Thank you for trying Sticky AMP!!

শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নে অন্তরায় পরস্পরবিরোধী অবস্থান

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চুক্তি সইয়ের ঐতিহাসিক মুহূর্ত

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৬তম বর্ষপূর্তি পালিত হচ্ছে। বরাবরের মতো পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন বিষয়ে সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে পরস্পরবিরোধী মতামত আমরা দেখতে পাচ্ছি।

চুক্তির অন্যতম পক্ষ জনসংহতি সমিতির সঙ্গে আলোচনা না করে ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি মূল্যায়ন, অগ্রগতি ও পরিবীক্ষণসংক্রান্ত আন্তমন্ত্রণালয় কমিটি’ নামে ১০ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে, যা পার্বত্য চুক্তির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।

আন্তমন্ত্রণালয় কমিটি ২৫ নভেম্বর ২০২২ তারিখের সভায় একতরফাভাবে প্রস্তুত করা প্রতিবেদনে চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৬৫টি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মতে, ৭২টি ধারার মধ্যে মাত্র ২৫টি বাস্তবায়িত হয়েছে। অবশিষ্ট ৪৭টি ধারা হয় আংশিক বাস্তবায়িত, না হয় সম্পূর্ণ অবাস্তবায়িত রয়েছে। 

বিশেষ করে, চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো যেমন পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি–অধ্যুষিত বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ, আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদসংবলিত পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন এবং এসব পরিষদের নির্বাচনের জন্য স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে ভোটার তালিকা প্রণয়ন, ভূমি কমিশনের মাধ্যমে ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি করে জুম্মদের বেহাত হওয়া জায়গাজমি প্রত্যর্পণ, ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ পাহাড়ি উদ্বাস্তুদের তাদের জায়গাজমি প্রত্যর্পণপূর্বক পুনর্বাসন, অস্থানীয়দের নিকট প্রদত্ত ভূমি লিজ বাতিল, ভূমিহীন জুম্মদের ভূমি বন্দোবস্তি প্রদান, চুক্তি মোতাবেক পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রযোজ্য সব আইন সংশোধন, পার্বত্য চট্টগ্রামের সব চাকরিতে জুম্মদের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়োগ ইত্যাদি এখনো অবাস্তবায়িত অবস্থায় রয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ‘ক’ খণ্ডের ১ নম্বর ধারায় ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে উপজাতি–অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে বিবেচনা করে এই অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ’-এর বিধান করা হয়েছে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে ২৩(ক) উপ–অনুচ্ছেদে বাংলাদেশের উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের ভাষা ও সংস্কৃতি বিকাশ ও সংরক্ষণের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি–অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য নিশ্চিত করা হয়েছে বলে সরকার দাবি করছে। কিন্তু বাস্তবে সেটা হয়নি।  

পার্বত্য চুক্তির ‘খ’ খণ্ডে পার্বত্য জেলা পরিষদসংক্রান্ত ৩৫টি ধারার মধ্যে ৩৩টি ধারা পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনে সংযোজনের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়েছে বলে সরকার দাবি করছে। কিন্তু আইনে সংযোজিত হলেও সেগুলো এখনো কার্যকর করা হয়নি। যেমন ‘অ–উপজাতীয় স্থায়ী বাসিন্দা’ সংজ্ঞাসংক্রান্ত চুক্তির ‘খ’ খণ্ডের ৩ নম্বর ধারা তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে সত্য, কিন্তু কার্যকর করা হয়নি। 

পার্বত্য জেলা পরিষদের পূর্বানুমোদন ব্যতীত ভূমি বন্দোবস্তি, হস্তান্তর, ক্রয়-বিক্রয়, ইজারা প্রদান, অধিগ্রহণে বিধিনিষেধসংক্রান্ত চুক্তির ‘খ’ খণ্ডের ২৬ নম্বর ধারাটির বাস্তবায়ন কার্যক্রম চলমান বলে সরকার দাবি করছে। বস্তুত বিধানটি আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হলেও ইহা কার্যকর করা হচ্ছে না। চুক্তির ‘খ’ খণ্ডের ৩৪(ক) ধারা মোতাবেক ‘ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা’ বিষয়টি পার্বত্য জেলা পরিষদের আওতাধীন অন্যতম একটা বিষয়।

কিন্তু আজ অবধি উক্ত বিষয়টি পার্বত্য জেলা পরিষদের নিকট হস্তান্তর করা হয়নি। হেডম্যান, চেইনম্যান, আমিন, সার্ভেয়ার, কানুনগো ও সহকারী কমিশনারদের (ভূমি) কার্যাদিও পার্বত্য জেলা পরিষদের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণাধীন করা হয়নি।

তিন পার্বত্য জেলার সাধারণ প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা ও উন্নয়নের ব্যাপারে আঞ্চলিক পরিষদ সমন্বয় সাধন ও তত্ত্বাবধান করার বিধানটি আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হলেও কার্যকর করা হয়নি।

তিন পার্বত্য জেলার ডেপুটি কমিশনারগণ অপারেশন উত্তরণের পাশাপাশি পার্বত্য অঞ্চলে পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি ১৯০০ অনুযায়ী আগের মতো জেলার সাধারণ প্রশাসন–সম্পর্কিত সব ক্ষমতা প্রয়োগ করে চলেছেন। তাই আঞ্চলিক পরিষদসংক্রান্ত সব কটি ধারা সম্পূর্ণ ‘বাস্তবায়িত’ হয়েছে মর্মে সরকারের অভিমত সঠিক নয়। 

পার্বত্য চট্টগ্রামসংক্রান্ত আইন প্রণয়নে আঞ্চলিক পরিষদের প্রাধিকারসংক্রান্ত চুক্তির ‘গ’ খণ্ডের ১৩ নম্বর ধারা পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইনে সংযোজনের মাধ্যমে ধারাটিকে বাস্তবায়িত বলে মনে করে সরকার।

বস্তুত চুক্তির এই ধারা অনুসরণ করা হচ্ছে না। আইন প্রণয়নে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আঞ্চলিক পরিষদের মতামত নেওয়া হয় না কিংবা নেওয়া হলেও আঞ্চলিক পরিষদের মতামত কার্যকর করা হয় না। 

‘ভারত প্রত্যাগত পাহাড়ি শরণার্থী প্রত্যাবাসন ও পুনর্বাসনসংক্রান্ত’ চুক্তির ‘ঘ’ খণ্ডের ১ নম্বর ধারাটি বাস্তবায়িত হয়েছে মর্মে সরকার দাবি করছে। কিন্তু জুম্ম শরণার্থী কল্যাণ সমিতির মতে, ৯ হাজার ৭৮০টি পরিবার তাদের ভিটেমাটি ও জায়গাজমি ফেরত পায়নি ও অন্য দাবিগুলো বাস্তবায়ন করা হয়নি। ভারত প্রত্যাগত শরণার্থীদের ৪০টি গ্রাম, ভিটেমাটি ও জায়গাজমি এখনো সেটেলার বাঙালিদের পুরো দখলে রয়েছে। তাই এ বিধান ‘সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত’ হয়েছে মর্মে সরকারের অভিমত সঠিক নয়।

উল্লেখ্য যে ৬ অক্টোবর ২০১৬ জাতীয় সংসদে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধন) আইন ২০১৬ পাসের মধ্য দিয়ে ১৫ বছর পর ২০০১ সালে প্রণীত ভূমি কমিশন আইনের বিরোধাত্মক ধারা সংশোধন করা হয়।

আইন সংশোধনের পর ভূমি কমিশনের বিধিমালার খসড়া তৈরি করে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের তরফ থেকে ১ জানুয়ারি ২০১৭ ভূমি মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সরকার এখনো সেই বিধিমালা চূড়ান্ত করেনি। এর ফলে ভূমি কমিশনের ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তির বিচারিক কাজ এখনো শুরু করা যায়নি। 

ফলে পরস্পরবিরোধী অবস্থান থেকে সরে এসে চুক্তি বাস্তবায়নে দুই পক্ষকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। পার্বত্য চুক্তির পূর্ণাঙ্গ ও দ্রুত বাস্তবায়নের মাধ্যমেই কেবল পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার টেকসই ও শান্তিপূর্ণ সমাধান হতে পারে।

মঙ্গল কুমার চাকমা পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির তথ্য ও প্রচার সম্পাদক