Thank you for trying Sticky AMP!!

যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে ঢুকছেন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সদস্যরা। যশোর, ১৩ আগস্ট

শিশু হত্যাকেন্দ্রের নাম সংশোধনকেন্দ্র?

প্রথমে বলা হয়েছিল ‘বিচারাধীন অপরাধী কিশোরেরা নিজেরা মারামারি করে মরে গেছে।’ আহত কিশোরদের আহাজারি আর মৃত কিশোরদের ক্ষত দেখে চিকিৎসকদের মালুম হয়, এসব ক্ষত মারপিটের নয়, বরং বেঁধে পিটিয়ে মারার পরিষ্কার আলামত। পুলিশ এখন জানাচ্ছে, কেন্দ্রের ১৯ কর্মকর্তা–কর্মচারী রীতিমতো বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নিয়ে ১৮ কিশোরকে রড ও ক্রিকেটের স্ট্যাম্প দিয়ে পেটান। এতেই মারা যায় ৩ জন, গুরুতর আহত হয় ১৫ জন। প্রায় ২৫ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে বারবারই এমন ঘটনা ঘটে চলেছে। কেবল যশোরে নয়, গাজীপুরের কিশোরী উন্নয়ন কেন্দ্রসহ সারা দেশে ছড়ানো অনেক সরকারি-বেসরকারি এতিমখানা ও মাদ্রাসায় শিশু নিপীড়ন এবং হত্যাকাণ্ড চলে।

সেই পাপেই তারা মরছে। হয়তো কেউ লিখবে নতুন করে ‘নো বডি কিলড জেসিকা’। একসঙ্গে তিনটা মৃত্যু (নাকি হত্যা) একটু বেশি হয়ে গেছে। এর আগে মাসে–তিন মাসে এক-আধটা হত্যাকে আত্মহত্যা বলে প্রচারের চেষ্টা হতো।

এখন জবাব নেই কারও মুখে। কেউ কিছু বলতে পারে না। তদন্ত হবে। মামলা হবে, বিচার হবে। তারপর বলা যাবে কী হয়েছিল আর কী হওয়া উচিত ছিল। হয়তো একদিন বিশ্বাস করতে হবে, নিহত নাঈম, সুজন ও পারভেজকে কেউ মারেনি, ভাগ্য ওদের মেরে ফেলেছে। ‘জন্ম ওদের আজন্ম পাপ’। সেই পাপেই তারা মরছে। হয়তো কেউ লিখবে নতুন করে ‘নো বডি কিলড জেসিকা’। একসঙ্গে তিনটা মৃত্যু (নাকি হত্যা) একটু বেশি হয়ে গেছে। এর আগে মাসে–তিন মাসে এক-আধটা হত্যাকে আত্মহত্যা বলে প্রচারের চেষ্টা হতো।

আকাশ (১২) নামের এক শিশুর গলাকাটা লাশ পাওয়া গিয়েছিল ২০১১ সালের ২৯ আগস্ট। ২০১৪ সালের ৫ মে কেন্দ্রে বন্দীদের সঙ্গে আনসার বাহিনীর সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ওই সময় নির্যাতিত কিশোরেরা কেন্দ্রে ভাঙচুর ও ভাঙা কাচ দিয়ে শরীর কেটে প্রতিবাদ জানায়।


২০১৭ সালের ১৪ জুন রাজশাহীর তানোর থানার একটি মিথ্যা হত্যাপ্রচেষ্টা মামলায় অভিযুক্ত বালক গোবিন্দকে যশোরের শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয়। ২০১৭ সালের ২২ জুন সকাল ১০টার দিকে সিঁড়ির গ্রিলের সঙ্গে গামছায় ঝোলানো তার লাশ পাওয়া যায়। একে গরিব, তারপর ‘ক্ষুদ্র’ সম্প্রদায়ের মানুষ। ঘটনার আগের দিন ২১ জুন তাঁর মা কেন্দ্রের প্রবেশন অফিসার মো. মাসুদ বিল্লাহর মোবাইলের মাধ্যমে ছেলের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। তিনি আজও বিশ্বাস করতে পারেন না তাঁর ছেলে ‘গলায় দড়ি নিয়েছে’।

তিন মাস না যেতেই সেপ্টেম্বরে উন্নয়ন কেন্দ্রের দ্বিতীয় তলার একটি কক্ষের বৈদ্যুতিক পাখার সঙ্গে গলায় গামছা দিয়ে ঝুলতে দেখা যায় ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার কাঞ্চনপুর গ্রামের মাসুদ হোসেনকে (১৪)। মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে একটি চুরির মামলায় মাসুদকে কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছিল।


মাসুদের মৃত্যুর পর কর্তৃপক্ষের বয়ান ছিল এ রকম: ‘ছেলেটির মা মারা গেছে। বাবা আবার বিয়ে করে নতুন শ্বশুরবাড়িতে ঘরজামাই থাকেন। ছেলের খোঁজখবর রাখেন না। মাসুদের দাদি তাকে দেখাশোনা করতেন। ঝিনাইদহ শহরে একটি বাড়িতে কাজ করত মাসুদ। পরিবারের সঙ্গে মাসুদের যোগাযোগ ছিল না। কেন্দ্র থেকে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তাঁদের সাড়া মেলেনি। আমরা লিগ্যাল এইডের মাধ্যমে তার জন্য আইনজীবীর ব্যবস্থাও করেছিলাম। অভিভাবক না পাওয়ায় জামিন হয়নি।’ বলে রাখা ভালো, কাউকে পাওয়া না গেলে সমাজকল্যাণ অফিসারের জিম্মায় জামিন দেওয়ার বিধান আছে। কিন্তু সেটা অনুসরিত হয়নি।

২০১৯ সালের ১৫ মে। এক চুরির মামলায় গাইবান্ধা জেলখানা থেকে যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে আসে নূরুল ইসলাম। দুই সপ্তাহ যেতে না যেতে তার লাশ পাওয়া যায়। ঘরের ফ্যানের সঙ্গে লুঙ্গি পেঁচিয়ে গলায় নাকি ফাঁস নিয়েছিল সে। বিকেল চারটায় সবাই যখন খেলার মাঠে, তখন আনসার সদস্য শান্তি কী করছিলেন নূরুল ইসলামের ঘরে? শিশু নূরুল ইসলাম কীভাবে নাগাল পেল ফ্যানের! এসব প্রশ্ন উঠলেও কেউ তার জবাব দেয়নি। কেন্দ্রে আনার দু–তিন সপ্তাহের মধ্যে কেন তারা টুপটাপ ‘আত্মহত্যা’ পথ বেছে নিল বা বেছে নেয়, তা কেউ জানতে চায় না। তাদের সঙ্গে আসলেই কী হয়েছিল, তাও অনুসন্ধান করা হয়নি।


সব ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেছিলেন, পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ না থাকায় হতাশা থেকেই ওই কিশোরেরা আত্মহত্যা করেছে। এসবই গৎবাঁধা কথা। আগে থেকেই ছাপানো প্রেস রিলিজের মতো শোনায়। তারপরও কেউ টুঁ শব্দটি করে না। অপরাধীর তকমা কারও গায়ে লাগিয়ে দিলে একদল মানুষ ভাবে, ক্ষতি কী, এভাবে যদি একটু পাতলা হয় অপরাধীর ভিড়! অপরাধীর তকমা দিয়ে খুন–জখম করে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়া বা নিজেদের মধ্যে মারামারি করে মারা গেছে বলে চালিয়ে দেওয়ার চল এ দেশে বহুদিনের। ‘সাত খুন মাফ’ কোনো প্রবাদকথন নয়। এটাই বাস্তব, তা বাস্তবায়নের অধিকার দেওয়া হয়।

প্রজাদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায়ের জন্য জমিদারেরা প্রজাদের ওপর শক্তি প্রয়োগ করতেন এবং অনেক ক্ষেত্রে তা খুন পর্যন্ত গড়াত। রাজস্ব আদায়ের প্রয়োজনে ব্রিটিশ শাসকেরা জমিদার ও তাঁদের লাঠিয়ালদের সাতটি পর্যন্ত খুনের অনুমোদন দেয় এবং এ জন্য তাঁদের কোনো বিচারের সম্মুখীন হতে হতো না। সেখান থেকেই নাকি ‘সাত খুন মাফ’ কথাটির প্রচলন ঘটে।


