Thank you for trying Sticky AMP!!

উন্নয়নের বয়ান আর চিপসের প্যাকেটের গল্পে মোড়া শিশুর লাশ

বৃহস্পতিবার রাতের বৃষ্টিতে পরদিনও পানিতে ডোবা ছিল রাজধানীর অনেক এলাকা। শুক্রবার সকালে, নিউমার্কেট এলাকা, মিরপুর রোড

নেটফ্লিক্সে ‘থ্রি পার্সেন্ট’ নামে একটা ব্রাজিলীয় সিরিজ আছে। চার সিজনের এই ডায়াস্টোপিয়ান সিরিজটিতে দেখা যায় যে অদূর ভবিষ্যতে দুনিয়া দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। এক ভাগের নাম ‘অফশোর’ আরেক ভাগের নাম ‘ইনল্যান্ড’। প্রতিবছর ২০ বছরের তরুণ-তরুণীর মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা হয়, যাতে শতকরা তিন ভাগ উত্তীর্ণ হয়ে অফশোরে যাওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করে আর বাকিদের স্থান হয় ইনল্যান্ডে।
পৃথিবীর যাবতীয় সম্পদ আর আধুনিকতম প্রযুক্তি ব্যবহার করে অফশোর নির্মাণ করা হয়েছে, যেখানে আছে সব রকম সুবিধা। এককথায় স্বর্গ। অন্যদিকে ইনল্যান্ড যেন এক নরক। এখানে আধুনিক প্রযুক্তি দূরের কথা, একেবারে মৌলিক নাগরিক সুবিধাগুলোও নেই।

অফশোর, তথা ‘সব পেয়েছির’ ধনী দুনিয়ায় শুধু উন্নয়ন আর উন্নয়ন। ইনল্যান্ডে নারকীয় জীবনযাপনকারীদের শ্রম আর ঘামের বিনিময়ে গড়ে ওঠা সম্পদ তাদেরই সেবায় নিয়োজিত। শুধু এতেই যে সব পেয়েছির দল ক্ষান্ত দেয় তা নয়—তারা সব সময় বলে বেড়ায়, তারা সেরা, তাই তারা এসবের যোগ্য। বাকি ৯৭ ভাগ যে পশুর চেয়ে অধম, নারকীয় জীবনযাপন করে, এ দায় তাদেরই অযোগ্যতার।

Also Read: ‘ঢাকায় থাকি, দুর্ভোগে থাকি’

নাটকীয় এই উপস্থাপনায় ওয়েব সিরিজটা পুঁজিবাদী সমাজের তীব্র বৈষম্য তুলে ধরে। এই বৈষম্য দেখে আমরা শিহরিত হই, আবার পরের মুহূর্তে মনে হয়, এ তো কেবল সিনেমাই। পুঁজিবাদী দুনিয়ায় বৈষম্য তীব্র হলেও এই রকম নারকীয় হয়তো নয়।
কিংবা ধরা যাক, অস্কারজয়ী কোরিয়ান সিনেমা ‘প্যারাসাইট’-এর একটি বিখ্যাত দৃশ্য। তুমুল বৃষ্টিতে ঘরবাড়ি ভেসে যাওয়ার আশঙ্কায় ড্রাইভার আর তার পরিবার, ওদিকে একই বৃষ্টিকে চরমতম রোমান্টিকভাবে উদ্‌যাপন করছে কোটিপতি মালিকেরা। তবে দিন শেষে ওগুলো সিনেমাই তো! আমরা কিছুটা স্বস্তি পাই এই ভেবে।

কিন্তু হায়! ইংরেজিতে বলে, ‘ট্রুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান দ্য ফিকশন’—সত্য কল্পনার চেয়ে অদ্ভুত। বৃহস্পতিবার ঢাকা শহরের কয়েক ঘন্টার বৃষ্টি এই আপ্তবাক্যকেই সত্য করে তোলে। সত্য কল্পনার চেয়ে অদ্ভুত শুধু নয়, অনেক বেশি নিষ্ঠুর আকারে ধরা দেয়।
একটা আধুনিক শহর, সেখানে কয়েক ঘণ্টার টানা বৃষ্টিতে রাস্তা ডুবে গেছে। অবৈধ বিদ্যুতের তার সেই পানিতে মিশে গোটা রাস্তাটাকে করে তুলেছে বিদ্যুতায়িত এক মৃত্যুকূপে। সেই কূপে জীবন গেল একই পরিবারের তিনজনের।

শুধু কি তা-ই! নিশ্চিত মারা যেতে থাকা মা কোলের সন্তানটাকে ছুড়ে ফেললেন দূরের নোংরা পানিতে, যদিবা বেঁচে যায়! এই সব দেখে অগ্রপশ্চাৎ না ভেবে ২০ বছর বয়সী এক অচেনা তরুণ ঝাঁপিয়ে পড়লেন পরিবারটিকে বাঁচাতে। একই পরিবারের তিনজন আর অনীক নামের সেই অতিমানবীয় তরুণ মারা গেলেন। শিশুটির গল্পে পরে আসছি।

নিশ্চিতভাবেই পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্ঠুর ডায়াস্টোপিয়ান গল্পেও এই রকম মর্মান্তিক বিবরণ দেওয়া সম্ভব নয়। কল্পনার কঠিনতম স্তর ছাপিয়ে যাওয়া এই ‘হত্যাযজ্ঞ’ ফেসবুকে ছড়িয়ে যাওয়া ভিডিওতে দেখলেন অভিশপ্ত ঢাকার লাখো লাখো লোক।

এই ভিডিও কতজন দেখেছেন, তা জানার সুযোগ থাকলেও সাত মাসের ছেলে হোসাইনের নিথর দেহটা যখন রাস্তার ময়লা ওঠানোর মতো তোলা হয়, তখন কত মানুষ সেই দৃশ্য দেখে কুঁকড়ে গেছেন, তার পরিসংখ্যান নেই। যদিও আমরা জানতে পারছি, হোসাইন জীবিতই ফিরেছে। তবে মারা গেছে তার বড় বোন সাত বছর বয়সী শিশু লিমা।

Also Read: খেয়ালখুশির উন্নয়নে ঢাকা আজ ‘ক্যানসার রোগী’

বড় বড় উন্নয়ন অবশ্য রাজনীতির জন্য ভালো। ইয়া বড় জিনিস দেখিয়ে লোকজনকে প্রলুব্ধ করা যায়, ঠান্ডা করে রাখা হয়। দুর্নীতির সুযোগ তো আছেই। শহরজুড়ে উড়ালসড়ক করা হয় যানজট কমানোর কথা বলে, অথচ নিচের রাস্তা চলার অযোগ্য করে ফেলা হয়। দোতলায় গাড়ি চলতে গিয়ে নিচতলার কী হলো, তা মনে রাখার প্রয়োজন নেই এই ডায়াস্টোপিক উন্নয়ন চিন্তার।

জানি, এই দৃশ্য দেখে কতজনের কোনো হেলদোল হয়নি। নরকের নিকৃষ্টতম শহরে এ রকম ঘটনা দেখতে দেখতে সয়ে গেছেন। ভবিতব্য মেনে নিয়েছেন। এই উন্নয়নের শহরের নিচুতলায় থাকলে এ রকমটাই ‘স্বাভাবিক’ ধরে নিয়েছেন।

এই তো কিছুদিন আগে, ঘটা করে উদ্বোধন হলো এক্সপ্রেস হাইওয়ে। ঢাকার ট্রাফিক জ্যামে ধনী লোকদের বড্ড ‘অসুবিধা’ হচ্ছিল। এয়ারপোর্ট থেকে তাঁরা ১০ মিনিটে যাতে ফার্মগেট চলে আসতে পারেন, তার জন্য যেন এই ব্যবস্থা।

ফলে নিচের অবস্থা হলো ত্রাহি মধুসূদন। অপরিকল্পিত এই উড়ালসড়কের কারণে নিচের যানজট আরও বেড়ে গেল। ঘেমে গোসল করা সিএনজিচালক, মুড়ির টিন বাসে পিষ্ট যাত্রী, বিরাট এই শহরে যথেষ্ট শৌচাগার না থাকায় কিডনির জটিল রোগে আক্রান্ত জ্যামে আটকে থাকা মধ্যবিত্ত নারীদের অবস্থা পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্ঠুর চলচ্চিত্রেও তুলে ধরা সম্ভব হবে নয়।

অবৈধ বিদ্যুতের তার পানিতে মিশে গোটা রাস্তাটাকে করে তুলে বিদ্যুতায়িত এক মৃত্যুকূপে। সেই কূপে জীবন গেল একই পরিবারের তিনজনের। পরিবারটিকে বাঁচাতে এসে প্রাণ হারালেন এক তরুণও। মিরপুর, ঢাকা

বড় বড় উন্নয়ন অবশ্য রাজনীতির জন্য ভালো। ইয়া বড় জিনিস দেখিয়ে লোকজনকে প্রলুব্ধ করা যায়, ঠান্ডা করে রাখা হয়। দুর্নীতির সুযোগ তো আছেই। শহরজুড়ে উড়ালসড়ক করা হয় যানজট কমানোর কথা বলে, অথচ নিচের রাস্তা চলার অযোগ্য করে ফেলা হয়। দোতলায় গাড়ি চলতে গিয়ে নিচতলার কী হলো, তা মনে রাখার প্রয়োজন নেই এই ডায়াস্টোপিক উন্নয়ন চিন্তার।

পুঁজিবাদের সবচেয়ে ভয়াল রূপই নয়, এই শহর দেখে নাজিদের সবচেয়ে ক্রূর চেহারাটাও। এই শহরে শিশু, নারী ও অশক্ত মানুষদের পথচারী হওয়া নিষেধ। পথচারী তাঁরাই হতে পারবেন, যাঁরা পেল্লায় পদচারি সেতুগুলো পার হতে পারবেন। শহরের রাস্তা তো গাড়িওয়ালাদের, এইখানে পথচারীদের কিসের অধিকার! দোতলা উন্নয়ন মডেলে গাছেরটা খাওয়া আর তলারটা কুড়ানোর কী নিদারুণ উদাহরণ!

