Thank you for trying Sticky AMP!!

দুর্যোগে সরকার নিখোঁজ

‘ধরে নিন সরকারকে এই ধরনের দুর্যোগে আপনি পাবেন না। তবে সাবধান! এসব নিয়ে বেশি বেশি বললে বা লিখলে ঘরের দরজায় সরকার এসে হাজিরও হতে পারে।’

ঢাকা শহরের ডানে-বাঁয়ে যেদিকে তাকাবেন, আপনি কেবল সরকারকে দেখতে পাবেন। সোনারগাঁওয়ের উল্টো দিক দিয়ে কারওয়ান বাজারে ঢুকুন, চওড়া রাস্তার অর্ধেকজুড়ে একাধিক সরকারি প্রতিষ্ঠানের সারি সারি গাড়ি। এখান থেকে সচিবালয়ের দিকে যান—অলিগলি, আনাচকানাচে কেবল সরকার আর সরকার।

সড়ক ও জনপথের বিশাল ইমারত, স্থাপত্য অধিদপ্তরের নান্দনিক ভবন, প্রেসক্লাবের উল্টো দিকে তোপখানা মোড়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন কি যেন অফিস, সচিবালয় ফেলে এগোলে বিশাল এলাকাজুড়ে পুলিশ সদর দপ্তর। পাশে প্রাসাদসম ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন কার্যালয়। এগোতে থাকুন। পেয়ে যাবেন ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের কার্যালয়।

এবার এখান থেকে আগারগাঁওয়ের দিকে রওনা হন। সরকারের সুরম্য সব ভবন। এর মধ্যে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের গায়ে লেখা, ‘এখানে আপনার একটি স্বপ্ন জমা আছে’। শহরের আর কোথায় কত জায়গা নিয়ে কী কী স্থাপনা আর তাতে কারা থাকেন, সেদিকে আর গেলাম না।

তো ‘স্বপ্ন জমা রাখা’ এই সৌকর্যমণ্ডিত ভবন ফেলে এগোতে থাকলে আপনি মিরপুর পৌঁছে যাবেন। গত বৃহস্পতিবার এক সন্ধ্যার বৃষ্টিতে ঢাকার অন্যান্য এলাকার মতো মিরপুরও তলিয়ে যায়। পানিতে বিদ্যুতের তার পড়ে থাকায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে সেখানে চারজন ‘গরিব মানুষ’ মারা গেছেন। অলৌকিকভাবে বেঁচে যায় মিজান ও মুক্তা দম্পতির সাত মাস বয়সী শিশুপুত্র হোসাইন। মৃত্যু আসন্ন বুঝতে পেরে মিজান নাকি কাঁধে থাকা ছেলেকে পানিতে ছুড়ে ফেলেছিলেন।

আশপাশের লোকজন ডুবতে বসা হোসাইনকে বাসায় নিয়ে শুশ্রূষা করেন। পরে নাক দিয়ে রক্ত ঝরতে শুরু করলে ঝিলপাড় বস্তির নারী আমেনা ও হিজড়া সম্প্রদায়ের একজন তিনটি হাসপাতাল ঘুরে শিশুটিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেন।

ধরে নিন সরকারকে এই ধরনের দুর্যোগে আপনি পাবেন না। তবে সাবধান! এসব নিয়ে বেশি বেশি বললে বা লিখলে ঘরের দরজায় সরকার এসে হাজিরও হতে পারে। শামসুর রাহমানের ‘রাজকাহিনী’ নামের একটা কবিতা আছে, ‘...ঢ্যাম কুড় কুড় বাজনা বাজে/ পথে-ঘাটে সান্ত্রী সাজে/ শোনো সবাই হুকুমনামা/ ধরতে হবে রাজার ধামা/ বাঁ দিকে ভাই চলতে মানা/ সাজতে হবে বোবা-কানা/ মস্ত রাজা হেলে দুলে/ যখন-তখন চড়ান শূলে/ মুখটি খোলার জন্য/ ধন্য রাজা ধন্য।’

পুরো ঘটনায় আপনি সরকারকে দেখতে পাবেন শুধু বিদ্যুতের ছেঁড়া তারে। এর বাইরে শিশু হোসাইনের অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া, তাকে পানি থেকে উদ্ধার, শুশ্রূষা বা অন্ধকার রাতে পানি ভেঙে তাকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়া পর্যন্ত কোথাও সরকারের নামগন্ধ পাবেন না।

ঢাকা ট্রিবিউন বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি ডেসকোর পরিচালক মো. কাওসার আমির আলীকে উদ্ধৃত করেছে। তিনি বলেছেন, মূল বিদ্যুৎ লাইন ছিঁড়ে পড়েনি। তাঁর ধারণা, বস্তির কোনো লাইন থেকে এটা হতে পারে। তিনি আরও দাবি করেছেন, বস্তিতে ১০টি ঘরের জন্য তাঁরা একটি লাইন ও মিটার দেন। ১০ পরিবার একসঙ্গে লাইনটি ব্যবহার করে। তাঁদের দায়িত্ব মিটার পর্যন্ত সংযোগ দেওয়া। ভেতরের বিষয় তাঁদের পক্ষে দেখা সম্ভব নয়।

অবৈধ সংযোগ কেউ দিচ্ছে কি না, সেটা দেখা তাহলে ডেসকোর দায়িত্ব নয়? বাহ্‌! চমৎকার তো। অবৈধ সংযোগ তাহলে বস্তিবাসীরা ‘ফ্রি’তে নেন? ডেসকোর কেউ কিছু জানেন না? তাদের ওয়েবসাইটের ভিশন ও মিশনের এক নম্বরে তো আছে—নিরাপদ, নির্ভরযোগ্য ও টেকসই বিদ্যুৎ সেবা প্রদানের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক অগ্রগতিতে সহায়ক হওয়া। যাক, অন্তত নিরাপদে সেবা প্রদানের কথা কাগজে আছে। আবার চারজনের মৃত্যুর পর তারা দুর্বোধ্য ভাষায় একটা দুঃখও প্রকাশ করেছে।

Also Read: উন্নয়নের বয়ান আর চিপসের প্যাকেটের গল্পে মোড়া শিশুর লাশ

চলুন বলি মারহাবা। তা-ও তো বিদ্যুৎ বিভাগ দুঃখ প্রকাশ করেছে। যাঁরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে থেকেও একটি যানবাহন জোগাড় করতে পারেননি, তাঁদের জন্য রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশের টিকিটিও দেখা যায়নি। সরকারের জরুরি সেবার আওতায় যেসব অ্যাম্বুলেন্স ছিল, সেগুলোই-বা কোথায় ছিল? ঢাকার দুই মেয়র তখন কী করছিলেন, কে জানে। তাঁদের মাথায় নিশ্চয়ই আসেনি যে এই দুর্যোগে তাঁদের মানুষের পাশে দাঁড়ানো দরকার। মেয়ররাই যখন উধাও, তখন স্থানীয় কাউন্সিলররা আর কীই-বা করবেন। তাঁরাও হয়তো চাদর মুড়ি দিয়ে বৃষ্টি উপভোগ করেছেন।

তবে মানুষও বুঝে গেছে, তাদের এখন আল্লাহর হাওলায় নিজেকে সঁপে দেওয়া ছাড়া গতি নেই। ট্রাফিক অ্যালার্ট নামের একটি ফেসবুক গ্রুপে সেদিন মানুষের তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। তাঁরাই ঢাকার নানা জায়গা থেকে ছবি-ভিডিও এই গ্রুপে পোস্ট করে একে অপরকে সাহায্য করেছেন। তাঁরা না হয় কোনোরকমে জান বাঁচিয়েছেন। বাজারে ব্যবসায়ীরা চালসহ নিত্যপণ্যের বস্তা সরাতে পারেননি। ভেজা চাল পরদিন যে দামে পেরেছেন, সেই দামে বিক্রি করে দিয়েছেন। তাঁদের জন্যও সরকারের কোনো সংস্থা এগিয়ে আসেনি।

দেশে দুর্যোগকে এত গুরুত্ব দেওয়া হয় যে গোটা একটা মন্ত্রণালয় আছে। আইনকানুনও আছে যথেষ্ট। সেই আইনই বলছে, প্রাকৃতিক বা মানুষের সৃষ্ট কারণ বা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যদি এমন কিছু ঘটে যে জীবন, জীবিকা, স্বাভাবিক জীবনযাত্রা, সম্পদ, সম্পত্তি ইত্যাদির ক্ষতি হয় এবং ত্রাণ বা বাইরের কোনো সহযোগিতার প্রয়োজন হয়, তখন সেটা দুর্যোগ। দুর্যোগের মধ্যে থাকা অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে অতিবৃষ্টিও একটি।

মানুষ যখন এক বেলা বৃষ্টিতে ঢাকার তলিয়ে যাওয়া আর জান হাতে করে বাড়ি ফেরার স্মৃতি ভুলতে পারছে না, তখন সরকার হাজির না হলেও সহমত ভাইদের দেখা গেল। তাঁরা এখন দেদার ছবি বিলাচ্ছেন। এবারও দোষ সাধারণ মানুষের। ম্যানহোলের ভেতর থেকে টেনে টেনে প্লাস্টিকের বোতল তোলা হচ্ছে শত শত। জলাবদ্ধতার জন্য লোকের যত্রতত্র চিপসের প্যাকেট, পলিথিনের ব্যাগ ফেলাকেও দায়ী করা হচ্ছে। বলি, দেশে তো প্লাস্টিক বন্ধের জন্য আইনও আছে। আইনটা পাস হয়েছিল বিএনপি আমলে। কড়াকড়িতে প্লাস্টিকের ওপর নির্ভরতাও কমে এসেছিল। পানি-জুসের বোতল কোথায় ফেলতে হবে, তার জন্য নির্ধারিত কোনো নিয়ম কি সিটি করপোরেশন করে দিয়েছে? কিংবা চিপসের প্যাকেট?

ধরে নিন সরকারকে এই ধরনের দুর্যোগে আপনি পাবেন না। তবে সাবধান! এসব নিয়ে বেশি বেশি বললে বা লিখলে ঘরের দরজায় সরকার এসে হাজিরও হতে পারে। শামসুর রাহমানের ‘রাজকাহিনী’ নামের একটা কবিতা আছে, ‘...ঢ্যাম কুড় কুড় বাজনা বাজে/ পথে-ঘাটে সান্ত্রী সাজে/ শোনো সবাই হুকুমনামা/ ধরতে হবে রাজার ধামা/ বাঁ দিকে ভাই চলতে মানা/ সাজতে হবে বোবা-কানা/ মস্ত রাজা হেলে দুলে/ যখন-তখন চড়ান শূলে/ মুখটি খোলার জন্য/ ধন্য রাজা ধন্য।’

এই কবিতা উচ্চারণ করে বারবার পড়বেন নাকি লুকিয়ে, সে আপনার অভিরুচি।

● শেখ সাবিহা আলম প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক