Thank you for trying Sticky AMP!!

সি চিন পিং চীনকে কি বিচ্ছিন্ন করার নীতি নিয়েছেন

চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং

গত আগস্টে একটি বিখ্যাত জার্নালে ছাপা হওয়া একটি নিবন্ধ বেশ আলোড়ন তুলেছিল। ওই নিবন্ধে বলা হয়েছিল, চীনের মিং রাজবংশ (১৩৬৮-১৬৪৪) এবং কিং রাজবংশের (১৬৪৪-১৯১১) শাসনামলে দেশটি বাইরের বিশ্ব থেকে নিজেকে অপেক্ষাকৃত বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল।

সাম্প্রতিকতম পণ্ডিতেরা মনে করেন, এটি একটি খারাপ ব্যাপার ছিল এবং আধুনিক যুগে বৃহৎ পরিসরের উন্মুক্ততা চীনকে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে উচ্চতর অবস্থান দিয়েছে এবং অগ্রগতির দিকে পরিচালিত করেছে। কিন্তু আলোচ্য নিবন্ধটিতে পণ্ডিতদের বিপরীতে অবস্থান নিয়ে বলা হয়েছে, দেশটিকে অংশত বাইরের দুনিয়া থেকে আলাদা করে রাখার সুবাদেই তারা অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সুবিধা পেয়েছে।

এ–সংক্রান্ত তর্কটা হয়তো একাডেমিক জগতেই থেকে যেত। কিন্তু এটি চীনের কমিউনিস্ট পার্টির (সিসিপি) সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত একটি থিঙ্কট্যাংকের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নিউজ ফিডে যুক্ত করার পর সেটি আবার আলোচনায় উঠে এসেছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই মন্তব্য করেছেন, সিসিপি আজ যে ইঙ্গিত দিচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে উন্মুক্ততা চীনের জন্য ভালো হবে কি না, তা নিয়ে সরকার চিন্তাভাবনা করছে। গত রোববার সিপিসির ২০তম কংগ্রেসে দেওয়া ভাষণে সি চিন পিং তাঁর উদ্বোধনী ভাষণে যা বললেন, তাতে প্রথম নজরে মনে হতে পারে তিনি একটি উদারনৈতিক ভিন্ন বার্তা দিতে চেয়েছেন।

তিনি তাঁর বক্তব্যে চীনকে আগামী বছর (যা তাঁর তৃতীয় মেয়াদকে চিহ্নিত করবে) উন্মুক্ত রাখার ধারণার প্রশংসা করেছেন। তবে সম্মেলন শেষে যেসব ইঙ্গিত পাওয়া গেছে, তাতে ধারণা করা যায় ১৯৮০–এর দশক থেকে ২০২০–এর দশকের আগে পর্যন্ত চীন যতটা বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিল এবং সমাজ যতটা উন্মুক্ত ছিল, চলতি ২০২০–এর দশকে দেশটি তার চেয়ে তুলনামূলকভাবে অনেক কম উন্মুক্ত থাকবে।

এর ফলে যে চীনা শিক্ষার্থীরা যুক্তরাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়াশোনা করে ফিরে আসছে, তাদের দেশে ফিরে প্রথমে একটি নির্দিষ্ট হোটেলে উঠে অপেক্ষা করতে হবে, কখন তাদের নিজের এলাকাকে নিরাপদ ঘোষণা করে তাদের অ্যাপে সবুজ আলো জ্বলবে। ইতিমধ্যে বিদেশি ব্যবসায়ী, ছাত্র এবং পর্যটকদের চীনে বেড়াতে আসার বিষয়টি বিরল বাস্তব ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি চীনের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

১৯৮০–এর দশকে চীন ‘সংস্কার’ এবং ‘উন্মুক্ততা’র ধারণা সামনে নিয়ে এগোনো শুরু করে। এই সময়টায় চীন এমন একটি সমাজে পরিণত হয়, যা রাষ্ট্র হিসেবে বহির্বিশ্বের সঙ্গে সংযুক্ত কিন্তু তার অভ্যন্তরীণ সমাজ গভীরভাবে নিয়ন্ত্রিত। ওই সময়টাতে চীনের সমাজ ছিল উন্মুক্ত কিন্তু অনুদার। পরস্পরবিরোধী এই দুটি অনুষঙ্গের এমন একটি সংমিশ্রণকে গণতন্ত্রের অনেক তাত্ত্বিক অসম্ভব প্রচেষ্টা বলে ভেবেছিলেন। পুরোনো সোভিয়েত ব্লকে যেমন তাদের নাগরিকদের বিদেশভ্রমণে নানা ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করা হতো, চীনে তেমনটা ছিল না। চীন রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বী ছাড়া সাধারণ নাগরিকদের বিদেশ ভ্রমণ সীমাবদ্ধ করার চেষ্টা করেনি।

সংস্কার যুগের চীনা নাগরিকেরা ব্রিটেনে পড়াশোনা করতে পেরেছেন, আমেরিকায় লেনদেন করেছেন ও সেখানকার দর্শনীয় স্থান পরিদর্শন করেছেন এবং ইতালিতে গিয়ে বিলাসবহুল পণ্য কেনাকাটা করতে পেরেছেন। উদারপন্থী বিশ্বে ভ্রমণ করে গণতন্ত্র পর্যবেক্ষণ করতে কোনো চীনা নাগরিককে বাধা দেওয়া হতো না; তবে তঁারা বুঝতে পারতেন সেসব দেশ ভ্রমণ শেষে বেইজিং বিমানবন্দরে পা রাখামাত্রই খোলাখুলি মেজাজের সব ধরনের আলোচনা বন্ধ করতে হবে।

সেই ‘উন্মুক্ত কিন্তু অনুদার’ চীনা বিশ্ব অন্তত আপাতত শেষ হয়ে গেছে। বিশেষ করে ২০২০ সালের মার্চ মাসে চীন কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে তার সীমানা বন্ধ করে দেওয়ার পর থেকে সেই অবস্থা চলছে।

এখন চীনারা অপেক্ষাকৃত মুক্তভাবে দেশের ভেতরে ঘুরে বেড়াতে পারেন (অবশ্য শর্ত হিসেবে তঁাদের নিয়মিত পিসিআর পরীক্ষার ফল নেতিবাচক থাকতে হবে)। তবে এ বিষয়েও তারা সচেতন যে কোভিড ভাইরাসের কারণে যেকোনো সময় আবার কয়েক দিন বা সপ্তাহের জন্য আচমকা লকডাউনের মুখে পড়তে হতে পারে। চীনারা দেশের ভেতরে মুক্তভাবে চলতে–ফিরতে পারলেও বিদেশিদের জন্য সেখানে ভ্রমণ এখন খুবই কঠিন। কারণ, সি চিন পিং জিরো কোভিড নীতি গ্রহণ করেছেন। তবে এই সিদ্ধান্ত যতটা না স্বাস্থ্যগত, তার চেয়ে অনেক বেশি রাজনৈতিক। তবে জিরো-কোভিড নীতিটি ব্যক্তিগতভাবে সি চিন পিংয়ের সঙ্গে খুব বেশি জড়িত। তাঁর ভাষণ এটি স্পষ্ট করে দিয়েছে যে খুব শিগগিরই এই নীতি থেকে চীনের সরে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই।

Also Read: এক ব্যক্তির শাসনকেই স্বীকৃতি দেবে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি

এর প্রভাব খুব স্পষ্ট। এর ফলে যে চীনা শিক্ষার্থীরা যুক্তরাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়াশোনা করে ফিরে আসছে, তাদের দেশে ফিরে প্রথমে একটি নির্দিষ্ট হোটেলে উঠে অপেক্ষা করতে হবে, কখন তাদের নিজের এলাকাকে নিরাপদ ঘোষণা করে তাদের অ্যাপে সবুজ আলো জ্বলবে। ইতিমধ্যে বিদেশি ব্যবসায়ী, ছাত্র এবং পর্যটকদের চীনে বেড়াতে আসার বিষয়টি বিরল বাস্তব ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি চীনের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

সি চিন পিংয়ের এই নীতির কারণে চীন অনেকটাই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে এবং অর্থনীতি বড় ধরনের ধাক্কা খাবে। তবে সেই বাস্তবতা টের পেয়েও চিন পিং তাঁর সিদ্ধান্ত সহসা বদলাবেন বলে মনে হয় না।

দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

রানা মিত্তার অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির আধুনিক চীনের ইতিহাস ও রাজনীতি বিষয়ের অধ্যাপক