Thank you for trying Sticky AMP!!

জলবায়ু সম্মেলন বড় অর্জন না হলেও অগ্রগতি আছে

বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বৈজ্ঞানিক ও নীতি গবেষণায় ড. আতিক রহমান সত্তরের দশক থেকে কাজ করছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে স্নাতকোত্তর শেষ করে তিনি একই বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭৪ সালে যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে এনার্জি ম্যাটেরিয়ালস নিয়ে গবেষণা করেন। তবে ওয়েস্ট লন্ডনের ব্রুনেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৮৬ সালে গড়ে তোলেন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজ (বিসিএএস)’। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত বিজ্ঞানীদের আন্তর্জাতিক জোট আইপিসিসি ২০০৭ সালে নোবেল পুরস্কার পায়। ড. আতিক ওই সময়ে সংস্থাটির একজন বিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করতেন। ২০০৮ সালে ড. রহমান জাতিসংঘের সম্মানিত পরিবেশ পদক ‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ’ পান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইফতেখার মাহমুদ

ড. আতিক রহমান
প্রশ্ন

প্রথম আলো: স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে ২৬তম বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন হয়ে গেল। এখান থেকে আমরা কী আশা করেছিলাম?

আতিক রহমান: গত দুই বছর বিশ্ব করোনা মহামারির এক বড় সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এর মধ্যেও জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টিকে বিশ্বের কোনো দেশ আলোচনা থেকে বাদ দিতে পারেনি। এই সম্মেলন শুরুর আগে আইপিসিসি থেকে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে বলা হয়েছিল, যেকোনো মূল্যে এই শতাব্দীর মধ্যে বিশ্বের তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখতে হবে। আমরা সবাই আশা করেছিলাম, এই সম্মেলনের মাধ্যমে ২০১৫ সালে হওয়া প্যারিস চুক্তির অনেকগুলো শর্ত বাস্তবায়নের অগ্রগতি আমরা দেখতে পাব। এই সম্মেলনের আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনে হেরে যাওয়া আর বাইডেনের জিতে যাওয়ার ঘটনা ভিন্নমাত্রা দিয়েছিল। কারণ, বাইডেন ক্ষমতায় এসেই প্যারিস চুক্তি নিয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখালেন। এটি আমাদের আশাবাদকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। তবে একদম যে দুশ্চিন্তা ছিল না, তা বলা যাবে না। বিশ্বের অন্যতম প্রধান কার্বন নিঃসরণকারী রাষ্ট্র চীন ও রাশিয়া সম্মেলনে অংশ নেবে কি না এবং তারা কী ভূমিকা রাখবে, এটা পরিষ্কার ছিল না। ফলে এ সম্মেলনে বিরাট কিছু হয়ে যাবে, এ আশাবাদ খুব বেশি ছিল না। তবে অনেক অমীমাংসিত বিষয় নিয়ে আলোচনার অগ্রগতি হবে, সেই আশা
নিশ্চয়ই ছিল।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: কপ ২৬ নামের এ সম্মেলন থেকে আমরা কী পেলাম?

আতিক রহমান: এখান থেকে যুগান্তকারী কিছু অর্জন হয়েছে, এটা বলা যাবে না। তবে অনেকগুলো বিষয়ে ভালো অগ্রগতি আছে। করোনার এ সময়ে এত বড় একটি সম্মেলনের আয়োজন করা এবং সফলভাবে তা শেষ করাটাও একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন বলে মনে করি। বন ধ্বংস বন্ধ করার ব্যাপারে বিশ্বের বড় ও গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রগুলো অঙ্গীকার করেছে। বাংলাদেশ শেষ মুহূর্তে সেখানে সম্মতি দিয়েছে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে আমি মনে করি। কারণ, বিশ্বজুড়ে বন ধ্বংস দ্রুতগতিতে হচ্ছিল। আমাজন বা কঙ্গোর মতো বিশাল বনভূমির ধ্বংস বিশ্বের কার্বন ধরে রাখার ক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছিল। ফলে বিশ্বের সব বন রক্ষা এবং ধ্বংস বন্ধ করার জন্য একটি ঐকমত্যে পৌঁছেছে, এটা এ সম্মেলনের অন্যতম অর্জন। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণের জন্য বনায়ন এবং বন ধ্বংস বন্ধ গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

