Thank you for trying Sticky AMP!!

দোকানে–পরিবহনে চাঁদাবাজি: এ কেমন জমিদারি, এ কেমন খাজনা আদায়

ঢাকা শহর থেকে বের হওয়ার পথে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে প্রবেশ করার মুখে এভাবে ট্রাকচালকদের জিম্মি করে চাঁদা আদায় করা হয়। গত ২৭ জুলাই রাত পৌনে ১২টায় রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর শনির আখড়ায়।

মনে পড়ছে ঘুমপাড়ানি এক ছড়ার কথা—‘খোকা ঘুমাল, পাড়া জুড়াল বর্গি এল দেশে, বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দিব কিসে?’ ছড়াটার লেখকের নাম পাওয়া যায় না। অন্যান্য অনেক ছড়ার মতো এটিও ‘সংগৃহীত’। সংগৃহীত হলেও তৎকালীন আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক অবস্থার অনেকটাই ধরা পড়ে সামান্য কয়েকটা লাইনে। বর্গির আগমনের খবর ছাড়া খাজনা দেওয়ার বিষয়টি যে প্রাচীনকাল থেকেই এখানকার মানুষের অন্যতম দুশ্চিন্তার কারণ, তা এই ছোট্ট ছড়ায় ফুটে উঠেছে।

বাংলার সাধারণ কৃষকের শত্রু ছিল অনেক। জমিদার ও তাঁর পাইক-পেয়াদার অত্যাচার যেমন ছিল, তেমনি ছিল প্রকৃতিসৃষ্ট বিপর্যয়। তুলনায় জমিদার বা অবস্থাপন্ন কৃষকের প্রাকৃতিক বিপদ ছিল কম।

কেননা ধনীদের জমিগুলো ছিল তুলনামূলকভাবে উঁচু জায়গায়। ফলে বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে যেখানে সাধারণ কৃষকের ফসল নষ্ট হতো, সেখানে অবস্থাপন্ন ব্যক্তিদের জমির ফসল থাকত সুরক্ষিত। অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, খরা, পোকার আক্রমণ ইত্যাদি দুর্যোগে এখানকার কৃষকেরা জর্জরিত থাকত। যত গরিব কৃষক, তত বেশি বিপদ। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা ছিল মাত্রাতিরিক্ত খাজনা। নানা কারণে খাজনা বাড়ত। খাজনা আদায় করা হতো ইচ্ছেমতো, নিয়মনীতির ধার ধারতেন না রাজা ও জমিদারেরা।

রাজকোষে টান পড়লেই নানা অজুহাতে খাজনা বাড়ানো হতো। খাজনা না দিতে পারলে জমিও হারাতেন কৃষক।

খাজনার এমন দিন এখন আর নেই, আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় জনগণের ওপর করের মাত্রা মোটামুটি সহনীয় থাকে। কিন্তু গরিব ও সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচার আগের মতোই আছে। ক্ষেত্রবিশেষে বেড়েছেও। আগে খাজনা দিতে হতো, এখন দিতে হয় চাঁদা। পদে পদে চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য। সাধারণ মানুষ কেউই চাঁদার আওতামুক্ত নন। কেউ প্রত্যক্ষ বা সরাসরি চাঁদা দেন, কেউ পরোক্ষভাবে চাঁদা দেন। চাঁদাবাজি এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে। চাঁদাবাজিকে ক্ষমতাসীন দলের অসৎ পান্ডাদের আয়ের প্রধান উৎস বললে বোধ করি ভুল হবে না।

গত ২৬ ডিসেম্বরের প্রথম আলোর এক খবরে জানা যায়, মুন্সিগঞ্জে ব্যাটারিচালিত রিকশা, ইজিবাইক ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা থেকে বিভিন্ন পয়েন্টে জোর করে চাঁদা আদায় করা হয়। গাড়িভেদে ১০ থেকে ৫০ টাকা চাঁদা দিতে হয় চালকদের। কেউ চাঁদা দিতে না চাইলে গাড়ির ক্ষতি করা হয় এবং চালককেও মারধর করা হয়। প্রতিকার চাইলে নতুন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। মুন্সিগঞ্জে পাঁচ থেকে ছয় হাজার এমন পরিবহন রয়েছে, যেগুলো থেকে প্রতিদিনই এই হারে চাঁদা আদায় করা হয়। সব সময়ের মতো ক্ষমতাসীন দলের লোকজনই এ কাজের সঙ্গে জড়িত। মুন্সিগঞ্জ শহর শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদকের নাম উঠে এসেছে খবরে।

প্রশাসন কোনো দিনই সাধারণ মানুষের সঙ্গে থাকে না, তাদের দৃষ্টি থাকে অ–সাধারণদের দিকে। বাধাই যখন দেওয়া যাচ্ছে না, তখন উপরি লাভেই বা আপত্তি কেন! কার্যত যা হয়, প্রশাসনের অনেকেই এসব দুষ্কর্মের সঙ্গে জড়িত থাকে। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে এসব ব্যাপারে প্রশাসনের কাউকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, তাহলে কয়েকটি মুখস্থ উত্তর পাওয়া যায়। ‘আমাদের কাছে কেউ অভিযোগ করেনি’, ‘অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে’, ‘তদন্তে সত্যতা পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে’, ‘দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে’ ইত্যাদি কয়েকটি বাক্যই প্রশাসনের লোকেরা বারবার ব্যবহার করতে পছন্দ করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁরা কী ব্যবস্থা নেন, সেটা কেউ কোনো দিন জানতে পারেন না।

চাঁদাবাজেরা হয় নিজেই ক্ষমতাসীন, নইলে তাঁরা ক্ষমতাসীনদের নিকটাত্মীয়। ক্ষমতার দাপট আর ‘আত্মীয়তার বন্ধনে’ সাধারণ মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত। প্রতিকার চাইতে গেলে আরও বড় বিপদে পড়ার আশঙ্কায় মানুষ মুখ খোলেন না। বর্গিরা চলে গেছে অনেককাল আগে, নতুন বর্গির অত্যাচার মাত্রা ছাড়িয়েছে।

শুধু মুন্সিগঞ্জ নয়, এ চিত্র পাওয়া যাবে ঢাকাসহ সারা দেশে। পরিবহন সেক্টরে এসব চাঁদাবাজি অনেক দিন ধরেই এমন প্রকাশ্যে চলছে। চালকেরা যখন ঘাটে ঘাটে চাঁদা দেন, তখন আসলে তাঁরা যাত্রীদের কাছ থেকেই এগুলো ‘উশুল’ করেন। ফলে বেড়ে যায় পরিবহনের ভাড়া। পরোক্ষভাবে প্রত্যেক যাত্রী এই চাঁদা দেন বা দিতে বাধ্য হন। পরিবহন খাতের পাশাপাশি অন্যান্য খাতেও দেদার চলছে চাঁদাবাজি।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ঠাটারী বাজারে ঝুঁকিপূর্ণ একটা বাজার ভেঙে ফেলার পর সেখানে খোলা জায়গায় ব্যবসা করতে দেওয়ার শর্তে চাঁদা নেন স্থানীয় কাউন্সিলরের লোকজন। অভিযোগ উঠেছে, দক্ষিণের ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আহমেদ ইমতিয়াজ মান্নাফী গত দুই বছরে ২ কোটি ৩০ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করেছেন দোকানমালিকদের কাছ থেকে। (প্রথম আলো, ১৫ নভেম্বর ২০২২) অথচ সিটি করপোরেশনের নিয়ম মেনেই ব্যবসায়ীরা দোকান বরাদ্দ নিয়েছিলেন। বাজারের ভবনটি ভেঙে ফেলার পর ভাড়া নিচ্ছিল না সিটি করপোরেশন, কিন্তু দোকানিরা নিয়মিত ভাড়া দিতে চাইছিলেন।

তখন দোকানিদের ‘সাহায্যার্থে’ এগিয়ে আসেন কাউন্সিলর সাহেব। ভবনের ভেতর যে দোকানমালিককে বৈধভাবে মাসিক ভাড়া ৮০০ টাকা দিতে হতো, সেই একই দোকানমালিককেই বাইরের খোলা জায়গায় অস্থায়ী দোকানের জন্য দৈনিক ভাড়া (আসলে চাঁদা) দিতে হয় ২৭০ টাকা। অর্থাৎ মাসে ৮ হাজার ১০০ টাকা, যা প্রকৃত ভাড়ার চেয়ে ১০ গুণের বেশি।

কাউন্সিলরের লোকজন এই বাজার থেকে দিনে ৩২ হাজার টাকা চাঁদা তোলেন। নতুন ভবন নির্মাণের কাজ আরও আগে শুরু হওয়ার কথা থাকলেও তা শুরু হয়নি। কেননা ভবন নির্মাণ করা হলে এই চাঁদাবাজি আর করা যাবে না। ভবন নির্মাণ বিলম্বিত করা গেলে তাই নানা পক্ষের লাভ বেশি। অস্থায়ী ব্যবস্থায় কেবল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন মাছ ও সবজি বিক্রেতা সাধারণ দোকানমালিকেরা। দোকানমালিকদের এই চাঁদার প্রভাবে মাছ ও সবজির দাম বেড়ে যাওয়া স্বাভাবিক। আর এবারও চাঁদার টাকা পরোক্ষভাবে যায় সাধারণ মানুষের পকেট থাকে।

সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলররা হলেন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। এলাকার লোকের সুবিধা-অসুবিধা দেখার জন্য তাঁদের নির্বাচিত করা হয়। তাঁরা যদি এমন চাঁদাবাজি করেন, তাহলে সাধারণ মানুষ কার কাছে গিয়ে অভিযোগ জানাবেন? একজন সাধারণ চাঁদাবাজের তুলনায় তাই এ ধরনের পদে থাকা মানুষের চাঁদাবাজির অভিঘাত অনেক বেশি।

এখন বাংলার হাটে, মাঠ, ঘাটে সবখানেই চাঁদাবাজের দৌরাত্ম্য। প্রশাসনের নাকের ডগা দিয়ে এসব কাজকর্ম হলেও সবাই যেন দেখেও না দেখার ভান করেন। সম্প্রতি চাঁপাইনবাবগঞ্জের এক ব্যবসায়ীকে চাঁদার জন্য প্রথমে পিটিয়ে, তারপর নগ্ন করে প্রকাশ্য রাস্তায় হাঁটানো হয়েছে। সন্ত্রাসীরা শুধু এতেই থেমে থাকেননি, চাঁদা না পেয়ে পুরো ঘটনা ভিডিও করে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিয়েছেন। (প্রথম আলো, ২২ ডিসেম্বর ২০২২) ওই ব্যবসায়ী পাওনা টাকা চাইতে গিয়ে এই বিপাকে পড়েন। ‘বিচার হবে না’, ‘কেউ কিছু করতে পারবে না’ এমন আত্মবিশ্বাস না থাকলে এ ঘটনার ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া যায় না। ঘটনার দুই দিন পর ভিডিওটি পুলিশের হাতে গেলে তাদের আশ্বাসে ভুক্তভোগী লোকটি মামলা করেছেন। মামলার ১ নম্বর আসামি আবু বাক্কার চাঁপাইনবাবগঞ্জের পৌর মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতা মোখলেসুর রহমানের চাচাতো ভাই। ফলে বোঝাই যায়, তাঁর আত্মবিশ্বাসের গোড়ায় ক্ষমতার জলের পরিচর্যা রয়েছে।

ওপরের সব কটি ঘটনায়ই একটা বিষয়ে মিল পাওয়া যায়। চাঁদাবাজেরা হয় নিজেই ক্ষমতাসীন, নইলে তাঁরা ক্ষমতাসীনদের নিকটাত্মীয়। ক্ষমতার দাপট আর ‘আত্মীয়তার বন্ধনে’ সাধারণ মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত। প্রতিকার চাইতে গেলে আরও বড় বিপদে পড়ার আশঙ্কায় মানুষ মুখ খোলেন না। বর্গিরা চলে গেছে অনেককাল আগে, নতুন বর্গির অত্যাচার মাত্রা ছাড়িয়েছে। দেশের সবখানে এই অরাজক অবস্থার পেছনে প্রধানত ক্ষমতাসীন দলের অসৎ লোকেরা জড়িত। কিন্তু সরকারের কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেই। আকবর আলি খান তাঁর শুয়োরের বাচ্চাদের অর্থনীতি বইয়ের এক জায়গায় যথার্থই লিখেছেন, ‘উন্নয়নশীল দেশের জনগণকে তাদের সরকারকে বলতে হবে, “হুজুর আমরা আপনার কাছে উপকার চাই না, শুধু মেহেরবানি করে আপনার শুয়োরের বাচ্চাদের সামলান।”’ উন্নয়নের দরকার আছে, কিন্তু সুশাসন নিশ্চিত করা তার চেয়ে বেশি জরুরি।

  • মেহেদি রাসেল কবি ও প্রাবন্ধিক। ইমেইল: mehedirasel32@gmail.com