Also Read: অর্ধেক উড়ালসড়ক ঢাকাবাসীকে কী দিল

ফলে শহরে কয়েক ঘণ্টা বৃষ্টিতে ভেসে গেলে তা উন্নয়নের মাথাব্যথা নয়। জবাবদিহিহীন এই রাষ্ট্রে কারও দায় নেই মৃত্যুর। কিছুকাল আগে হলেও আমরা দেখতাম, লোকদেখানো ভোটের জন্য হলেও রাজনীতিবিদেরা ভুক্তভোগীদের কাছে যান। কিন্তু দোতলা উন্নয়ন মডেলে জনতা কেবলই কর উৎপাদনের মেশিন, ভোটার নন। ক্ষমতা তো নির্ধারিত হবে রাতভর দলীয় কর্মীদের ছাপ্পা ভোট কিংবা বিদেশি শক্তির সঙ্গে দর-কষাকষি দিয়ে। এমনকি, একদা ‘আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়ে গেছে’ বলা মন্ত্রী, যাঁকে নাগরিকেরা তুমুল সমালোচনা করেছিলেন, সেই রকমটাও এখন প্রত্যাশার বাইরে।

এর জন্য বয়ান তৈরি হয়। মিডিয়া, শাসকশ্রেণি বয়ান বানায়। পদাচারি সেতুতে না ওঠাটা পথচারীর বিরাট অন্যায়, এই প্রোপাগান্ডায় বড় বড় ছবি ছাপা হয়। আর শহরের জলাবদ্ধতার কারণ? ওমা! জানেন না! চিপসের প্যাকেট!

কিছুকাল ফরাসি ভাষান্তরিক হিসেবে কাজ করতাম। একবার এক ফরাসি পর্যটক দলের সঙ্গে বিশ দিন ছিলাম গোটা দেশ ঘুরবো এই চুক্তিতে। প্রথম দুই–তিন দিন তাঁদের দেখতাম কাগজটা, ময়লাটা ডাষ্টবিন ছাড়া ফেলতো না। সময়ে সময়ে টয়লেটে গিয়ে পরিস্কার হতো।

কিন্তু হায়! সাতদিনের মাথায় বেচারাদের সব ভালো অভ্যাস শেষ! কাহাতক ময়লা হাতে নিয়ে ঘুরবে! একজন বয়স্ক পুরুষ তো একদিন আর না পেরে গাছতলাতেই…সভ্যতার প্রতিভূ ফরাসীরাও আমাদের চিপস ফেলা ‘অসভ্য’ বাংলাদেশি হয়ে গেলো।

কারণ, গণঅভ্যাস ঠিক করার দায়িত্ব কর্তৃপক্ষের, যারা এজন্য কোটি কোটি টাকা পায়। উড়ালসড়কের চেয়েও এইসব অনেক জরুরি। অবশ্য জবাবদিহি প্রদর্শনের নিয়ম থাকলে, এইসব খাতেও যা বরাদ্দ হয় তাতেই যথেষ্ঠ পরিমাণ ময়লা ফেলার জায়গা থাকতো, মশা কমে ডেঙ্গু মহামারি হতো না, গণঅভ্যাস ঠিক হতো কয়েক বছরেই।

কিন্তু, তা না করে, সীমাহীন দুর্নীতি, জবাবদিহি প্রদর্শনের পরোয়া না করে চিপসের প্যাকেট তত্ত্ব ছড়ানোটা অনেক বেশি লাভের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক একবার বলেছিলেন, এই দেশে কয়েক হাজার লোক মানুষ, বাকিরা কেবলই সংখ্যা। দুঃখিত স্যার, এখন বাকিরা সংখ্যাও না।

তাঁদের পিষ্ট হতে হতেও চিপসের প্যাকেটের দায় নিতে হয়। লিমার মরদেহ আমাদের কোনো উত্তেজনা আনে না, বরং আরো বেশি অভ্যস্ত করে তোলে। বেঁচে যাওয়া সাত মাস বয়সী শিশু হোসাইন বড় হবে আরো নিষ্ঠুরভাবে মরে যাওয়ার জন্যই।

কে জানে! হোসাইন হয়তো স্বপ্নে দেখবে অনিককে। সেই বিশবছর বয়সী এক মহাপ্রাণ। নিদারুন আত্মত্যাগের পরিতৃপ্ত হাসিটা হয়তো ওকে বাঁচিয়ে রাখবে। আর তখন হয়তো সে থাকবে দুইজন হিজড়া বৃষ্টি আর আমিনার কোলে। সমাজে সবচেয়ে অবহেলিত, সবচেয়ে নিগৃহীত জীবনযাপন করা সম্প্রদায়ের যে দুইজন তাকে বাঁচিয়েছিল।

এই গোকূলে হোসাইন বড় হবে, কোনো একদিন এই সব অমানবিক উন্নয়ন আর মহা–বদমায়েশির চিপসের প্যাকেটের গল্পবলাদের গলা চেপে ধরতে।

  • সৈয়দ ফায়েজ আহমেদ প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক