Thank you for trying Sticky AMP!!

অতিরিক্ত চীননির্ভরতার মূল্য অনেক

বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত দেব মুখার্জি।
>

পূর্ব লাদাখের গালওয়ানে ভারত-চীন রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের আবহে ঘোরালো হয়ে উঠেছে ভারত-নেপাল দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কও। সীমান্ত প্রশ্নে নেপাল কঠোর অবস্থান নিয়েছে। এঁকেছে দেশের নতুন মানচিত্র। ভারতবিরোধিতার ধোঁয়ায় রাজনৈতিক ধুনো দেওয়া হচ্ছে। চীনা সক্রিয়তার আলোয় দক্ষিণ এশিয়ায় প্রতিবেশী সম্পর্ক নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন নেপাল ও বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত দেব মুখার্জি। নয়াদিল্লিতে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রথম আলো: ভারত-নেপাল দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অবনতি ঘটছে দ্রুত। নতুন সংবিধান তৈরি নিয়ে মনোমালিন্য ও অবরোধ থেকে যা শুরু, আজ তা আরও খারাপের দিকে এগোচ্ছে। কেন এ অনভিপ্রেত পরিবর্তন?

দেব মুখার্জি: কয়েক সপ্তাহ ধরে ভারত ও নেপালের সম্পর্ক নিম্নমুখী। ২০১৫ সালে নতুন সংবিধান তৈরির সময় নাগরিকত্ব নিয়ে মদেশীয়দের দেওয়া ভরসা উপেক্ষিত হয়। প্রতিবাদে মদেশীয়রা অবরোধের রাস্তায় এগোয়। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক তখন তলানিতে পৌঁছেছিল। সে সময় আমি বলেছিলাম, মদেশীয়দের প্রতি পার্বত্য নেপালি এলিটদের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ ও জাতিগত বিদ্বেষ ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের মনোভাবের সঙ্গে তুলনীয়। সেই ঘটনার পর সম্পর্ক কিছুটা থিতু হয়। সম্প্রতি লিপুলেখ, কালাপানি ও লিম্পিয়াধুরার ওপর দাবি জানিয়ে নেপাল নতুন মানচিত্র তৈরি করেছে। এ নিয়ে মন-কষাকষি চলছে। ১৮১৬ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে নেপালের পরাজয়ের পর ওই এলাকাগুলো ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার অন্তর্ভুক্ত হয়। বিষয়টার গভীরে অনুসন্ধান করেছি। ওই তিন এলাকার ওপর নেপালের দাবির কোনো যৌক্তিকতা আছে বলে আমি মনে করি না। হ্যাঁ, এটা ঠিক, কালাপানি নিয়ে আলোচনার জন্য নেপালের অনুরোধ মেনে ভারতের আরও দ্রুত সাড়া দেওয়া উচিত ছিল। আবহমান কাল ধরে দুই দেশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের আলোয় দেখলে এই অবনতি অবশ্যই অনভিপ্রেত।

প্রথম আলো: এটা কি অনিবার্য ছিল?

দেব মুখার্জি: অনিবার্য কি না, সেই প্রশ্নের উত্তর একই সঙ্গে ‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’ দুই-ই। ‘হ্যাঁ’, কারণ, ‘নতুন নেপাল’ সময়ে-সময়ে নিজেকে জাহির ও স্বকীয়তার প্রমাণ রাখতে চাইছে। যে যে বিষয় তারা ঠিক মনে করছে, তাদের ধারণায় যা ঐতিহাসিক ভুল, তা শোধরানোর চেষ্টা করছে। সব সময় তা যুক্তিপূর্ণ হয়তো নয়, কিন্তু নিজেকে জাহির করার একটা তাগিদ এই ‘নতুন নেপালের’ মধ্যে অনুভূত হচ্ছে। আবার উত্তরটা ‘না’, কারণ, ইদানীং দেখছি নেপালের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সমীকরণে ভারতবিদ্বেষকে ব্যবহার করা হচ্ছে। এটা করা হচ্ছে ইচ্ছাকৃতভাবে। রাষ্ট্রীয় স্বার্থের বিবেচনাতেও এটা ঠেকানো কঠিন হচ্ছে।

প্রথম আলো: ভারত-নেপাল সম্পর্ক যত খারাপ হচ্ছে, ততই বাড়ছে নেপালের চীননির্ভরতা। কিংবা বলা যায়, চীনের প্রভাবে নেপাল হয়তো বাধ্য হচ্ছে ভারতবিরোধিতার রাস্তায় হাঁটতে। এ অবস্থায় ভারতের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত?

দেব মুখার্জি: নেপালের সাম্প্রতিক আচরণ চীনের উসকানিতে বা অঙ্গুলিহেলনে এমন কোনো প্রমাণ আমি পাইনি। সবাই জানেন, ভারতের সঙ্গে সম্পর্কহানি নিয়ে ওই দেশের শাসক দলে বড় ধরনের মতপার্থক্য রয়েছে। সেই মতপার্থক্য প্রকাশ্যেও আসছে। ভবিষ্যতে দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও ভরসা প্রতিষ্ঠার আগে নেপালের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির গতি–প্রকৃতির প্রবাহ বিবেচনায় নিয়ে ভারতের পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

প্রথম আলো: ভারত-চীন সম্পর্কও এখন নতুন এক সন্ধিক্ষণে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি চীনা ‘সম্প্রসারণবাদের’ প্রসঙ্গ তুলেছেন। নেপালের মাত্রাতিরিক্ত চীননির্ভরতা কি ভবিষ্যতে সে দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে?   

দেব মুখার্জি: ভারত-চীন সম্পর্ক এই মুহূর্তে সত্যিই একটা বাঁকের মুখে দাঁড়িয়ে। ১৯৬২ সালের যুদ্ধের পর দুই দশকের বেশি সময় লেগেছে সম্পর্ক কিছুটা হলেও স্বাভাবিক হতে। সন্ত্রাসবাদ ও সন্ত্রাসী দমনে চীনের নেতিবাচক মনোভাব সত্ত্বেও আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে সীমান্ত ব্যবস্থাপনা এবং পারস্পরিক স্বার্থসংবলিত আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলো ধীরে ধীরে গড়ে তোলা হয়েছিল। বর্তমানে এসব কাঠামো নড়বড়ে হয়ে গেছে। নিরাপত্তা, বাণিজ্য ও লগ্নির ক্ষেত্রে এর নানা ধরনের প্রভাব পড়বে। দুই দেশের সরকার ও জনগণের প্রতিক্রিয়া এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের পরতে পরতে কী প্রভাব পড়ছে, তা জানতে আমাদের এখন বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। আর চীনের প্রতি নেপালের নির্ভরতা কতটা ও কোথায় হবে, সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকারী তারাই। সার্বভৌম, সেই অধিকার তাদেরই নিতে হবে। তবে চীনের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়লে অর্থনীতি, রাজনীতি ও সামরিক ক্ষেত্রে কত মূল্য দিতে হয়, বহু দেশ এখন তা বুঝতে পারছে।

প্রথম আলো: নেপালের পাশাপাশি চীনের নজর পড়েছে ভুটানেও। অরুণাচল প্রদেশ লাগোয়া ভুটান সীমান্তের অধিকার নিয়ে বিতর্ক তুলেছে। 

দেব মুখার্জি: পূর্ব ভুটান সীমান্তে চীনের দাবিটা নতুন। দক্ষিণ চীন সাগর বা পূর্ব লাদাখে সি চিন পিংয়ের চীন যে আগ্রাসী সম্প্রসারণবাদী নীতি আঁকড়ে এগোতে চাইছে, ভুটানে জমির দাবি তারই একটা অঙ্গ। আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় এ নিয়ে অসন্তোষ নিত্য বেড়ে চলেছে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী যা অধিকার তা খর্ব হওয়ার অভিযোগ নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কোনো কোনো দেশ জাতিসংঘের দ্বারস্থ হয়েছে।

প্রথম আলো: এখানেই চলে আসছে বিশ্বস্ত ও বন্ধু প্রতিবেশী বাংলাদেশ প্রসঙ্গ। বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক মসৃণ। ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী বন্ধনও দৃঢ়। কিন্তু তা সত্ত্বেও দুর্ভাগ্যবশত এই পূর্ব প্রতিবেশী রাষ্ট্রে মাঝেমধ্যে ভারতবিরোধী মনোভাব দেখা যাচ্ছে।

দেব মুখার্জি: আমি মনে করি, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক গড়ে তোলা উচিত তার নিজস্ব জাতীয় স্বার্থেই। চীন ও ভারত দুই দেশের সঙ্গেই বাংলাদেশের সম্পর্ক গড়ে তোলা দরকার সার্বিক জাতীয় স্বার্থ বিবেচনার নিরিখেই। সেই স্বার্থ বাংলাদেশকেই ঠিক করতে হবে।

আপনি ভারতবিরোধী মনোভাবের কথা বললেন। বিভিন্ন মিডিয়া, সংবাদপত্র, টেলিভিশন ও অন্যান্য সংবাদমাধ্যমে খবরাখবর যা পড়ি, তাতে কিন্তু বিরোধিতার ইঙ্গিত আমি পাই না। হ্যাঁ, তিস্তার জল বণ্টনের বিষয়টি এখনো ঝুলে রয়েছে। স্বীকৃত ফর্মুলা থাকলেও সমাধান সূত্র মিলছে না। তিস্তা নিতান্তই ভারতের কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কজনিত কারণের বলি। সমাধান সূত্র অধরা থাকার বিষয়টি অবশ্যই দুর্ভাগ্যজনক। এর বাইরে আমার তো মনে হয় বিদ্যুৎ, বাণিজ্য ও লগ্নির ক্ষেত্রে দুই দেশের অগ্রগতি আশাব্যঞ্জক।

প্রথম আলো: নাগরিকত্ব সংশোধন আইন (সিএএ) নিয়ে কি সংশয় দেখা দেয়নি?

দেব মুখার্জি: বিষয়টি অবশ্যই স্পর্শকাতর, আপনি যা ভারতবিরোধিতার বিচ্ছুরণ মনে করছেন। ২০১৯ সালের এই সংবিধান সংশোধন আইন হয়তো পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের জনমতকে প্রভাবিত করছে। ভারতের উচ্চতম মহলের আশ্বাস সত্ত্বেও সিএএ ভিন্ন রকমের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের জনমত আন্দোলিত করেছে। ভারতের সুপ্রিম কোর্টে এ নিয়ে বহু মামলা হয়েছে। আবেদনে বলা হয়েছে এই আইন সংবিধানবিরোধী। তাই খারিজ করা হোক। বিষয়টি অভ্যন্তরীণ এবং বিচারাধীন। কাজেই সিএএ নিয়ে এর বেশি কিছু বলতে চাই না।

প্রথম আলো: ভারতের বিরোধীদের অনেকের ধারণা, বৈশ্বিক নেতা হিসেবে প্রধানমন্ত্রী মোদির গ্রহণযোগ্যতা বাড়লেও প্রতিবেশীদের ওপর ভারতের প্রভাব কমছে। আপনার অভিমত কী?

দেব মুখার্জি: দেশ সম্বন্ধে বৈশ্বিক দুনিয়ার ধারণার নিরিখেই সাধারণত কোনো দেশের রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীরা গুরুত্ব পেয়ে থাকেন। তবে ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়। যেমন নেলসন ম্যান্ডেলা। বর্তমান অর্থনৈতিক মানদণ্ড এবং অভ্যন্তরীণ উন্নয়নের ভিত্তিতেই ভারতকে বৈশ্বিক দুনিয়া বিচার করবে। ২০১৪ ও ২০১৯ সালে তাঁর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদি প্রমাণ দিয়েছেন প্রতিবেশীদের তিনি কতটা গুরুত্ব দেন। পাকিস্তান ও বর্তমানের নেপালকে যদি আলাদা করা যায়, তাহলে দেখা যাবে অন্য সব প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক আপাতদৃষ্টিতে অপরিবর্তিত।

প্রথম আলো: ভারতের আদর্শ প্রতিবেশী নীতি তাহলে কেমন হওয়া উচিত?

দেব মুখার্জি: সমালোচকদের ধারণা, সদিচ্ছা সত্ত্বেও নিরবচ্ছিন্ন স্ট্যামিনা নিয়ে ভারত তার প্রতিবেশীদের লালন করেনি। পাকিস্তানের ওপর অত্যধিক নজর দেওয়ার দরুন অন্য প্রতিবেশীদের বহু ন্যায্য প্রয়োজন অবহেলিত থাকছে।৪০ বছর আগে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আমি বাংলাদেশের দায়িত্বে ছিলাম। তখন ভাবতাম, বাংলাদেশ প্রস্তাবিত সার্ক এক দারুণ আইডিয়া। ভারতের বিশালত্বের কারণে কোনো প্রতিবেশী বিপন্ন বোধ করবে না অথচ সহযোগিতা হবে সর্বাত্মক। দুঃখের বিষয়, সার্ক কখনোই পূর্ণ বিকশিত হলো না।

প্রতিবেশীদের ক্ষেত্রে মৌলিক সত্য একটাই। আমরা সবাই একই ‘ইকো সিস্টেম’ বা বাস্তুতন্ত্র দ্বারা পরিচালিত। কোনো কিছু যা একজনের পক্ষে বিপজ্জনক, তা অন্যদের ক্ষেত্রেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া আনে। আমি মনে করি, ‘প্রত্যেকে আমরা পরের তরে’ এই মনোভাব থাকা খুবই জরুরি। কারও সার্বভৌমত্ব হানি না করে, অনধিকার চর্চায় না গিয়ে সহযোগী মনোভাব নিয়ে একে অন্যের প্রয়োজন ও উদ্বেগের শরিক হওয়া উচিত। দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম দেশ হিসেবে এ ক্ষেত্রে ভারতের দায়িত্ব প্রাথমিক।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

দেব মুখার্জি: আপনাকেও ধন্যবাদ।