বিজ্ঞানের সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, কৃষি খাত থেকে প্রচুর মিথেন গ্যাস নির্গত হয়। কার্বন নিঃসরণের চেয়ে মিথেন গ্যাসের বিশ্বের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা ২৪ গুণ বেশি। বিশ্বজুড়ে ধ্বংস হওয়া বন, জৈব বর্জ্য, আবর্জনা থেকে শুরু করে পানিতে ডুবিয়ে রাখা ধান বা অন্য কোনো ফসল থেকে মিথেন গ্যাস নির্গত হয়। ধানগাছের শিকড় পানিতে ডুবিয়ে রেখে চাষ করা বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশেই করা হয়। এতে বিপুল পরিমাণ মিথেন গ্যাস নির্গত হয়। কিন্তু বিজ্ঞানের সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, এভাবে না ভিজিয়ে ধান চাষ করা সম্ভব। প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে ধানগাছের শিকড়ের চারার মধ্যে নির্দিষ্ট পরিমাণে আর্দ্রতা ধরে রাখলেও চলবে। এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বিশ্ববাসী কীভাবে প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে এবং সব দেশ এসব প্রযুক্তি যাতে ভাগাভাগি করে ব্যবহার করতে পারে, তা নিয়ে বেশ অগ্রগতি হয়েছে।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: কয়লার ক্ষেত্রে?

আতিক রহমান: কয়লা বিশ্বের অন্যতম প্রধান কার্বন নিঃসরণকারী উৎস। বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বিভিন্ন খাতে এর ব্যবহার বন্ধের ব্যাপারে বিশ্ব একমত হয়েছে। তবে কত বছরের মধ্যে তা করা হবে, তা নিয়ে দুটি মত এসেছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নসহ পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো চাইছে ২০৩০ সালের মধ্য কয়লার ব্যবহার বন্ধ করার ঘোষণা। চীন ও ভারত চাইছে ২০৭০ সালের মধ্যে তা করতে। বাংলাদেশ চীন ও ভারতের দিকে মত দিয়েছে। এর বাস্তব অনেক কারণও আছে। আমাদের বিদ্যুৎ ও জ্বালানির অন্যতম বড় উৎস কয়লা। তাই চাইলেই আমরা এত তাড়াতাড়ি সব কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করতে পারব না। তবে এগুলো বন্ধ করতে হবে, সেটার ব্যাপারে অন্তত ঐকমত্যে পৌঁছানো গেছে, সেটা কম গুরুত্বপূর্ণ অর্জন নয়।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: কিন্তু এবারের সম্মেলনে তো রাশিয়া ও চীনের সরকারপ্রধান আসেননি। এ দুই দেশ তো প্যারিস চুক্তির বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।

আতিক রহমান: হ্যাঁ, এ দুই দেশের সরকারপ্রধান আসেননি। তবে তাঁদের রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিরা ছিলেন। তাঁরা নিজেদের দেশের অবস্থান জানিয়েছেন। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বিশ্বের সব রাষ্ট্র কীভাবে একযোগে কাজ করতে পারে, তা নিয়ে সব দেশ একমত হয়েছে। চীন নিজে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানো নিয়ে গবেষণা এবং বাস্তবায়নের বিষয়ে অনেক অগ্রসর হয়েছে। তাদের দিকে বিশ্বের অনেক কিছু নির্ভর করছে। কারণ, এখন তো চীন বিশ্বের সবচেয়ে বড় কার্বন নিঃসরণকারী এবং ধনী দেশ। ফলে তাদের ইতিবাচক ভূমিকা থাকলে তা বৈশ্বিক অর্জনের জন্য জরুরি। চীনের ক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, তারা যদি কোনো বিষয়ে অঙ্গীকার করে, তাহলে তা রক্ষা করে। করোনা পরিস্থিতি সামলানোসহ নানা কারণে এ সম্মেলনে তাদের রাষ্ট্রপ্রধান এসে কোনো সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার করে যাবেন, সে পরিস্থিতি হয়তো তাদের ছিল না। তবে তারা ইতিবাচকভাবে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কার্বন নিঃসরণ কমানোর চেষ্টা করছে। যেটা এই শতাব্দীর মধ্যে তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি বাড়তে না দেওয়ার পক্ষে বড় অগ্রগতি বলে মনে করি।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: এই শতাব্দীর মধ্যে বিশ্বের তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি বাড়তে না দেওয়ার জন্য অগ্রগতি কতটুকু?

আতিক রহমান: এখন পর্যন্ত যেসব বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং মূল্যায়ন প্রতিবেদন আমরা দেখেছি, তাতে অগ্রগতিকে ইতিবাচক বলা যাবে না। কারণ, এই শতাব্দীর প্রথম ২১ বছরে বিশ্বের তাপমাত্রা ১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেছে। এর মানে, সামনের ৭৯ বছরের মধ্যে তাপমাত্রাকে দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি বাড়তে দেওয়া যাবে না। এটা আসলেই বেশ কঠিন। বিজ্ঞানীদের আরেকটি দল বলছে, এ পর্যন্ত ১ ডিগ্রির বেশি তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় দুর্যোগ বেড়ে যাওয়াসহ নানান ধরনের নেতিবাচক প্রভাব আমরা টের পাচ্ছি। দরিদ্র দেশগুলো তো বটেই, উন্নত দেশগুলোর পক্ষে এসব দুর্যোগ সামলানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এ বছর আমরা দেখলাম, জার্মানিতে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা হলো। কানাডার তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠে গিয়ে অনেক মানুষ মারা গেল। এখন দেশটিতে তীব্র বন্যা চলছে। যুক্তরাষ্ট্রে একের পর এক ঘূর্ণিঝড় আঘাত করছে। আর বাংলাদেশ, ভারত ও চীন তো প্রতিবছর রেকর্ড ভাঙা বন্যার মুখে পড়ছে। এ সবকিছু যে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে হচ্ছে, তা বিজ্ঞানীরা আগের চেয়ে আরও শক্তিশালী তথ্য-উপাত্ত দিয়ে প্রমাণ করেছেন।

ফলে বিশ্বের তাপমাত্রা কমানোর কোনো বিকল্প নেই। বিজ্ঞানীদের একটি অংশ মনে করছে, এই শতাব্দীর মধ্যে তাপমাত্রা কোনোভাবে দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি বাড়তে দেওয়া যাবে না। কারণ, ১ ডিগ্রি বেড়ে গিয়ে আমরা যেসব সমস্যা এবং বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছি, তা সামলানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে। ফলে ওই হিসাবে আমাদের আর দশমিক ৪ ডিগ্রির বেশি তাপমাত্রা যাতে না বাড়ে, সেই লক্ষ্যে এগোতে হবে।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: বাংলাদেশ কি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সঠিক পথে এগোচ্ছে?

আতিক রহমান: প্রথমত, আমরা তো এটা বলতেই পারি, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমরা বিশ্বের অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্র। সে কথা বিশ্বদরবারে আমরা যথেষ্ট ভালোভাবে তুলতে পেরেছি। প্যারিস চুক্তিসহ অন্য অনেক বিষয়ে বিশ্বের অনেক রাষ্ট্র থেকে এগিয়ে আছি। যেমন আমরা নিজেদের অর্থায়নে প্রথম একটি জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করেছিলাম। সেটি এখনো চালু আছে। একটি কৌশলপত্র করেছি, জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মুজিব প্রসপারিটি পরিকল্পনা করেছি। এ ছাড়া আমরা বাজেটে জলবায়ু পরিবর্তন খাতে নিয়মিত বরাদ্দ রাখছি।
আমাদের পদ্মা সেতুর মতো বড় অবকাঠামো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে মাথায় রেখে করা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় এবং বন্যায় মৃত্যুহার আমরা অনেক কমিয়ে আনতে পেরেছি। কারণ, আমরা ঘূর্ণিঝড় ও বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র করেছি। এ ধরনের দুর্যোগের আগাম পূর্বাভাস আমরা দিতে পারছি। দুর্যোগের আগে আমরা সম্ভাব্য ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের আশ্রয়কেন্দ্রে নিতে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী তৈরি করতে পেরেছি। এগুলো বিশ্বের অনেক দেশের জন্য মডেল হিসেবে অনুসরণ করা হচ্ছে।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: এ উদ্যোগগুলো কি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে বলে মনে করেন?

আতিক রহমান: জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে আমাদের বিজ্ঞানীরা অনেক আগে থেকে কাজ করলেও সরকারিভাবে এ বিষয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা খুব বেশি দিনের নয়। এ জন্য এ ক্ষেত্রে আমাদের আরও অনেক অগ্রগতি দরকার। সরকার পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন যুক্ত করেছে। এটিও ইতিবাচক দিক। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, পরিবেশ ও বন রক্ষার কাজের চেয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি আলাদা। দেশের সব মন্ত্রণালয়কে এখন জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার কাজ করতে হচ্ছে। ফলে আমাদের এ বিষয়ে একটি আলাদা অধিদপ্তর এবং মন্ত্রণালয় দরকার। সরকারি উদ্যোগে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কাজ করার জন্য দক্ষ জনবল তৈরি করা দরকার। পরিবেশ অধিদপ্তর এবং মন্ত্রণালয়ের বিদ্যমান কাঠামো দিয়ে এত বড় বিপর্যয় মোকাবিলার কাজ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

আতিক রহমান: আপনাকেও ধন্যবাদ।