Thank you for trying Sticky AMP!!

বন্যার্তদের আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ

দেশের উত্তরাঞ্চলের ১৪টি জেলায় বন্যা চলছে। প্রায় তিন লাখ মানুষ ইতিমধ্যে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ১৪ লাখ মানুষ। যাঁদের ঘরবাড়ি জলমগ্ন হয়ে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে, তাঁদের আশ্রয় নিতে হয়েছে উঁচু কোনো জায়গায়, বিশেষত বাঁধের ওপরে খোলা আকাশের নিচে। যেমন বৃহস্পতিবার বিকেলে এই সম্পাদকীয় লেখার সময় পর্যন্ত বগুড়ার সারিয়াকান্দির বন্যাপ্লাবিত এলাকায় প্রায় সাড়ে তিন হাজার পরিবার বাঁধের ওপরে খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করছিল। পাশের গাইবান্ধা জেলায় বন্যার পানি নামতে শুরু করার পরও অনেক মানুষকে বাঁধের ওপরেই থাকতে হচ্ছে। বন্যাদুর্গত অন্য জেলাগুলোর চিত্রও একই রকমের: ঘরবাড়ি ডুবে যাওয়া বন্যার্ত মানুষের আশ্রয়ের সরকারি ব্যবস্থা এতই অপ্রতুল যে তাদের অধিকাংশকেই খোলা আকাশের নিচে দিনরাত কাটাতে হবে।

এর প্রধান কারণ বন্যাদুর্গতদের বিষয়ে সরকারি নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নির্মম অবহেলা। বন্যায় হাজার হাজার পরিবারের ঘরবাড়ি ভেসে গেলে তারা কোথায় আশ্রয় নেবে, সে বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া হয়েছে কম। দেশের তিন কোটি উপকূলবাসীর জন্য ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র আছে ৪ হাজার ২০০টি, অথচ উত্তরাঞ্চলসহ বন্যাপ্রবণ এলাকাগুলোর পাঁচ কোটি মানুষের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে মাত্র ১৫৩। এগুলোতে এক লাখের বেশি মানুষের জায়গাও হবে না। এ থেকেই পরিষ্কার বোঝা যায়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে ঘূর্ণিঝড় যতটা গুরুত্ব পেয়েছে, বন্যা পেয়েছে তার তুলনায় অনেক কম গুরুত্ব। বন্যার্তদের জন্য একটি প্রকল্পের আওতায় দেড় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ৪২৩টি বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যেগুলো বন্যা ছাড়া অন্য সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যবহৃত হবে। কিন্তু বিস্ময়কর তথ্য হলো, যে ১৫৩টি আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে, সেগুলোর অধিকাংশই কম বন্যাপ্রবণ এলাকায়। যেসব এলাকায় বন্যা বেশি হয়, যেখানে বেশিসংখ্যক মানুষের ঘরবাড়ি ভেসে যায়, সেসব এলাকায় কমসংখ্যক আশ্রয়কেন্দ্র নির্মিত হচ্ছে।

এ অদ্ভুত কর্মকাণ্ডের কারণ কী? ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র থেকে প্রথম আলো জানতে পেরেছে, যেসব এলাকায় ওই মন্ত্রণালয়ের প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের বাড়ি, সেসব এলাকায় বেশিসংখ্যক বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র নির্মিত হচ্ছে। একটি দৃষ্টান্ত চাঁদপুর জেলা। সেখানে নির্মিত হচ্ছে ৩২টি আশ্রয়কেন্দ্র। কারণ, সেখানে ওই মন্ত্রণালয়ের এক সাবেক মন্ত্রী ও সচিবের বাড়ি। অথচ দেশের সর্বাধিক বন্যাপ্রবণ জেলা রংপুরে মাত্র ৪টি, রাজবাড়ীতে ৫টি, গাইবান্ধায় ৮টি, লালমনিরহাটে ৯টি ও কুড়িগ্রামে ১২টি আশ্রয়কেন্দ্র নির্মিত হচ্ছে। এসব জেলায়ও অনেক আশ্রয়কেন্দ্রের স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে ক্ষমতাধর ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বাড়ির কাছাকাছি। অপেক্ষাকৃত কম বন্যাপ্রবণ জেলাগুলোর মধ্যে কিশোরগঞ্জে ২৬টি, কুমিল্লায় ২৫টি, সুনামগঞ্জে ২৫টি, সিলেটে ২৩টি ও নেত্রকোনায় ২০টি আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। এ জেলাগুলোতে দারিদ্র্যও উত্তরাঞ্চলের অধিকতর বন্যাপ্রবণ এলাকাগুলোর চেয়ে কম।

বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের ক্ষেত্রে এ বৈষম্য নির্মম অনৈতিক বিবেচনা থেকে সৃষ্ট। বিবেচনাটি রাজনৈতিক, যে রাজনীতিতে মানুষের কল্যাণচিন্তা নেই, আছে ব্যক্তিগত ও দলীয় স্বার্থবোধ। ভোট আকর্ষণের চেষ্টায় রাষ্ট্রীয় অর্থের এমন দুরভিসন্ধিমূলক অপব্যবহার কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। শুধু তাই নয়, এ ধরনের স্থাপনা নির্মাণের ক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া যায়, যদিও সেসব দুর্নীতির তদন্ত হয় না, আইনানুগ প্রতিকারের উদ্যোগ নেওয়া হয় না। হাজার হাজার বন্যার্ত পরিবার যখন মাথা গোঁজার ঠাঁই না পেয়ে সন্তানসন্ততিসহ খোলা আকাশের নিচে রোদে পোড়ে, বৃষ্টিতে ভেজে আর মন্ত্রণালয়ের কর্তারা কিংবা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতারা রাষ্ট্রীয় অর্থে নিজেদের রাজনৈতিক আখের গোছানোর চেষ্টা করেন—এ অন্যায় অবশ্যই বন্ধ করা দরকার। সে জন্য বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের প্রকল্পটির বিষয়ে তদন্ত করে যথাযথ আইনানুগ পদক্ষেপ নেওয়া একান্ত জরুরি।