Thank you for trying Sticky AMP!!

ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়া হারলেও লাভবান হবেন পুতিন

ভ্লাদিমির পুতিন

ঠিক দুই বছর আগে রাশিয়ায় বিরোধী নেতা আলেক্সি নাভালনির গ্রেপ্তারে সেখানে প্রচণ্ড বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল। অনেকের কাছে ২০২১ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়াজুড়ে ছড়িয়ে পড়া ওই বিক্ষোভের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ইউক্রেন আক্রমণের যোগসূত্র আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু আসলে এই দুই ঘটনার যোগসূত্র আছে এবং খুব ঘনিষ্ঠভাবেই আছে।

আসুন, ঘটনাগুলো একটু তলিয়ে দেখি। ২০২০ সালে নাভালনিকে জার্মানির একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। পরে ইউরোপের দুটি শীর্ষস্থানীয় সংবাদমাধ্যমের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়, রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা নাভালনির শরীরের উচ্চমাত্রার বিষ প্রয়োগ করেছিলেন। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েই নাভালনি অনেককে চমকে দিয়ে পাঁচ মাস পর রাশিয়ায় ফিরে আসেন। তিনি বিমানবন্দরে পা রাখামাত্রই তাঁকে গ্রেপ্তার করে জেলে নেওয়া হয় এবং এখন পর্যন্ত তিনি সেখানেই আছেন।

নাভালনিকে গ্রেপ্তারের কয়েক সপ্তাহ পরই রাশিয়ার ১৮৫টি শহরে তাঁর মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। রাশিয়ায় রাজনৈতিক দমন–পীড়নের ওপর নজর রাখে, এমন সংস্থা ওভিডি-ইনফো বলেছে, ওই বিক্ষোভ দমনে পুতিন সরকার ১১ হাজারের বেশি লোককে আটক করে, বহু লোক নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে আহত হন এবং ৯০ জনের বেশি লোকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হয়।

যে প্রধান কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়ে পুতিন দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতা আঁকড়ে রয়েছেন, সেটি হলো অভ্যন্তরীণ যেকোনো সমস্যা থেকে দেশের মানুষের দৃষ্টিকে অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া। ঠিক সেই নীতি ধরে নাভালনির মুক্তি চাওয়া বিক্ষোভকারীদের দমনের দুই মাসের কম সময়ের মধ্যে পুতিন ইউক্রেন সীমান্তে ব্যাপক মাত্রায় সেনা সমাবেশ ঘটানোর আদেশ দেন এবং সেটিই ছিল এক বছর পরে ইউক্রেনে সর্বাত্মক অভিযানের গৌরচন্দ্রিকা। এখন একটু ঠান্ডা মাথায় ভাবলেই বোঝা যাবে রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা এবং ইউক্রেন যুদ্ধ—এই দুটি বিষয়ের মধ্যে গভীর যোগসূত্র রয়েছে। ইউক্রেনে হামলা করে পুতিন তাঁর নিজ দেশের জনগণের সঙ্গে সংঘাত এড়িয়েছেন এবং বিরোধী দলকে কোণঠাসা করে রাখতে সক্ষম হয়েছেন।

অবশ্য অভ্যন্তরীণ অস্থিরতাই যে পুতিনের ইউক্রেন অভিযানের একমাত্র কারণ তা নয়। খেয়াল করে দেখুন, জো বাইডেন যে মাসে হোয়াইট হাউসে ঢুকেছিলেন, ঠিক সেই মাসেই ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি তাঁর রাশিয়া নীতিতে আমূল পরিবর্তন এনেছিলেন। জেলেনস্কি ইউক্রেনে পুতিনের প্রধান মিত্র ভিক্তর মেদভেদচুকের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আক্রমণ শুরু করেছিলেন। যুগপৎভাবে তিনি ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার তোড়জোড় শুরু করেছিলেন এবং নর্ড স্ট্রিম ২ গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্প থেকে ইউক্রেনকে সরিয়ে আনার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন।

মেদভেদচুক তখনো জেলেনস্কির সঙ্গে রাজনৈতিক খেলা চালিয়ে যাচ্ছিলেন এবং পূর্ব ইউক্রেনের দনবাস এলাকায় নিজের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য তিনি তখন চাইলে কোনো রকম অভিযান না চালিয়ে ধীরে চলার নীতি অনুসরণ করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা না করে সরাসরি সেখানে সামরিক অভিযান চালালেন, যা নাভালনির মুক্তির দাবিতে ওঠা বিক্ষোভ ও বিরোধীদের তৎপরতা থেকে সবার দৃষ্টি একেবারে ঘুরিয়ে দিল।

পুতিন এবং তাঁর মিত্ররা বরাবরই বিশ্বাস করে আসছেন, নাভালনি এবং তাঁর সমর্থকেরা পশ্চিমাদের চর এবং ইউক্রেনে ময়দান বিক্ষোভখ্যাত আন্দোলনের মাধ্যমে যেভাবে পশ্চিমাপন্থী আন্দোলনকারীরা পুতিনপন্থী নেতা ইয়ানুকোভিচকে উৎখাত করেছিলেন, সেই একই কায়দায় নাভালনিও পশ্চিমা মদদ নিয়ে রাশিয়ায় পুতিন উৎখাতের চেষ্টা করেছেন। ময়দান বিক্ষোভের জন্য ইউক্রেনবাসীকে সাজা দিতেই যে রাশিয়া ২০১৪ সালে ইউক্রেনে প্রথম দফা হামলা চালিয়েছিল, তাতে সন্দেহ নেই; তবে এর মধ্য দিয়ে পুতিন রাশিয়ার মানুষকেও এই বার্তা দিতে চেয়েছেন যে যদি তাঁরা ইউক্রেনবাসীর মতো আন্দোলনে নামে, তাহলে তাদেরও একই ধরনের পরিণতি বরণ করতে হবে। কিন্তু এই হামলা পুতিনকে আরও অজনপ্রিয় করে ফেলেছিল।

২০১৮ সালে লেভাডা সেন্টার নামের একটি প্রতিষ্ঠানের চালানো জরিপে দেখা যায়, রাশিয়ার ৫৭ শতাংশ মানুষ দেশটিতে ‘সর্বাত্মক পরিবর্তন’ চায়। তার পরের বছর সেই সংখ্যা ৫৯ শতাংশে গিয়ে দাঁড়ায়। ঠিক ওই সময় নাভালনি প্রেসিডেন্ট পদে লড়াইয়ের প্রচার চালাচ্ছিলেন এবং নজিরবিহীন–সংখ্যক সমর্থক নিয়ে সভা সমাবেশ করছিলেন। এটি ক্রেমলিনকে আতঙ্কগ্রস্ত করে। এ কারণে নাভালনিকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। এরপর ইউক্রেনে সর্বাত্মক হামলা পুতিনকে অভ্যন্তরীণ সব বিরোধীদের কোণঠাসা করার সুযোগ করে দেয়। লেভাডার সর্বশেষ জরিপে দেখা যাচ্ছে, ২০২২ সালে রাশিয়ায় ‘সর্বাত্মক পরিবর্তন’ চাওয়া লোকের সংখ্যা ৪৭ শতাংশে নেমে এসেছে।

বর্তমানে নাভালনি এবং প্রধান প্রধান বিরোধী নেতা জেলে পচছেন। বাকিদের কেউ গৃহবন্দী, কেউ নির্বাসনে আছেন। নিরপেক্ষ সাংবাদিক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাসহ হাজার হাজার পুতিনবিরোধী লোক রাশিয়া ছেড়ে পালিয়েছেন।

ফলে পুতিন যদি এখন ইউক্রেন যুদ্ধে হেরেও যান, তাহলেও তিনি দেশের ভেতরে অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি স্থিতিশীল অবস্থায় থাকবেন। দিন শেষে পশ্চিমা অবরোধের অধীনে থাকা দেশগুলোর সরকারের চেয়ে বেশি স্থিতিশীল সরকার আর হতে পারে না। ইরান, কিউবা ও উত্তর কোরিয়া তার বড় উদাহরণ।

সেই জায়গা থেকে বিবেচনা করলে, ইউক্রেনে রাশিয়ার জয় হোক বা না হোক, এতে পুতিন যে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

  • লিওনিড রাগোজিন রিগাভিত্তিক একজন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক