Thank you for trying Sticky AMP!!

সড়ক-মহাসড়কে নৈরাজ্য

রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের সড়ক-মহাসড়কে বিচিত্র ধরনের যানবাহন যেভাবে চলাচল করে, সেটা বিশৃঙ্খলা বললে কম বলা হয়। এককথায় সেটা নৈরাজ্য, অর্থাৎ এমন এক নিয়ন্ত্রণহীন পরিস্থিতি, যেখানে দায়িত্বশীল নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ ও লোকবল অনুপস্থিত বলে প্রতীয়মান হয়। এই নৈরাজ্য দায়িত্ব পালনে অনাগ্রহ, দুর্নীতি ও জবাবদিহির অনুপস্থিতির ফল।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি ও বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের যৌথ গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে ২০ জন মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে। আহত হচ্ছে এর দ্বিগুণের বেশিসংখ্যক মানুষ। আহত ব্যক্তদের মধ্যে যারা কর্মক্ষমতা হারায়, তারা পরিবারের প্রধান বা একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হলে পরিবারটি চরম অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে যায়। সড়ক দুর্ঘটনা ও এর প্রভাবে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ধরা হয় বছরে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা।

সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ বেপরোয়াভাবে অতিরিক্ত গতিতে যান চালানো। ৯০ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনার জন্য চালকেরাই দায়ী—এমন তথ্য বিভিন্ন গবেষণা থেকে পাওয়া যায়। গত বছরের ২৯ জুলাই ঢাকায় একজন বেপরোয়া বাসচালক একটি কলেজের সামনে সড়কের পাশে অপেক্ষমাণ লোকজনের ওপর বাস তুলে দিলে দুই কলেজ-শিক্ষার্থীর মর্মান্তিক মৃত্যুর পর শিক্ষার্থীদের প্রবল বিক্ষোভ আন্দোলনের চাপে সরকার যেসব পদক্ষেপ ঘোষণা করেছিল, তার অন্যতম ছিল ভুয়া ড্রাইভিং লাইসেন্স বাতিল করা ও লাইসেন্স ছাড়া যানবাহন চালানো বন্ধ করাসহ যানবাহনের চালকদের নিয়মশৃঙ্খলা ও জবাবদিহির আওতায় আনা। কিন্তু শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সাত মাস পরও দেখা যাচ্ছে দেশের মোট যানবাহনচালকদের ৪৭ শতাংশই যানবাহন চালাচ্ছেন ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া।

শনিবার প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৭ লাখ নিবন্ধিত যানবাহন চালাচ্ছেন এমন লোকজন, যাঁরা প্রকৃতপক্ষে যানবাহনের চালক নন। তাঁদের বলা হচ্ছে ‘ভুয়া’ চালক।। তাঁরা বাস-ট্রাকের চালকদের সহকারী; তাঁদের প্রশিক্ষণ নেই, যানবাহনের কারিগরি জ্ঞান নেই, ট্রাফিক আইন সম্পর্কে ধারণা নেই। যেসব চালকের লাইসেন্স আছে, ট্রাফিক আইন সম্পর্কেও ধারণা আছে, তাঁদেরও একটা বড় অংশ বেপরোয়া গতিতে যানবাহন চালানোর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে দুর্ঘটনা ঘটান। তাঁদের এই বিপজ্জনক প্রবণতা কমছে না, কারণ তাঁদের কারণে দুর্ঘটনায় মানুষ হতাহত হলে তাঁদের বিচার করে শাস্তি নিশ্চিত করার কার্যকর ব্যবস্থা নেই।

উপরন্তু দুর্ঘটনা ঘটিয়ে মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী চালকদের বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হলে তাঁরা জোট বেঁধে ধর্মঘটে নামেন আর নেপথ্য থেকে তাঁদের রাজনৈতিক সমর্থন জোগানো হয়। শুধু তা-ই নয়, সড়ক পরিবহন খাতে রাজনৈতিক প্রভাব এত প্রবল যে কোনো পরীক্ষা ছাড়াই হাজার হাজার ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদানে বিআরটিএকে বাধ্য করার অভিযোগ আছে। তা ছাড়া, বিআরটিএর বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগগুলোও আমলে নেওয়া হয় না। ড্রাইভিং লাইসেন্স ও যানবাহনের ফিটনেস সার্টিফিকেট প্রদানের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক, সাংগঠনিক প্রভাব ছাড়াও বিআরটিএ কর্তৃপক্ষের নিজস্ব দুর্নীতির অভিযোগ বরাবরই উপেক্ষিত থেকে গেছে। সরকারি এই সংস্থার অনিয়ম-দুর্নীতি দূর করা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা হয় না কেন, তা এক বিরাট প্রশ্ন।

সড়ক-মহাসড়কে নৈরাজ্যের ফলে শুধু যে দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ঘটে তা নয়, যানজটসহ আরও নানা জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হয়, জাতীয় অর্থনীতিতে যার নেতিবাচক প্রভাব বিরাট। অর্থনীতিবিদদের ধারণা, সড়কে নৈরাজ্যের কারণে বাংলাদেশ মোট জাতীয় উৎপাদনের ২ থেকে ৩ শতাংশ হারাচ্ছে। তাঁরা মনে করেন, সড়কে শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাড়ানো গেলে বিনিয়োগ বাড়বে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও বাড়বে। সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ পরিকল্পনায় ২০২৪ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা ৫০ শতাংশ কমানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন নেই।

কিন্তু এভাবে আর চলতে দেওয়া যায় না। করণীয় নির্ধারণ করা হয়েছে, প্রয়োজন সেসবের বাস্তবায়ন।