Thank you for trying Sticky AMP!!

নিয়ম মেনেই সবকিছু...

৬৫ বছরের পুরোনো মগবাজার গার্লস হাইস্কুলের নাম পাল্টে মন্ত্রীর মায়ের নামে রাখা হয়েছে

২৪ মার্চ প্রথম আলোর ভেতরের পৃষ্ঠায় একটা খবর ছাপা হয়েছে। ৬৫ বছরের পুরোনো মগবাজার গার্লস হাইস্কুলের নাম পাল্টে রাখা হয়েছে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রীর মায়ের নামে। মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী ২০১৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত স্কুলের পরিচালনা কমিটির সভাপতি ছিলেন। বর্তমানে তাঁর পুত্র এই পদ অলংকৃত করছেন। ১৯৫৮ সালে ইস্পাহানী গ্রুপ বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেছিল। এটির নতুন নাম গাজী শামসুন্নেসা গার্লস হাইস্কুল।

গত বছর ৭ ডিসেম্বর স্কুলটির ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নতুন নামকরণের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন। ১২ ডিসেম্বর শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তারা স্কুলটি পরিদর্শন করেন এবং ১৩ মার্চ ২০২৩ নাম পরিবর্তনের অনুমোদন দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান তপন কুমার সরকার জানিয়েছেন, সব প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই নতুন নামকরণের আবেদন করা হয়েছিল এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় এতে সম্মতি দিয়েছে। অর্থাৎ নিয়ম মেনেই সবকিছু হয়েছে।

একটি বিদ্যালয় তৈরি করতে এবং তাকে প্রতিষ্ঠিত করতে বিপুল ব্যয়, পরিশ্রম ও সময় খরচ হয়। বিত্তশালী অনেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি করেন এবং নিজের বা পিতা–মাতার নামে নামকরণ করেন। শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারি কার্যক্রম এবং অর্থায়নে যে বিপুল ঘাটতি, তার বেশ খানিকটা পূরণে তাঁদের এই প্রয়াস ইতিবাচক ভূমিকা রাখে।

পক্ষান্তরে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নতুন নামকরণে তার তহবিলে মাত্র ৩০ লাখ টাকা দিতে হয় এবং নাম পরিবর্তনের পক্ষে প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটির সিদ্ধান্ত নিতে হয়। নতুন প্রতিষ্ঠান নির্মাণ ব্যয়ের তুলনায় ৩০ লাখ টাকার এই অঙ্কটা অনেক ছোট। মগবাজার গার্লস হাইস্কুলটি একটি প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়, শিক্ষকেরা এমপিওভুক্ত, প্রয়োজনীয় অবকাঠামো আছে। বলতে হবে বেশ সস্তায়ই মন্ত্রী মহোদয় তাঁর মায়ের নামে একটি প্রতিষ্ঠান পেয়ে গেলেন।

বাংলাদেশে এখন বিভিন্ন উপায়ে উপার্জিত অর্থে ধনী বনে যাওয়া মানুষের সংখ্যা অনেক, যঁাদের কাছে ৩০ লাখ টাকা খুবই সামান্য অর্থ। নামের প্রতি যাঁদের মোহ আছে, তাঁরা এই সহজ পথটা নিতে পারেন। একটা প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয় বাছাই করে ৩০ লাখ টাকা দান করে দিতে পারেন। পরিচালনা কমিটি যদি নিয়ন্ত্রণে থাকে, তাহলে তো কথাই নেই। যদি তা না–ও হয়, আরও খানিকটা অর্থ ব্যয়ে তাঁদের ‘ম্যানেজ’ করা সম্ভব। এরপর তাঁদের পছন্দের নাম প্রতিষ্ঠানের গায়ে লাগিয়ে দেওয়া যাবে। নিয়ম মেনেই করা যাবে সবকিছু।

‘মোদি হটাও, দেশ বাঁচাও’ লেখা পোস্টার জব্দ হয়েছে, গ্রেপ্তারও করা হয়েছে কয়েকজনকে। রাহুল গান্ধীকে মানহানির মামলায় দুই বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে, আর এরপর শুধু তাঁর লোকসভা সদস্যপদই বাতিল করা হয়নি, আগামী ছয় বছর তিনি নির্বাচন করতে পারবেন না, এমনও সিদ্ধান্ত এসেছে। সেখানেও এর সবকিছু হচ্ছে নিয়মের ভেতরে থেকেই।

২.

গুলশানের ৯৬ নম্বর রোডের কিনার ধরে রাস্তা খোঁড়া হয়েছিল। এমনটা অহরহই হয় আর ঢাকাবাসী এতে অভ্যস্ত। কাজ শেষে অনেক দিন মাটি ভরাট হয়ে পড়ে থাকার পর কয়েক দিন আগে বিটুমিন দিয়ে কার্পেটিং করা হয়েছে। নতুন কার্পেটিংয়ের অনেক জায়গাতেই দেখছি গাড়ির চাকা, এমনকি রিকশার চাকারও দাগ পড়ে যাচ্ছে। একটু একটু বিটুমিন উঠেও যাচ্ছে কোথাও। বেশ বিরক্ত হচ্ছিলাম এটা নিয়ে। আমার গাড়িচালক জানালেন, তাঁদের এলাকায় এমন বিটুমিন ঢালাইয়ের পর হাত দিয়ে খুঁচিয়ে ধরে টান দিলে চলটা উঠে যাচ্ছে জায়গায় জায়গায়। এক সাংবাদিক নাকি সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীকে জিজ্ঞেস করেছিলেন বিষয়টি। তিনি বলেছেন, নিয়ম মেনেই বিটুমিন করা হয়েছে সেখানে।

Also Read: রাহুল গান্ধীর উপর কেন এভাবে চড়াও হলো ভারতের বিজেপি সরকার?

৩.

এগুলো অবশ্য মামুলি বিষয়, যা প্রতিদিন দেখতে দেখতে অনেকটা গা সওয়া হয়ে গেছে ঢাকাবাসীর। সে তুলনায় অনেক গুরুতর বিষয়ে একটা খবর সম্প্রতি পত্রিকায় এসেছে। ২০২০ সালের ১৯ অক্টোবর রোমান মিয়া নামে একজন দুবাইপ্রবাসীকে পথ থেকে তুলে নেন পুলিশের সিআইডি কর্মকর্তা আকসাদুদ জামান এবং আরও কয়েকজন। রোমানকে নির্যাতন করে তাঁর সঙ্গে থাকা ৫ হাজার ডলার এবং ২ হাজার দিরহাম ছিনিয়ে নিয়ে তাঁরা তাঁকে ছেড়ে দেন। রোমানের করা মামলার তদন্ত করেন পুলিশের ডিবির অতিরিক্ত সহকারী কমিশনার (এডিসি) কায়সার রিজভী। কায়সার রিজভীর বিরুদ্ধে সিআইডি কর্মকর্তা আকসাদুদ জামানকে তুলে নিয়ে ডিবি কার্যালয়ে নির্যাতন করে মুক্তিপণ আদায়ের অভিযোগ ওঠে। অভিযোগের তদন্ত শেষে ২৬ অক্টোবর ২০২২ তারিখে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দেওয়া প্রতিবেদনে নির্যাতনের অভিযোগ এবং ১ কোটি ৪২ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায়ের সত্যতা পাওয়া যায়।

২৩ মার্চ প্রথম আলোর প্রতিবেদনে দেখা যায়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েরই তদন্তে এরূপ একটি গুরুতর অভিযোগের সত্যতা পাওয়ার পরবর্তী চার মাসেও অভিযুক্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (প্রশাসন ও পরিচালন) প্রতিবেদককে জানান, অপরাধের ধরন অনুযায়ী কায়সার রিজভী এবং অন্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কায়সার রিজভীকে সম্প্রতি আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নে বদলি করা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, সবকিছুই চলছে নিয়মমাফিক।

Also Read: ঢাকার ফুটপাত সবার, শুধু পদচারী ছাড়া

৪.

বাংলাদেশে সবকিছু হয় নিয়ম মেনেই। নিয়ম মেনেই নির্বাচন হয় (কখনো বা নিয়ম রক্ষায়)। নিয়ম মেনেই নদী দখল হয়, বালু তোলা হয়, বন উজাড় হয়। নিয়ম মেনেই খাসজমি দখল করে প্লট বিক্রি করেন ভূমিদস্যু, গজারি বনের জায়গা ব্যক্তির নামে রেকর্ড হয়ে যায় বাগানবাড়ি বা শিল্প স্থাপনের জন্য।

ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত খুনের আসামি হঠাৎ সুইডেন থেকে ফিরে আত্মসমর্পণ করেন। পরবর্তী সপ্তাহে মহামান্য রাষ্ট্রপতি তাঁকে ক্ষমা করে দেন নিয়ম মেনেই। সবকিছুই নিয়ম মেনে হয়, শুধু দেখা যায় অনেক ক্ষেত্রে অনিয়মটাই নিয়মে পরিণত হয়েছে লাখো শহীদের রক্তে অর্জিত আমাদের প্রিয় বাংলাদেশে।

৫.

গত শতাব্দীর গোড়ায় ব্রিটিশ ভারতের রাজনীতিক ও সমাজসংস্কারক গোপাল কৃষ্ণ গোখলে একটা কথা বলেছিলেন, বাংলা আজকে যা চিন্তা করে, ভারত তা চিন্তা করে আগামীকাল। একবিংশ শতকে বিজেপিশাসিত ভারত মনে হয় আবার অনেক কিছু বাংলাদেশের পরদিন চিন্তা করতে শুরু করেছে। ভিন্নমতের ওপর খড়্গহস্ত হচ্ছে নরেন্দ্র মোদির সরকার।

‘মোদি হটাও, দেশ বাঁচাও’ লেখা পোস্টার জব্দ হয়েছে, গ্রেপ্তারও করা হয়েছে কয়েকজনকে। রাহুল গান্ধীকে মানহানির মামলায় দুই বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে, আর এরপর শুধু তাঁর লোকসভা সদস্যপদই বাতিল করা হয়নি, আগামী ছয় বছর তিনি নির্বাচন করতে পারবেন না, এমনও সিদ্ধান্ত এসেছে। সেখানেও এর সবকিছু হচ্ছে নিয়মের ভেতরে থেকেই।

  • মো. তৌহিদ হোসেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব

Also Read: মন্ত্রীর মায়ের নামে হয়ে গেল ৬৫ বছরের পুরোনো স্কুলটি