Thank you for trying Sticky AMP!!

‘বিসিএস–জ্বর’ থেকে তরুণদের বাঁচাবে কে

বাংলাদেশের বর্তমান তরুণ প্রজন্ম মারাত্মক এক জ্বরে আক্রান্ত। জ্বরটির নাম ‘বিসিএস–জ্বর’। প্রতিবছর কেবলই বাড়ছে বিসিএস–জ্বরে আক্রান্ত তরুণ-তরুণীর সংখ্যা। যত দিন যাচ্ছে, ততই যেন স্থায়ীভাবে তরুণ প্রজন্মকে গ্রাস করে ফেলছে এই জ্বর। বিসিএসের প্রতি উন্মাদনা তাঁদের আত্মবিশ্বাস ও সৃজনশীলতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, সম্ভাবনা বিকাশের পথ রুদ্ধ করে ফেলছে।

বাংলাদেশে প্রতিবছরই জ্যামিতিক হারে বাড়ছে বিসিএস পরীক্ষার্থীর সংখ্যা। পরিসংখ্যান সংরক্ষণের ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডোমিটারসের তথ্যমতে, এ বছর ৪৫তম বিসিএস পরীক্ষায় আবেদনকারীর সংখ্যা ছিল পৃথিবীর ৫৪টি দেশ ও অঞ্চলের জনসংখ্যার চেয়েও বেশি। প্রায় প্রতিবছরই এই ধরনের পরিসংখ্যান প্রকাশিত হতে দেখছি আমরা।

Also Read: এত বিসিএস পরীক্ষার্থী লইয়া দেশ কী করিবে!

সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে ৪১তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফলাফল। সেখানে দেখা গেছে এই বিসিএসে মোট ৪ লাখ ৭৫ হাজার প্রার্থীর আবেদনের বিপরীতে ২ হাজার ৫২০ জন প্রার্থীকে বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। অর্থাৎ আবেদনকারীর বিপরীতে চূড়ান্তভাবে নিয়োগের জন্য সুপারিশকৃতের হার দশমিক ৫৩। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, শতকরা প্রায় ৯৯ দশমিক ৫ শতাংশ বিসিএস চাকরিপ্রত্যাশী প্রার্থী স্বপ্নভঙ্গের বেদনা নিয়ে কর্মবাজারে হাজির হতে যাচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে আবার উল্লেখযোগ্য একটি অংশ বয়সের যোগ্যতা সাপেক্ষে উত্তীর্ণ না হওয়া পর্যন্ত বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিতেই থাকবেন। বিসিএসের এই মরীচিকার পেছনে ছুটতে ছুটতে তারুণ্যের উৎপাদনশীল গুরুত্বপূর্ণ বছরগুলোর অপমৃত্যু ঘটছে। প্রশ্ন হলো, বিসিএস চাকরি কি করতেই হবে?

তীব্র প্রতিযোগিতামূলক এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার বিষয়টি অবশ্যই কৃতিত্বের দাবি রাখে। তাই বলে বিসিএসে উত্তীর্ণ হলেই তাঁরা মেধার শীর্ষে, এই ধরনের প্রচারণাগুলো বিভ্রান্তিকর ও অমূলক। পেশাগত জীবনের সাফল্য কখনোই নির্দিষ্ট কিছু চাকরিতে নিয়োগপ্রাপ্তির মানদণ্ডে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরিতে সুযোগপ্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিতভাবেই ব্যক্তির বিকশিত হওয়ার সম্ভাবনার পথটি অবারিত করে। কিন্তু পেশাগত জীবনের সাফল্যের মানদণ্ডটি হওয়া উচিত কর্মক্ষেত্রে ব্যক্তির প্রকৃত অবদানের ভিত্তিতে। সেই পেশাটি হতে পারে একজন কৃষিজীবীর, মজুরের, শিক্ষকের, বিজ্ঞানীর, চিকিৎসকের, সরকারি কর্মকর্তার কিংবা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার।

বিসিএস চাকরির বিকল্প হিসেবে যেন আর কিছুই ভাবতে পারছেন না তরুণেরা। আর ভাববেনই-বা কীভাবে? চোখের সামনে আমলাদের আকাশছোঁয়া ক্ষমতার চোখধাঁধানো উৎসব তরুণ মনকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। এর সঙ্গে আজকাল যুক্ত হয়েছে কাণ্ডজ্ঞানহীন ও অসংবেদনশীল সংবাদ শিরোনাম। তরুণদের বিসিএস উন্মাদনাকে পুঁজি করে অনেক সংবাদমাধ্যম নেমে পড়েছে ভিউ বাড়ানোর অস্বাস্থ্যকর যুদ্ধে। বিসিএস নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণরা যেন একেকজন তারকা!

Also Read: স্বপ্নের বিসিএস জোয়ার, অন্য পেশার স্বীকৃতি মিলছে কি?

বিসিএস স্বপ্নের বীজ তরুণ প্রজন্মের মনে অঙ্কুরিত হয়ে শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে তাঁদের আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। বিসিএস চাকরির বিকল্প হিসেবে যেন আর কিছুই ভাবতে পারছেন না তাঁরা। আর ভাববেনই-বা কীভাবে? চোখের সামনে আমলাদের আকাশছোঁয়া ক্ষমতার চোখধাঁধানো উৎসব তরুণ মনকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। এর সঙ্গে আজকাল যুক্ত হয়েছে কাণ্ডজ্ঞানহীন ও অসংবেদনশীল সংবাদ শিরোনাম।

তরুণদের বিসিএস উন্মাদনাকে পুঁজি করে অনেক সংবাদমাধ্যম নেমে পড়েছে ভিউ বাড়ানোর অস্বাস্থ্যকর যুদ্ধে। বিসিএস নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণরা যেন একেকজন তারকা! তাঁদের নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার গল্পগুলো চটকদার শিরোনামে আজকাল এতটাই অতিরঞ্জিতভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে, যা আরও বেশিসংখ্যক তরুণ-তরুণীকে বিসিএস–জ্বরে আক্রান্ত করছে। বিসিএসের প্রতি মোহগ্রস্ত তরুণকে আকৃষ্ট করতে সংবাদ শিরোনাম হয়ে উঠছে, ‘সাতবার বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিয়ে উত্তীর্ণ হওয়ার গল্প’ কিংবা এ রকম সস্তা শিরোনামের গল্প। শুধু বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে কেন জীবনের সাতটি বছর নষ্ট করতে হবে, সেই প্রশ্ন কেউ তুলছেন না। জীবনের পণ করে কেন বিসিএস ক্যাডার হতে হবে?

Also Read: মুখস্থনির্ভর বিসিএস পরীক্ষা আর কত দিন

শ্রদ্ধেয় শিক্ষক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেছেন, ‘দেশ আজ প্রশাসকে ভরে গেছে। যেদিকে তাকানো যায়, শুধুই প্রশাসক।’ প্রশাসক হওয়ার এই নেশা আচ্ছন্ন করে ফেলছে, এমনকি ডাক্তারি কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়া তরুণটিকেও। ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ে আজকাল তরুণেরা আর ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হতে চান না। তাঁরা প্রশাসক হতে চান। মনে পড়ে, ৪০তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে নিয়োগ পাওয়া ২৪৫ জনের মধ্যে ৫৫ জনই ছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে পাস করা শিক্ষার্থী। এই ধারা এখনো অব্যাহত আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গুণগত মান আজকাল নির্ধারিত হয় ছাত্রদের বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার সাফল্যের ওপর।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বড় কষ্টে বলেছিলেন, ‘বিসিএস বিশ্ববিদ্যালয় নামের একটি বিশ্ববিদ্যালয় খোলা হোক। সেখানে “প্রিলিমিনারি পরীক্ষা”, “ভাইভা” ইত্যাদি নামে বিভাগ থাকবে।’ যে দেশে বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার সংখ্যা অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানের গুণগত মান বিবেচিত হয়, সে দেশে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বিসিএস ক্যাডার তৈরির কারখানায় রূপ নেবে, এটাই স্বাভাবিক।

Also Read: বিসিএস কর্মকর্তাদের বোবাকান্না

বিসিএস নিয়ে স্বপ্নবিলাসী একটি প্রজন্ম আজকের বাস্তবতা। এই মোহগ্রস্ততা থেকে তাঁদের বাঁচাতে হবে। বিসিএস কর্মকর্তা হওয়ার সঙ্গে ক্ষমতার যে ধারণাটি আমাদের মধ্যে প্রচলিত, সেটি ভ্রান্ত, অনৈতিক ও লজ্জাজনক। জনগণের সেবক কখনো প্রভু হতে পারেন না। মানুষের সম্মান নিহিত থাকে তার কর্মে, তার যোগ্যতায়, তার নিষ্ঠা ও আন্তরিকতায়। তাই বিসিএস ছাড়া অন্যান্য সম্ভাবনার সঙ্গে তরুণ প্রজন্মকে পরিচিত করানো, স্বপ্ন দেখানো ও তাদের উৎসাহিত করা এখন সময়ের দাবি। 

  • নিশাত সুলতানা লেখক ও উন্নয়নকর্মী