। অবশিষ্ট ৩ লাখ মেগাওয়াট-ঘণ্টা আসবে বিদ্যমান ও বাস্তবায়নাধীন জীবাশ্মনির্ভর ও পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে।

তবে যেসব ক্যাভটিভ, কুইক রেন্টাল ও রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো এত দিন আমাদের প্রয়োজন মিটিয়েছে, সেগুলোসহ অতিমাত্রায় জ্বালানি খরচের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে আমাদের এ সুযোগে অবশ্যই সসম্মানে অবসরে পাঠাতে হবে। তাতে আমাদের কার্যকর সক্ষমতা দাঁড়াবে ২০ হাজার মেগাওয়াট। এসবের প্রতিটিই আয়ুষ্কাল পর্যন্ত প্রতিদিন গড়ে অন্তত ১৫ ঘণ্টা করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে। সে ক্ষেত্রে জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত রাখতে অভ্যন্তরীণ গ্যাসের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং নিজস্ব কয়লা উত্তোলনে কার্যকর উদ্যোগ অপরিহার্য। বাসাবাড়িতে ও যানবাহনে মূল্যবান প্রাকৃতিক গ্যাসের পরিবর্তে অবিলম্বে ‘এলপিজি’ কিংবা ‘ইলেকট্রিক’ বিকল্পে যেতে হবে। ভবিষ্যতে তেল-গ্যাস-কয়লানির্ভর আর একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রও স্থাপন করা যাবে না এবং মেয়াদ শেষে বিদ্যমান একটি চুক্তিও নবায়ন করা হবে না। নতুন সব প্রকল্পই হতে হবে নবায়নযোগ্য, গ্রিন হাইড্রোজেন কিংবা নিউক্লিয়ার ফিউশন প্রযুক্তির। ২০৪১ সালের মধ্যে ৪০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানির লক্ষ্যমাত্রা আমাদের অর্জন করতেই হবে।
উপস্থাপিত প্রস্তাব অনুসারে, ১৫ বিলিয়ন ডলার এফডিআইয়ের মাধ্যমে ১৫ গিগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হলে দেশের চলমান সব সমস্যার ‘সার্বিক সমাধান’ ঘটবে।

একদিকে ‘এফডিআই’ আমাদের রিজার্ভ বাড়াবে এবং অন্যদিকে জ্বালানি আমদানি কমে গেলে বর্তমান রিজার্ভের ক্ষয়ও রহিত হবে। শিল্প খাতে পর্যাপ্ত গ্যাস দেওয়া গেলে ব্যাপক কর্মসংস্থাপন বাড়াসহ রপ্তানি আয়েও বড় ধরনের প্রবৃদ্ধি ঘটবে। সে সঙ্গে জরুরি ভিত্তিতে আমদানি বিকল্প শিল্প গড়ে তোলা হলে আমদানি খরচও উল্লেখযোগ্য হারে কমে আসবে। সার কারখানায় প্রয়োজনীয় গ্যাস ও সারা দেশে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করা গেলে কৃষিক্ষেত্রে সার ও সেচসুবিধা নিশ্চিত হবে, তাতে বাড়বে খাদ্য উৎপাদন, কমে যাবে খাদ্য আমদানিও। সোলার ফার্মগুলোতে মৎস্য কিংবা সবজি-ফলমূল চাষ বাধ্যতামূলক করা হলে দেশে খাদ্য উৎপাদনে বিপুল অগ্রগতি হবে, যা নিশ্চিত করবে ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’র সার্বিক খাদ্যনিরাপত্তা। সর্বোপরি এ উদ্যোগের ফলে পরিবেশ রক্ষায় বাংলাদেশ তার ‘নেট জিরো’ অঙ্গীকারে অন্য সব দেশের চেয়ে বহুদূর এগিয়ে যাবে। সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং হবে ‘সবুজ বাংলাদেশ’ হিসেবে।

  • মোজাম্মেল বাবু প্রকৌশলী, কলাম লেখক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব