Thank you for trying Sticky AMP!!

আবারও বোতলে করে রোদ বিক্রির ব্যবসা

আজকে যে খবর পড়ছেন, ২০১৬ সালেও ঠিক একই খবরই ছাপা হয়েছিল—ঢাকা পৃথিবীর সবচেয়ে বায়ুদূষণের শহর। ২৫ ডিসেম্বর ২০১৬ সালে এ–ই নিয়ে আমি গদ্যকার্টুন কলামও লিখেছিলাম। তাতে একটা গল্প ছিল। সেটাই আবার সংক্ষিপ্ত আকারে বলছি।

‘স্থপতি হাসান চৌধুরী কখনো ভাবেননি নিজের জীবনে এ ঘটনা ঘটবে। ঢাকা শহরে সবাই গায়ের সঙ্গে গা লাগিয়ে বাড়ি বানাচ্ছে, কেউ এক ইঞ্চি জায়গাও ছাড়তে চাইছে না। এক বাড়ির সঙ্গে আরেক বাড়ির মধ্যে কোনো ফাঁকা জায়গা নেই। এই সব দেখে হাসান চৌধুরী বলে বসলেন, সেদিন আর দূরে নয়, যেদিন ঢাকা শহরের লোকেরা ১০০ টাকা খরচ করে ১০ মিনিটের জন্য রোদ কিনে খাবে।

কিন্তু বাস্তবে সেটা কি আর সম্ভব?

নিশ্চয়ই, সম্ভব। কারণ, প্রথম যেদিন বোতলের পানি নিয়ে একজন সেলসম্যান আমার অফিসে এসে বলেছিল, সে এসেছে পানি বেচতে, তখন ওই লোকটাকে আমরা সবাই পাগল ভেবেছিলাম। আর আজকে মানুষ পয়সা দিয়ে শুধু সফট ড্রিংকস খায় না, পানি কিনে খায়। কয়েক দিন পরে লোকে রোদ কিনে খাবে।

হাসান ভাবেন, ধরা যাক, কারও ছাদে রোদ এসে পড়ে। তিনি বলবেন, আসুন আসুন, ভেজালমুক্ত রোদ খান। ১০ মিনিট মাত্র ১০ টাকা।

তাঁর এই ধারণা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। কিন্তু একটা আশ্চর্য অভিজ্ঞতা হলো তাঁর। নাতনি নাতাশা স্কুলে ভর্তি হয়েছে। বয়স সাড়ে তিন। সে খুবই স্মার্ট। কিন্তু একটাই সমস্যা, স্কুলে ঢুকেই সে কাঁদতে শুরু করে। আবার ক্লাসরুমে ঢুকলেই সে শান্ত হয়ে যাচ্ছে। এই রহস্য হাসান সাহেবরা ভেদ করতে পারছেন না। স্কুলের টিচাররাও চিন্তিত। হাসান চৌধুরী সবার সঙ্গে কথা বলে বুঝলেন, নাতাশা কিছু একটা ভয় পায়। হাসান চৌধুরী নাতাশার সঙ্গে স্কুলে গেলেন। মেয়ে কাঁদতে লাগল। পরের দিন কাঁদল না। তার পরের দিন আবার কাঁদল।

এরপর রহস্যটা উদ্‌ঘাটন হলো। গতকাল নাতাশা কাঁদেনি। গতকাল ছিল মেঘ। আজ আবার রোদ উঠেছে। তাহলে কি নাতাশা রোদ ভয় পায়?

তাকে রোদে নিয়ে যাওয়া হলো। না, সে রোদে ভয় পায় না। শেষে নাতাশাই বলল, সে ভয় পায় শ্যাডো। ছায়া। স্কুলে ঢুকতেই তার ছায়া তার সামনে পড়ে। এটা সে এর আগে কোনো দিনও দেখেনি।

আলেকজান্ডারের ঘোড়াও নিজের ছায়া ভয় পেয়ে পাগলামো করেছিল। আলেকজান্ডার সেটা ধরতে পেরেছিলেন।

হাসান চৌধুরী দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। রোদ বিক্রির প্রজেক্টটা কি তিনিই শুরু করবেন?’

ওই লেখাতে এই খবরগুলোও ছিল:
কানাডার উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান ভাইটালিটি এয়ার বোতলজাত বিশুদ্ধ বাতাস বিক্রি শুরু করেছে। প্রতিষ্ঠানটির সহপ্রতিষ্ঠাতা মোসেস লাম টেলিগ্রাফকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, চীনে ভাইটালিটি এয়ারের বিক্রি বেড়েছে। প্রথমে মাত্র ৫০০ বোতল বাতাস তারা চীনের বাজারে ছেড়েছিল, যা মাত্র চার দিনেই বিক্রি হয়ে যায়। এরপর চার হাজার বোতল বিশুদ্ধ বাতাস চীনে ছাড়া হয়েছে। প্রথমে মজা করে এই প্রতিষ্ঠানটি তৈরির উদ্যোগ নেয়। পরে আন্তর্জাতিক বাজারে বাতাসের চাহিদার কথা ভেবে গুরুত্ব দেওয়া শুরু হয়েছে।

ভাইটালিটি এয়ারের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, কানাডার রকি পর্বতমালার জনমানবহীন অঞ্চল থেকে বিশুদ্ধ বাতাস সংগ্রহ করে তা কমপ্রেস করে ক্যান ভর্তি করা হয়। একটি বিশেষ মাস্কের সাহায্যে এই বাতাস শ্বাস হিসেবে গ্রহণ করা যায় বলে তা নষ্ট হয় না।
(প্রথম আলো, অনলাইন সংস্করণ, ১৮ ডিসেম্বর, ২০২২)

হে আমাদের ভাগ্যবিধাতাগণ, আপনারাও কিন্তু এই শহরেই থাকেন, চলেন। অন্তত নিজেদের স্বাস্থ্য, নিজের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, কর্মী-ক্যাডারদের কথা ভেবে ঢাকার বায়ুদূষণ বন্ধে শক্ত পদক্ষেপ নিন। এই রকম দূষিত শহরের মানুষদের মধ্য আয়ের দেশের নাগরিক হওয়া মানায় না।

এখন ঢাকা শহরে বায়ুর দূষণ আরও বেড়েছে! আমাদের আয়ু আরও কমছে, রোগশোক ভয়াবহভাবে বাড়ছে। গবেষকেরা বলছেন, বায়ুদূষণের শিকার মানুষেরা বিষণ্ণতাতেও ভোগে। কাজেই আমাদের মনও ভীষণ খারাপ।

প্রশ্ন হলো, ঢাকার বায়ুদূষণ বন্ধে আমাদের সরকার, আমাদের সিটি করপোরেশন উদ্যোগটা নিল কী? কাতারে যে এত এত নির্মাণযজ্ঞ হলো বিশ্বকাপের আগে, সেখানে কি বায়ুদূষণ ঘটেছে। আমাদের কোনো নিয়মকানুন নেই, থাকলেও তা মানার লোক নেই এবং তা দেখার কেউ নেই। ইচ্ছেমতো রাস্তা খোঁড়ো, জমি খোঁড়ো, ইচ্ছেমতো মাটি তোলো, বালু ফেলো। এর বাইরে আছে আমাদের গাড়িগুলোর কার্বন আর ধোঁয়া উদ্‌গিরণ, ঢাকার চারপাশটা ঘিরে রেখেছে শত শত ইটের ভাটা, আর আছে যত্রতত্র গড়ে ওঠা কারখানা। আছে ইচ্ছেমতো ময়লা-আবর্জনা পুড়ানো। কেন বিধি থাকবে না? ফ্ল্যাটের দাম কি কেউ কম নেয়? আমাদের রাস্তা নির্মাণের খরচ কি পৃথিবীতে কোনো দেশের চেয়ে কম?

Also Read: ঢাকায় বিশুদ্ধ বাতাসের ব্যবসা কবে শুরু হবে

আইনস্টাইনের নামে প্রচলিত একটা কথা আছে, আইনস্টাইন যা বলেননি—‘পাগলামো হলো একই কাজ বারবার করে যাওয়া আর ভিন্ন ফল আশা করা।’ আমি ভাবছি, আমরা ঢাকাবাসী একই কাজ বারবার করে যাচ্ছি, এই মহানৈরাজ্য চলতে দিচ্ছি আর আশা করছি, আমাদের শহরে বইবে সুবাতাস, এটা কী করে হয়!

আসলে ঢাকাবাসী নয়, আমিই পাগল। একই লেখা বারবার লিখে যাচ্ছি, আর আশা করছি, আমাদের নগরপিতা, দেশপিতারা সেসব শুনবেন এবং অ্যাকশন নেবেন। পাগল তো আসলে আমিই।

হে আমাদের ভাগ্যবিধাতাগণ, আপনারাও কিন্তু এই শহরেই থাকেন, চলেন। অন্তত নিজেদের স্বাস্থ্য, নিজের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, কর্মী-ক্যাডারদের কথা ভেবে ঢাকার বায়ুদূষণ বন্ধে শক্ত পদক্ষেপ নিন।

এই রকম দূষিত শহরের মানুষদের মধ্য আয়ের দেশের নাগরিক হওয়া মানায় না।

সামান্য আশা: বিআরটি ও ঢাকা বাইপাস ঠিকাদারকে বায়ুদূষণের জন্য জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।
ব্যবস্থা আরও কঠোর নিন। পুরোপুরি ঠিক না হওয়া পর্যন্ত জারি রাখুন।

  • আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক