Thank you for trying Sticky AMP!!

মায়ের হাত ধরে জীবনের প্রথম দিন বিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার চাপায় আবিদার মৃত্যু হয়

স্কুলের প্রথম দিনটাই দুনিয়াতে কেন আবিদার শেষ দিন?

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা। সাপ্তাহিক ছুটি শুরুর তাড়াহুড়োর সময়টা। ব্যক্তিগত কাজে ধানমন্ডি যাচ্ছি। রাসেল স্কয়ার থেকে রাস্তা পার হয়ে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের রাস্তা পার হচ্ছি। একে একে তিনটি সিগন্যাল ছাড়ার জন্য রাসেল স্কয়ারের পুলিশ বক্সের সামনে বেশ কয়েক মিনিটের অপেক্ষা। অবশেষে ট্রাফিক পুলিশের থেমে থাকা হাত নামল।

রাস্তা পার হতে গিয়ে দু-তিন পা সামনে এগোতেই পেছন থেকে ধেয়ে এল দ্রুতগতির মোটরসাইকেল। নিশ্বাস চেপে কোনোভাবে পিছিয়ে আসা। বলা চলে ভাগ্যগুণেই দুর্ঘটনা থেকে অক্ষত ফেরা। চালক পেছন ফিরে কী যেন একটা গালি দিয়ে দ্রুতগতিতে চলে গেলেন। তাঁর পেছন পেছন মোটরসাইকেল, রিকশা আর সাইকেলের বহর। রবার্তো কার্লোসের বেনানা ফ্রি কিকের কায়দায় পুলিশ বক্সটা ঘুরে সাঁই সাঁই করে বের হয়ে যাচ্ছে।

আসন্ন দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যাওয়া আর মোটরসাইকেলচালকের গালির তুবড়িতে এতটাই হতবিহ্বল যে বুঝতে পারছিলাম না আমার ভুলটা কী? ট্রাফিক নিয়ম ভেঙে চলন্ত গাড়ির মধ্য দিয়েই তো রাস্তা পার হয়নি। তাহলে কেন এই বিড়ম্বনা? না, বিড়ম্বনা বলছি কেন? নাগরিক হিসেবে কারও মর্যাদাটা থাকল কীভাবে?

আনন্দবাজার পত্রিকার শতবর্ষ উপলক্ষে অমর্ত্য সেন ছোট একটা লেখা লিখেছেন। ভারতে সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে কোথায় কোথায় কাজ করা দরকার, সে প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ভারতবর্ষে সাধারণ মানুষের মর্যাদা নেই। তাদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করতে হবে।

সাধারণ মানুষের এই সম্মানহীনতা ভারতের মতো একই ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার বহন করা বাংলাদেশের জন্যও সত্য। বরং সেই সত্যটা আরও অনেক বেশি ও দৃষ্টিকটুভাবে প্রকট। ব্রিটিশ কালপর্বে ঔপনিবেশিক প্রভু আর উপনিবেশিত প্রজা—এই শাসনকাঠামোকে কেন্দ্র করে যে নৈতিকতা গড়ে উঠেছিল, তার পরম্পরা আমরা চেতনে-অবচেতনে বহন করে চলেছি। এই সম্পর্কসূত্রই গণতন্ত্রমনস্ক হতে বাধা দেয়। এই মানসিকতায় আমলাতন্ত্র-প্রশাসন-আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথে পর্বতের মতো দাঁড়িয়ে যায়। এই ব্যবস্থা যেমন একদিকে গণদুর্নীতিকে উৎসাহ দেয়, অন্যদিকে গণনৈতিকতার মানকে তলানিতে নিয়ে যায়।

সম্প্রতি প্রথম আলোর একটা বই প্রকাশনা অনুষ্ঠানে এসে এম সাখাওয়াত হোসেন জানাচ্ছিলেন, নেপালে ট্রাফিক পুলিশের শরীরে ক্যামেরা দেওয়ায় কীভাবে আমূল বদলে গেছে দেশটির ট্রাফিক–ব্যবস্থা। রাজতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করেছে নেপাল ১৫ বছরও হয়নি। তারা পারলে আমরা পারব না কেন?

আমাদের সড়কগুলোতে, বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় রাস্তায় পথচারী হিসেবে চলতে গেলে আমাদের নাগরিক মর্যাদাকে ঘরের মধ্যে বাক্সবন্দী করে রেখে আসতে হয়। ভিআইপি চলাচল যখন করবে, তখন দুই পায়ে সটান দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এমন অভিজ্ঞতা আমাদের কমবেশি সবারই আছে। সড়কের শৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সে সময় তাদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা দিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। আর নিরাপত্তা আর শৃঙ্খলা বজায় রাখতে চাপটা এতটাই বেশি থাকে যে ক্ষেত্রবিশেষে কেউ কেউ নাগরিকদের ওপর গালি দিতেও ছাড়ে না।

বিপরীত চিত্রটা সাধারণের চলাচলের সময়টাতে। শৃঙ্খলার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিদের শিথিলতা আর গাড়িচালক আর পথচারীদের নিয়ম ভাঙার প্রতিযোগিতা। এই নৈরাজ্যের বলি যেকোনো মুহূর্তে যে কেউ হতে পারে। সড়কের এই নৈরাজ্য একেকটা পরিবারের জন্য মহাট্র্যাজেডির কারণ হয়ে উঠছে। অথচ এই ট্র্যাজেডির পেছনে সিংহভাগেরই কোনো দায় নেই। পত্রিকা, টেলিভিশন ও অনলাইন সংবাদমাধ্যমের প্রতিদিনই সংবাদের শিরোনাম হচ্ছে সড়কে হতাহতের খবর।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সড়কে মৃত্যুর মিছিলে যুক্ত হচ্ছে বিপুলসংখ্যক শিশু। রোড সেফটি ফাউন্ডেশন জানাচ্ছে, ২০২৩ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে প্রায় ১ হাজার ১২৮ শিশু। আগের বছর মারা যায় ১ হাজার ১৪৩ শিশু। স্কুলে যেতে গিয়ে কিংবা স্কুল থেকে ফেরার সময় কিংবা বাড়ির সামনে খেলতে গিয়ে শিশুরা জীবন হারাচ্ছে।

শুধু সড়ক বলছি কেন, ডেঙ্গুর কথা যদি বলি। গত কয়েক বছরে ডেঙ্গুতে যত মানুষ মারা গেছে, তার বিশাল একটা অংশ শিশু। সমাজ, রাষ্ট্র, পরিবারের বড়রা বাস্তবে শিশুদের রক্ষায় কী করছে? ঢাকায় মতিঝিল-উত্তরা রুটে মেট্রোরেল চালু হওয়ার পর অন্তত ঢাকার সড়কে খানিকটা হলেও শৃঙ্খলা আনার মোক্ষম সুযোগ কি আসেনি। মেট্রোরেলের কারণে ঢাকার অন্তত দুটি রুটে যানবাহনের চাপ কমেছে। সামগ্রিকভাবে ঢাকার যানজটের ওপরও ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে। অপেক্ষাকৃত কম সময় লাগছে যাতায়াতে।

একটা ব্যবস্থা যখন শিকড় গেড়ে বসে, তা রাতারাতি বদলে ফেলা যায় না। কিন্তু কোথাও না কোথাও থেকে তো শুরু করতে হয়। সড়কে যানবাহন, পথচারী, ট্রাফিক পুলিশ যে সিগন্যাল মানে না কিংবা ভুল সিগন্যালে চলে, তা থেকে বেরিয়ে আসার একটা উদ্যোগ কি কেউ নেবে না। বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? ডিএমপি কমিশনার কিংবা ঢাকার মেয়ররা কখনো কি অফিস শুরুর সময়টাতে কিংবা ছুটির শেষে ঢাকার কোনো মোড়ে কোনো দিন সাধারণ পথচারীর সঙ্গে রাস্তা পার হওয়ার ঝুঁকি নিতে পারবেন? যদি এক দিন সেই ঝুঁকি নিতে পারেন, তাহলে অনেক বদলের সূচনা সেদিনেই হতে পারে।

শেষের শুরুটা করি ফুলের মতো ছোট্ট শিশু আবিদাকে দিয়ে। শরীয়তপুরের গোসাইরহাট উপজেলার পাঁচ বছরের শিশু আবিদা। ডেইলি স্টার–এ প্রকাশ হওয়া খবর জানাচ্ছে, মাত্র চার দিন আগে আবিদা স্কুলে যাওয়ার জন্য নতুন স্কুল ড্রেস বানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। স্কুলে যাবে, এই আনন্দে আত্মহারা ছিল শিশুটি। সোমবার সকালে মায়ের হাত ধরে স্কুলব্যাগ কাঁধে স্কুলের পথে রওনা হয়েছিল। স্কুলের প্রথম দিন। কে জানত এই দিনটাই এই দুনিয়ায় আবিদার শেষ দিন হবে! রাস্তার মধ্যে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা এসে তাকে চাপা দেয়। স্কুলের প্রথম দিন দুনিয়ায় আবিদার শেষ দিন।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের যে তথ্য, তাতে প্রতিদিন গড়ে তিনটি শিশুর শেষ দিন হচ্ছে সড়ক। আবিদাদের মতো ছোট্ট ফুটফুটে শিশুদের জীবন বাঁচাতে অন্তত উদ্যোগ নিন। একটা–দুটা উদ্যোগই বড় পরিবর্তন আনতে পারে। মেট্রোরেল চালু হওয়ার আগে ঢাকা কারওয়ান বাজার মোড়ে সড়ক পারাপার ছিল কঠিনতম কাজ। পথচারীদের চলন্ত গাড়ির মধ্য দিয়েই পার হতে হতো। কখনো হাত তুলে আবার কখনো দৌড়ে। একেবারে হাতের মুঠোতে জীবন নিয়ে এই পারাপার। মেট্রোরেল স্টেশনের দুই পাশে দুটি ওভারব্রিজ অনেকটাই পরিবর্তন এনে দিয়েছে। পথচারীদের অনেকে নিরাপদে রাস্তা পার হতে পারছেন। যদিও রাত আটটায় ওভারব্রিজের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আগের সেই সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।

সম্প্রতি প্রথম আলোর একটা বই প্রকাশনা অনুষ্ঠানে এসে এম সাখাওয়াত হোসেন জানাচ্ছিলেন, নেপালে ট্রাফিক পুলিশের শরীরে ক্যামেরা দেওয়ায় কীভাবে আমূল বদলে গেছে দেশটির ট্রাফিক–ব্যবস্থা। রাজতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করেছে নেপাল ১৫ বছরও হয়নি। তারা পারলে আমরা পারব না কেন?

  • মনোজ দে, প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী