Thank you for trying Sticky AMP!!

সম্পাদকীয়

উন্নয়ন গণতন্ত্রের বিকল্প নয়

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) তিন দিনব্যাপী সম্মেলনে দেশের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক নীতি-পরিকল্পনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। এতে যেমন সরকারের নীতিনির্ধারকেরা ছিলেন, তেমনি ছিলেন সরকারের বিভিন্ন নীতির সমালোচক অর্থনীতিবিদেরাও।

দেশি-বিদেশি অর্থনীতিবিদদের অংশগ্রহণে এই সম্মেলনে উন্নয়ন, আর্থিক খাত, দারিদ্র্য, বৈষম্য থেকে শুরু করে বাক্‌স্বাধীনতা ও ভূরাজনীতি নিয়েও প্রাণবন্ত বিতর্ক হয়।

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এ ধরনের নীতি-পরিকল্পনা নিয়ে জাতীয় সংসদেই বেশি আলোচনা হওয়া উচিত। আমাদের দুর্ভাগ্য, জাতীয় সংসদকে আমরা সেই স্তরে নিয়ে যেতে পারিনি। প্রতিবছর বাজেট নিয়ে সংসদে যে আলোচনা হয়, তাতে সংসদ সদস্যরা নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় উন্নয়ন বরাদ্দ বাড়ানোর ব্যাপারেই বেশি আগ্রহী থাকেন। অর্থনৈতিক নীতি–পরিকল্পনা নিয়ে তঁাদের কথা বলতে দেখা যায় না।

এই প্রেক্ষাপটে বিআইডিএস আয়োজিত সম্মেলনটি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় নীতি-কৌশল নিয়ে বিতর্কের রেওয়াজ প্রায় উঠে গেছে। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা কোনো সভা-সেমিনারে গেলে বিরোধী দলের নেতারা যান না কিংবা তাঁদের বাঞ্ছিত ভাবা হয় না।

এই সম্মেলনে উন্নয়নের মূল শক্তি কারা, সেটা নিয়েও বিতর্ক হয়েছে। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা মনে করেন, সরকারই উন্নয়নের প্রধান শক্তি। কিন্তু মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বেসরকারি খাতই মূল শক্তি, সরকার সেখানে সহায়ক নীতি নিয়ে থাকে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে একসময় সমাজতন্ত্র গ্রহণ করলেও এখন প্রায় সবাই মুক্তবাজার অর্থনীতির ধারক-বাহক।

সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যুক্তরাজ্যের আলস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এস আর ওসমানী গণতন্ত্র, বাক্‌স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার, ভোটাধিকার, মানবাধিকার, উন্নয়ন, প্রবৃদ্ধি—এসবের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক তুলে ধরেন। গণতন্ত্রের জন্য ন্যায্যতা ও বাক্‌স্বাধীনতা জরুরি বলে তিনি মন্তব্য করেন। তাঁর এই বক্তব্যে সাধারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে বলে মনে করি। অনেকে উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের মধ্যে বিরোধ দেখানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু তঁাদের মনে রাখা উচিত, গণতন্ত্র ও সুশাসন ছাড়া কোনো দেশে উন্নয়ন টেকসই হয় না।

গণতন্ত্রের ধরন নিয়ে মতভেদ থাকতে পারে। কিন্তু যে মৌলিক বিষয়টি আমরা সংবিধানে যুক্ত করেছি, জনগণই রাষ্ট্রের মালিক, তা থেকে দূরে সরে যেতে পারি না। পরিকল্পনামন্ত্রী আবদুল মান্নান যেভাবে গণতন্ত্র, অধিকার, ভোটাধিকার, সুশাসনের বিষয়টি ঢাকা ও চট্টগ্রামের সুশীল সমাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ বলে মন্তব্য করেছেন, সেটি একপেশে। গ্রামের মানুষের কাছে টিউবওয়েল, সেতু, ঘর, খাবার গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু দেশে সুশাসন, সমতা ও গণতন্ত্র না থাকলে তার নিশ্চয়তাও পাওয়া যাবে না।

এই সম্মেলনে আরও একটি বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা আলোকপাত করেছেন, যার নাম ভূরাজনীতি। একজন অর্থনীতিবিদ বলেছেন, বাংলাদেশ ভূরাজনৈতিক বিতর্কে অতীতে কখনো না জড়ালেও সাম্প্রতিক কালে সেটি দৃশ্যমান হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে ভারসাম্য রক্ষার নীতিই অনুসরণ করতে হবে। বিশ্বের এক নম্বর পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রকে যেমন আমরা অগ্রাহ্য করতে পারব না, তেমনি বাদ দিতে পারব না এশিয়ার বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীনকেও।

অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক নীতিতে সুশাসন ও সমতা প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি ভূরাজনীতিতেও আমাদের ভারসাম্যমূলক নীতি নেওয়া জরুরি। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ যেমনটি বলেছেন, বাংলাদেশের মতো দেশগুলো দুই মডেল থেকেই কিছু কিছু গ্রহণ করতে পারে, গণতন্ত্র না থাকলে তার বাস্তবায়ন আরও দুরূহ হবে। বিআইডিএসের সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে চাই, বাংলাদেশের যাত্রাপথ যতই সংকটাপূর্ণ হোক না কেন, আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতেই হবে।