শিশু বা কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র বললেও সারা দেশে এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে ‘কমবয়সী দাগি অপরাধীদের আটক কেন্দ্র হিসেবে’ প্রচার আছে এবং সে রকম একটা ধারণা বা পারসেপশন তৈরি করার সযত্ন প্রয়াসও হয়তো আছে।


বড়দের জেলখানা থেকে অপ্রাপ্তবয়স্কদের আলাদা করে রাখার মানে এই নয় যে তাদের প্রমাণিত কোনো অপরাধের বিচার হবে না। এ বিষয়ে আইনের পরিষ্কার বিধান আছে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গঠিত আমাদের প্রথম পার্লামেন্টে ১৯৭৪ সালে সে আইন পাস করা হয়েছিল। জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ তৈরির ১৬ বছর আগে বাংলাদেশ এ বিষয়ে বাস্তব পদক্ষেপ নিয়েছিল। যে দেশের প্রায় বেশির ভাগ মানুষই অপ্রাপ্তবয়স্ক, সে দেশে তাদের জন্য করা একটা আইন কেমন করে অবহেলিত থাকে? এভাবে আটক শিশুদের অনেকের ভাগ্য ঝুলতে থাকতে থাকতে একসময় ছিঁড়ে পড়ে।

যশোরে তিন শিশু হত্যার অভিযোগই শেষ ঘটনা হবে, এমন আশ্বাস কি কেউ দিতে পারবেন? তার জন্য চাই বিচার বিভাগীয় তদন্ত, বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ। তদন্তের মাধ্যমে শুধু এবারের বা সেবারের খুনের ঘটনাটা বিশ্লেষণ করা হবে না; বরং কীভাবে এসব অনাচার বন্ধ করা যায়, তার সুপারিশ ও বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ করতে হবে। প্রয়োজনে সুপ্রিম কোর্ট স্পেশাল কমিটি ফর চাইল্ড রাইটসের সঙ্গে পরামর্শ করে পদক্ষেপ নেবে। ভুলে গেলে চলবে না, আমাদের একটা জীবন্ত মানবাধিকার কমিশন আছে। আছে তাদেরও কিছু দায়দায়িত্ব। শিশুদের নিয়ে কাজ করা দেশি-বিদেশি সংস্থাকেও দর্শকের গ্যালারি থেকে উঠে আসতে হবে। ক্ষতি কী তাদের হাইকোর্টে যেতে, জনস্বার্থে শিশু স্বার্থ সুরক্ষায় একটা মামলা করতে।


অভিযোগ প্রমাণিত হলে নির্যাতক বদলি হয়। তাতে নির্যাতনের মাত্রা, ধরন আর কৌশল বদলায়, কিন্তু নির্যাতন বন্ধ হয় না। ‘আত্মহত্যা’র প্রবণতাও কমাতে পারে না। এতিমখানাগুলো নিয়মিত নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষণের আওতায় আনতে হবে। সরাসরি কোনো দলীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন—এমন শিশুমনস্ক নারী-পুরুষদের নিয়ে নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য জেলাভিত্তিক পরিদর্শন দল গঠন করা যেতে পারে। জেল কোডে যেমন বেসরকারি পরিদর্শকের প্রবিধান রাখা হয়েছে, সেসব শর্ত মেনেই তাঁদের মনোনয়ন দেওয়া যায়। পরিদর্শকদের মনোনয়ন দেবেন জেলা জজ। তাঁরা বছরে কমপক্ষে চারটি প্রতিবেদন জমা দেবেন জেলা জজ আর বিভাগীয় কমিশনারের কাছে, যিনি পদাধিকারবলে বিভাগীয় শিশুকল্যাণ বোর্ডের প্রধান। শিশু সুরক্ষা এবং বন্দী শিশুদের হত্যা ও আত্মহত্যার হাত থেকে বাঁচানোর পথ আমাদের খুঁজে বের করতে হবে।

গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক গবেষক
nayeem5508@gmail.com