Thank you for trying Sticky AMP!!

নির্বাচন শেষ, এখন সময় সমঝোতার

‘নির্বাচন শেষ হয়েছে। এখন সময় এসেছে নতুন পাতা ওলটানোর। সময় এসেছে বিভক্তির ঊর্ধ্বে উঠে পুরোনো ক্ষত সেরে ফেলার।’

কথাটা মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের, ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন শেষে এমন কথাই তিনি বলেছিলেন। সে নির্বাচনের ফলাফলের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে তাঁর রিপাবলিকান প্রতিদ্বন্দ্বী ডোনাল্ড ট্রাম্প যে বিতর্ক ও বিতণ্ডা শুরু করেছিলেন, তার জেরেই ঘটেছিল ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারির ক্যাপিটল হিলে দাঙ্গা। এর ফলে মার্কিন নাগরিক মানসে যে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়, তিন বছর পরও তা মেলায়নি।

আরেকটি নির্বাচন আসছে। অনেকে বলছেন, সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি অসম্ভব নয়। কেউ কেউ বাতাসে রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধের গন্ধ পাচ্ছেন। ২০২১ সালের এক জনমত জরিপে দেখতে পাচ্ছি, বাইডেন সমর্থকদের ৪১ শতাংশ ও ডোনাল্ড ট্রাম্প সমর্থকদের ৫২ শতাংশ এ মুহূর্তেই দেশটাকে দুই ভাগে ভাগ করতে রাজি।

প্রজাতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় মতভেদ ও দলগত বিভক্তি খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। মূল লক্ষ্য ক্ষমতা অর্জন। দেশকে এগিয়ে নিতে প্রতিটি দলেরই যার যার নিজস্ব মত ও পথ রয়েছে।

Also Read: এবারের নির্বাচন রাজনীতিতে অনেক প্রশ্ন রেখে যাবে

ক্ষমতার ভাগীদার না হলে সেই ‘ভিশনের’ প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। সেই মত ও পথ প্রতিষ্ঠায় নির্বাচন একমাত্র বৈধ উপায়। কিন্তু নির্বাচন কোনো দেশ অথবা জাতির অভ্যন্তরীণ বিভক্তি নিরসনের নিশ্চিত উপায়, সে কথা বলা যাবে না। আজকের যুক্তরাষ্ট্র সে কথার প্রত্যক্ষ প্রমাণ। আমরা বাংলাদেশের উদাহরণটিও বিবেচনায় আনতে পারি।

যুক্তরাষ্ট্রের আজকের যে বিভক্তি, মার্কিন তাত্ত্বিকদের মতে, এর কেন্দ্রে রয়েছে তিনটি কারণ—বর্ণভেদ, ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থাপ্রসূত ক্রমবর্ধমান বৈষম্য এবং বিখণ্ডিত তথ্যব্যবস্থা। এর সঙ্গে যুক্ত করুন জনসংখ্যাগত পরিবর্তনের ফলে ক্ষমতাভোগী শ্রেণির মধ্যে ক্ষমতা হারানোর ভয়। অব্যাহত অভিবাসন বৈধ ও অবৈধ—এই বিভক্তি প্রক্রিয়াকে কেবল ত্বরান্বিত করছে তা–ই নয়, তা ক্রমে রক্তক্ষয়ী ও সহিংস করে তুলছে।

এই বিভক্তি-বিশ্লেষণে আদর্শিক মেরুকরণ তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়, যদিও এই বিভক্তি উত্তরণের পথ কী, তা নির্ধারণ করতে সবাই কোনো না কোনোভাবে আদর্শিক পথ বেছে নেয়। এই পথ হয় বাম বা ডান, রক্ষণশীল বা উদারনৈতিক, ধর্মীয় বা ধর্মনিরপেক্ষ। রাষ্ট্রের প্রতীক হিসেবে সরকারের ভূমিকাও এখানে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারও কাছে চলতি বিভক্তি এড়াতে সরকারের ভূমিকা কমাতে হবে। আবার কেউ মনে করেন, সরকারের ভূমিকাকে যত খাটো করে আনা সম্ভব হবে, এই মেরুকরণ এড়ানো তত সহজ হবে।

আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার অধীন বিভিন্ন দেশ যার যার অভ্যন্তরীণ বিভক্তি কমাতে এই হরেক ব্যবস্থাপত্র যে অনুসরণ করেনি তা নয়, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এর ফলে বিভক্তি কমেনি; বরং বেড়েছে। এর একটা সম্ভাব্য কারণ, বিভক্তি-দেয়ালের দুই পাশে অবস্থানরত নাগরিকেরা আদর্শগত নয়, গোত্রীয় আনুগত্যের সুতায় বাঁধা।

এই গোত্রীয় আনুগত্য—ট্রাইবাল লয়ালটি—প্রাচীন সমাজের পরিচিত বৈশিষ্ট্য। শুধু ধর্ম বা ভাষা নয়, শারীরিক চিহ্নের মাধ্যমেও এই গোত্রীয় আনুগত্য নির্মিত হতো। ভাবা হয়েছিল, জাতিরাষ্ট্র গঠন এই গোত্রীয় আনুগত্য অতিক্রমে সক্ষম হবে, কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে তা ঘটেনি।

যুক্তরাষ্ট্রের কথাই ধরুন। এ দেশের রাজনৈতিক বিভক্তির কেন্দ্রে যে লাল (বা রিপাবলিকান পার্টি) ও নীল (বা ডেমোক্রেটিক পার্টি), আদর্শগতভাবে তাদের একটি রক্ষণশীল, অন্যটি উদারনৈতিক। শুধু আদর্শিক হলে এই বিভক্তি অনেক বেশি শিথিল হতো। কারণ, আদর্শিক আনুগত্য অনেক বেশি নমনীয়। আজ যে কমিউনিস্ট, কাল সে ক্যাপিটালিস্ট, এ তো আকছার ঘটছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের চলতি বিভক্তির চরিত্র আদতে গোত্রীয় বা ট্রাইবাল। যার যার গোত্রের প্রতি আনুগত্য এতই প্রবল যে এই দুই পক্ষ একে অপরকে শত্রু ভাবে। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অ্যামি চুয়া মন্তব্য করেছেন, এই গোত্রীয় আনুগত্যের কারণে অন্য পক্ষকে পরাস্ত করা ভিন্ন বিকল্প কোনো পথ নেই।

এই বিভক্তি এখন এতটাই গভীর ও স্থায়ী আকার নিয়েছে যে সহাবস্থান আদৌ কোনো কার্যকর ও বাস্তবসম্মত বিকল্প নয়। মার্কিন লেখক জর্জ প্যাকারের বিশ্লেষণ অনুসরণ করে বলতে পারি, গোত্রীয় আনুগত্য সর্বাংশে নিঃশর্ত বশ্যতা দাবি করে। এই বশ্যতা গোত্রভুক্ত ব্যক্তিদের শুধু যে আত্মপরিচয় নির্ধারণে সাহায্য করে তা–ই নয়, তাদের ‘গোত্রীয় বিভক্তির নিরাপত্তা’ অর্পণ করে। ‘এই বশ্যতা আত্মপরিচয়ের পরিচয়চিহ্ন বা ব্যাজ, তাদের ভাবনাচিন্তার প্রকাশ নয়’।

Also Read: রাজনৈতিক সংকট আরও ঘনীভূত হবে

২.

বাংলাদেশও রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত একটি সমাজ। এই বিভক্তি মোটেই আদর্শিক নয়। বিভক্তিচিহ্নের এপাশ-ওপাশে থাকা মানুষগুলো যখন-তখন এক পাশ থেকে অন্য পাশে সরে আসছেন।

আজ যে শত্রু, কাল সে মিত্র। এই বিভাজিত বর্গক্ষেত্রে বাম ও ডান; ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ; স্বাধীনতার পক্ষে ও বিপক্ষে; রক্ষণশীল ও উদারনৈতিক ইত্যাদি সব পরিচয়চিহ্নবাহী ব্যক্তি ও দল রয়েছে। উভয় পক্ষের মানুষকে নিকটবর্তী করে আদর্শ নয়, ক্ষমতা ভাগাভাগির দৌড়। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে যদি একটি পিৎজা পাইয়ের সঙ্গে তুলনা করি, তো সে পাইয়ের কোন ও কত ভাগ কার কপালে জুটবে, বিভক্তির কেন্দ্রে সেই প্রশ্ন।

