Thank you for trying Sticky AMP!!

জঙ্গি প্রতিরোধে জাতীয় কৌশল নেই : ইশফাক ইলাহী চৌধুরী

>হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার দুই বছর পূর্ণ হলো আজ। এই দিনটিকে কেন্দ্র করে প্রথম আলো মুখোমুখি হয়েছিল নিরাপত্তা বিশ্লেষক এয়ার কমোডর (অব.) ইশফাক ইলাহী চৌধুরীর। তিনি কথা বলেছেন বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের বর্তমান পরিস্থিতি, বিপদের আশঙ্কা এবং জঙ্গিবাদ মোকাবিলার দরকারি পথ ও কৌশল নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান
ইশফাক ইলাহী চৌধুরী

প্রথম আলো: হোলি আর্টিজান ট্র্যাজেডির দুই বছর পূর্ণ হলো। এখনো পুলিশ তদন্ত রিপোর্ট দিতে পারেনি। রহস্যটা কী?

ইশফাক ইলাহী চৌধুরী: আমি মনে করি, আমাদের দেশে আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে যে দীর্ঘসূত্রতা আছে, এটি তারই নির্মম প্রতিফলন। এই দীর্ঘসূত্রতার কারণে আইনের প্রতি মানুষের আস্থা কমে যাচ্ছে। অনেক সময় বিচারবহির্ভূত হত্যাকেই সহজ পথ হিসেবে বেছে নেওয়া হচ্ছে। জঙ্গিবিরোধী অভিযান পরিচালনায় বিশেষায়িত সংস্থা গঠন করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষ আগামী ১০ দিনের মধ্যে চার্জশিট দেওয়ার কথা বলেছে। এটিকে অগ্রগতি বলা যায়। এ প্রসঙ্গে আরেকটি কথা বলতে চাই। জঙ্গিবিরোধী অভিযানকালে আইন প্রয়োগকারীদের হাতে রেস্তোরাঁর একজন বাবুর্চিও মারা গেছেন। তিনি নিরপরাধ হলে রাষ্ট্রের দায়িত্ব হবে তাঁর পরিবারকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেওয়া।

প্রথম আলো: ওই দিন যেসব জঙ্গি সরাসরি হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল, তারা মারা পড়েছে। কিন্তু তাদের নেপথ্যে যারা ছিল, তারা তো সবাই ধরা পড়েনি।

ইশফাক ইলাহী চৌধুরী: নেপথ্যের কুশীলবদের মধ্যে তামিম চৌধুরীসহ বেশ কয়েকজন ধরা পড়েছে। কেউ কেউ মারাও পড়েছে। কিন্তু ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িত আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের অনেকে বাইরে আছে। আরেকটি জঙ্গি হামলার ঘটনায় সংস্থাটির প্রধান নেতা রাহমানির কয়েক বছর জেল হয়েছে। লঘু শাস্তি। যে লোকটি এতগুলো মানুষ হত্যায় নেতৃত্ব দিয়েছেন, ঘাতকদের তাত্ত্বিক নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন, তাঁর কঠোর শাস্তি হতে হবে। আশা করি, গভীর তদন্তের মাধ্যমে হোলি আর্টিজানে হত্যার নেপথ্যে আরও কারা ছিল, তা বেরিয়ে আসবে।

প্রথম আলো: সরকার জঙ্গিবিরোধী অভিযান সফল বলে দাবি করছে, আবার জঙ্গিদের হাতে মানুষ মরছে। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?

ইশফাক ইলাহী চৌধুরী: এ কথা সত্য যে জঙ্গিবিরোধী অভিযানে অনেক জঙ্গি ধরা পড়েছে, অনেকের আস্তানা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে মনে রাখতে হবে, জঙ্গিরা একটি আদর্শের জন্য লড়ছে, যদিও সেটি ভ্রান্ত। শুধু সামরিক অভিযান চালিয়ে জঙ্গিবাদ নির্মূল করা যাবে না। প্রকাশক শাহজাহান বাচ্চু হত্যায় প্রমাণিত হলো, তারা নিষ্ক্রিয় হলেও নির্মূল হয়নি। এই ব্যাধি দূর করতে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। হোলি আর্টিজানের পর জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে যে জনমত তৈরি হয়েছিল, সেটি কাজে লাগাতে হবে। শিক্ষক, অভিভাবক, ধর্মীয় নেতাসহ সবার অংশগ্রহণে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। 