সম্প্রতি বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন শেষ হয়েছে। যে গোত্রীয় বিভক্তি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাজকে বিভক্ত করেছে, এই নির্বাচন তা সংকোচনে সহায়ক হবে, এ কথা যদি কেউ ভেবেও থাকেন, তা বাস্তবায়িত হয়নি; বরং তা আরও দীর্ঘায়িত হয়েছে। এখন অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে বিভক্তি-দেয়ালের এপাশ–ওপাশের মানুষগুলো একে অপরকে ভিন্নমতাবলম্বী নয়, তাদের শত্রুই মনে করে। যে দলগত, গোত্রীয় ও আদর্শিক এই বিভক্তি, যেভাবেই তাকে বিশেষায়িত করি না কেন, তা কি তাহলে অনপনেয় ও অপরিবর্তনীয়?

Also Read: তোষামোদ বনাম ভিন্নমত

রাজনৈতিক বিভক্তিগত যে সংকট, তা বাংলাদেশেই হোক অথবা যুক্তরাষ্ট্রে, তা নিরসনের একটি পূর্বশর্ত হলো, এ কথা স্বীকার করা যায়, এই সংকট কাল্পনিক নয়, বাস্তব। একে যদি না ঠেকানো যায়, তাহলে কাল অথবা পরশু তা সত্যি সত্যি অপরিবর্তনীয় হয়ে পড়বে।

যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সর্বোচ্চ থেকে সে কথার স্বীকৃতি এসেছে। আলোচনা শুরুতে নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের যে উদ্ধৃতি আমি ব্যবহার করেছি, তাতে সে কথার স্বীকৃতি রয়েছে। তিনি অথবা যে গোত্রের তিনি সদস্য, তারা এই সংকট সমাধানে কতটা আন্তরিক, সেটি অবশ্য একটি স্বতন্ত্র প্রশ্ন।

রাজনৈতিক নেতৃত্বের বাইরে আইন ও নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ার সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁরা কিন্তু এই বিভক্তি কীভাবে এড়ানো যায়, সে ব্যাপারে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নিয়েছেন। মার্কিন রাজনৈতিক ভূচিত্রের অংশীদার কিছু লোক সব সময়ই থাকেন, যাঁরা কখনো বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে প্রস্তুত নন। তাঁদের আমরা আদর্শিক বিশুদ্ধতাবাদী বা পিউরিস্ট বলতে পারি। এর বাইরে এমন কিছু লোক থাকেন, যাঁদের আমরা বাস্তববাদী বা প্রাগম্যাটিস্ট বলতে পারি।

এই দ্বিতীয় দল সংকট সমাধানে আগ্রহী এবং এই বাস্তবতায় বিশ্বাসী যে একে অপরের স্বার্থ রক্ষা হয়, এমন ক্ষেত্রে ছাড় না দিলে কোনো সমাধান সম্ভব নয়। অন্য কথায়, সমঝোতা ভিন্ন দ্বিতীয় পথ নেই। বাজেট থেকে অভিবাসন, পররাষ্ট্রনীতি থেকে পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ, প্রায় প্রতিটি প্রশ্নেই মার্কিন কংগ্রেসে ‘প্রবলেম সলভিং ককাস’ রয়েছে, যাতে দুই দলেরই সদস্যরা তৎপর।

মঞ্চের আড়ালে থাকেন বলে অনেক সময় এই মধ্যপন্থীদের কাজ আমাদের নজরে পড়ে না, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির চাকা যে হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়নি, তার কারণ পেছন থেকে কাজ করা এই মানুষগুলো।