প্রথম আলো:গত কয়েক বছরে জঙ্গিদের হাতে অনেক মানুষ মারা গেছেন। কিন্তু রাজীব হত্যা ছাড়া কোনোটিরই বিচার হয়নি। সৌ

ইশফাক ইলাহী চৌধুরী: রাজীব হত্যার বিচার হলেও আসামিরা এখনো শাস্তি পায়নি। মামলাটি উচ্চ আদালতে বিচারাধীন। রাজীব এশিয়া প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল। খুব গরিব ঘরের ছেলে। যারা তাকে হত্যা করেছে, সবাই ধনীর সন্তান। মামলা দীর্ঘদিন ঝুলে থাকলে সাক্ষ্য-প্রমাণ হারিয়ে যেতে পারে। আর অপরাধীরা শাস্তি পেলে আইনের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরে আসত। জঙ্গিরাও ভাবত, মানুষ খুন করে পার পাওয়া যাবে না।

প্রথম আলো: কারাগারে অনেক জঙ্গি দীর্ঘদিন আটক আছে। তাদের মাধ্যমে তো অন্য বন্দীদের মধ্যেও জঙ্গিবাদ সংক্রমিত হচ্ছে।

ইশফাক ইলাহী চৌধুরী: শুধু কারাগার নয়, সবখানেই সংক্রমিত হতে পারে। এই কয়েদিরা যখন বাইরে বেরিয়ে আসবে, তখন সমাজের নানা অংশের সঙ্গে মিশবে। আমাদের কারাগারের ভেতরে বা বাইরে জঙ্গিদের সংশোধনের জন্য কোনো ব্যবস্থা নেই। এটি করা প্রয়োজন। কিন্তু কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, তাদের কাছে কোনো তহবিল নেই।

প্রথম আলো: কোনো অভিযানে জঙ্গিরা মারা পড়লেই সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, জঙ্গি সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। আপনি কী বলেন?

ইশফাক ইলাহী চৌধুরী: যখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মনে করে কোনো সমস্যা নেই, দেখবেন একটি অঘটন ঘটছে। হোলি আর্টিজান ট্র্যাজেডির আগে একটি সংস্থার প্রধান বেশ জোর দিয়ে বলেছিলেন, দেশে জঙ্গি সমস্যা নেই। সব নির্মূল করেছি। কিন্তু তাঁদের মনে রাখা প্রয়োজন, দেশটি ছোট হলেও লোকসংখ্যা অনেক। এর মধ্যে কে কোথায় লুকিয়ে আছে, তা জানা সম্ভব নয়। অনেক বেকার তরুণ আছেন, যাঁরা মনে করেন ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত, তাঁদের জঙ্গিবাদে দীক্ষিত করা কঠিন নয়। এখন ইউটিউবে, ফেসবুকেও এর পক্ষে নানা রকম প্রচার চালানো হচ্ছে।

প্রথম আলো: বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ার কারণ কি সরকারের সাফল্য, না বৈশ্বিকভাবেই তাদের দুর্বল হয়ে যাওয়া?

ইশফাক ইলাহী চৌধুরী: দেশীয় প্রেক্ষাপটে সরকারের সাফল্য আছে। আবার আন্তর্জাতিকভাবে জঙ্গিরা দুর্বল হয়েছে, সেটিও সত্য। এত দিন জঙ্গিরা যেসব উৎস থেকে সমর্থন পেয়েছিল এখন আর পাচ্ছে না। রাকায় আইএসের পতনের পর তারা শক্ত ঘাঁটি গড়তে পারেনি। তবে এতে আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই। নতুন করে তারা আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে ঘাঁটি গেড়েছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ হিসেবে ইন্দোনেশিয়ার খ্যাতি আছে। সেখানেও জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তবে সৌদি আরবের পরিবর্তনটি ইতিবাচক। সেখানে আধুনিকীকরণের বাতাস বইছে। যুবরাজ সালমান নারীর ক্ষমতায়নসহ সামাজিক সংস্কারে সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছেন। পশ্চিমা শক্তি এখন জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে যত কঠোর অবস্থান নিক না কেন, তারা একসময় সোভিয়েতের বিরুদ্ধে আফগানিস্তানে মুজাহিদ তৈরি করেছিল। পাকিস্তানে হাজার হাজার মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছিল।

প্রথম আলো: জঙ্গিবিরোধী অভিযানে যুক্ত সংস্থাগুলোর সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। আছে সমন্বয়হীনতাও। 

ইশফাক ইলাহী চৌধুরী: আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সক্ষমতা বেড়েছে, এ কথা সত্য। জঙ্গি মোকাবিলায় পুলিশ আছে, ডিবি আছে, র‌্যাব আছে, জঙ্গি দমনে বিশেষ ইউনিট গঠিত হয়েছে। এরা প্রত্যেকে নিজের সফলতা দেখাতে উৎসাহী। সবাই সফলতার অংশীদার হতে চায়, কেউ ব্যর্থতার দায় নিতে চায় না। এ ক্ষেত্রে কিছুটা সমন্বয়হীনতাও আছে বলে মনে করি। জঙ্গিবাদ শুধু আইনশৃঙ্খলাজনিত সমস্যা নয়। এদের প্রতিরোধ করতে হলে জাতীয় কৌশল থাকতে হবে; ঘটনার আগের করণীয়, পরের করণীয় ঠিক করতে হবে, যা এখনো হয়নি। আশার কথা, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ জঙ্গিদের প্রত্যাখ্যান করেছে। মা–বাবা জঙ্গি সন্তানকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন, মৃত্যুর পর তার লাশ গ্রহণ করেননি।

 জঙ্গি দমনের অনেকগুলো স্তর আছে—অভিযান বা অ্যাকশন, প্রশিক্ষণ, বিনিয়োগ ও নজরদারি। এর কোনোটিতে ঘাটতি থাকলে অভিযান সফল বলা যাবে না। এটি অনেক ব্যয়বহুলও। এ জন্য জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে অভিযানের বাইরেও বহুমাত্রিক কার্যক্রম নিতে হবে। একবার এক লাখ ইমামের স্বাক্ষরে একটি আবেদন জানানো হয়েছিল। কিন্তু তা নিয়েও বিতর্ক হয়। অনেকে সেই আবেদনের বিরোধিতা করেন। প্রতি শুক্রবার মসজিদে জঙ্গিবিরোধী প্রচার চালানোর কথা বলা হয়েছিল; তা খুব একটা কার্যকর হয়নি। বরং অনেক সময় এমন ধরনের কথাবার্তা বলানো হয়, যা সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদকে উসকে দেয়।

প্রথম আলো: বাইরের জঙ্গিরা এখানে আসছে, আবার এখানকার জঙ্গিরা বাইরে যাচ্ছে। এই আমদানি-রপ্তানি বন্ধের উপায় কী?

ইশফাক ইলাহী চৌধুরী: বিশ্বায়নের যুগে যোগাযোগ ও যাতায়াত সহজ হয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের এক জঙ্গি ভারতে ধরা পড়েছে। আবার পাকিস্তান ও ভারত থেকে আসা অনেক জঙ্গিও এখানে গ্রেপ্তার হয়েছে। জঙ্গিরা ভৌগোলিক সীমানা মানে না। এদের আসা-যাওয়া বন্ধ করতে হলে রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোকে আরও সজাগ থাকতে হবে।

প্রথম আলো: গণতান্ত্রিক অধিকার সংকুচিত হয়ে যাওয়া জঙ্গিবাদী তৎপরতাকে উৎসাহিত করছে কি না?

ইশফাক ইলাহী চৌধুরী: যেসব দেশে মুক্ত গণতান্ত্রিক পরিবেশ আছে, সেসব দেশেও জঙ্গিবাদ আছে। তবে আমি মনে করি, উদার গণতন্ত্রচর্চা এই অপশক্তি প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। সে জন্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে এগিয়ে নিতে হবে। সরকারি ও বিরোধী দল ধর্মাশ্রয়ী কোনো দল বা সংগঠনকে প্রশ্রয় দেবে না, তাদের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধবে না—এটাই প্রত্যাশিত।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

ইশফাক ইলাহী চৌধুরী: ধন্যবাদ।