বিপরীত মেরুর মানুষেরা যাতে একে অপরের কথা শোনে, সে জন্য নাগরিক পর্যায়েও উদ্যোগের কমতি নেই। টাইম ম্যাগাজিনের একটি প্রতিবেদনে দেখছি, এ দেশে আট হাজারের বেশি কর্মসূচি রয়েছে, যার লক্ষ্য ভিন্নমতের মানুষকে একে অপরের মুখোমুখি করা। এর কোনোটি বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণাকেন্দ্রভিত্তিক, কোনোটাবা কমিউনিটিভিত্তিক। টাইমের ভাষায়, এর চরিত্র বাই-পার্টিজান বা দ্বিদলীয়। এদের মধ্যে রয়েছে সার্চ ফর কমন গ্রাউন্ড, হোপ ইন দ্য সিটিজ, এসেনসিয়াল পার্টনারস ইত্যাদি সংগঠন।

কংগ্রেসের ভেতর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুমে ও থিঙ্কট্যাংকের সেমিনারে অংশগ্রহণকারী সব সদস্য একটা বিষয়ে একমত: দেশটা সবার, কোনো এক দল বা গোত্রের নয়। দেশ সঠিক পথে এগোলে সবার যেমন লাভ, ভুল পথে এগোলে ক্ষতিও সবার। যুক্তরাষ্ট্রের যে অভ্যন্তরীণ সংকট, তা থেকে উত্তরণের জন্য লাল ও নীল—উভয়কেই হাত মেলাতে হবে। ২০০৪ সালের এক ভাষণে বারাক ওবামা বলেছিলেন, কোনো লাল আমেরিকা নেই, কোনো নীল আমেরিকাও নেই। আছে শুধু এক ও অবিভক্ত যুক্তরাষ্ট্র। এ কথা তখন যেমন, এখনো সমান সত্য।

Also Read: ভোটের ফলাফল জেনেও ভোট দেওয়ার পেছনে কী

যুক্তরাষ্ট্রের যে গভীর রাজনৈতিক অসুখ, বাংলাদেশেরও ঠিক সেই একই অসুখ। তাদের ব্যাধির বহিরাঙ্গের প্রকারভেদ থাকতে পারে কিন্তু মোদ্দা চরিত্র অভিন্ন। ফলে সমাধান যদি খুঁজতে হয়, তাহলে দেয়ালের দুই পারের মানুষের একে অপরের কাছ থেকে শিক্ষা তো নেওয়া যেতেই পারে। যেকোনো রোগ উপশমের প্রথম শর্ত হলো, রোগ যে রয়েছে, তার স্বীকৃতি।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নিজে বলেছেন, বিগত দিনের ভুলভ্রান্তি থেকে শিক্ষা নিয়ে তাঁর সরকার অগ্রসর হবে। আমাদের অসুখ আছে, এটি সে কথার স্বীকৃতির প্রথম ধাপ বলে মেনে নিতে পারি। কিন্তু সেখানে থেমে থাকলেই চলবে না, রাজনৈতিক মেরুকরণ ঠেকাতে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নিতে হবে। আর সে জন্য চাই সংলাপ ও সমঝোতা। শুধু পেশাদার রাজনীতিকেরাই নন, সুশীল সমাজ ও সাধারণ মানুষ—সবাই–ই এই সংলাপে অর্থপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন।

বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ঠিকই বলেছেন, দেশের সামনে ত্রিবিধ সংকট—রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক। সরকারের একার পক্ষে এই ত্রিমুখী সংকট থেকে উত্তরণ সহজ হবে না। বাংলাদেশের যে গভীর অসুখ, তা থেকে বেরোনোর পথ নির্দেশ করে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ নির্বাচন-পূর্ব যে ব্যবস্থাপত্র প্রকাশ করে, তাতেও ঠিক এ কথাই বলা হয়েছে।

অরাজনৈতিক এই গবেষণা সংস্থা লিখেছে, স্বল্পমেয়াদি হিসাবে ক্ষমতাসীন মহল ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবে ঠিকই, কিন্তু বিরোধীপক্ষ তাদের রাজনৈতিক বিরোধিতা ত্যাগ করবে না। এর ফলে ক্ষমতাসীন দলের ওপর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপ বাড়বে। তেমন সংকট এড়ানোর একটাই পথ, বিরুদ্ধ দুই পক্ষের মধ্যে সংলাপ।

সেই লক্ষ্যে প্রথম হাত বাড়ানোর কাজটি তাদের, যারা এখন ক্ষমতার কেন্দ্রে।

● হাসান ফেরদৌস প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক