Thank you for trying Sticky AMP!!

রাষ্ট্রের নৃশংসতা সমাজের মধ্যে পুনরুৎপাদিত হয়

আনু মুহাম্মদ
>

ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে মানুষ মারা যাচ্ছে। নারী-শিশু ধর্ষণ ও হত্যা থামছে না। শিক্ষাঙ্গনে চলছে অস্থিরতা। সব মিলিয়ে মানুষের মধ্যে প্রচণ্ড নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হলেও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না। এসব নিয়ে কথা বলেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মশিউল আলম

প্রথম আলো: গণপিটুনিতে লোকজনের মৃত্যুর ঘটনা হঠাৎ করেই যেন বেড়ে গেছে। এটা কি কোনো কিছুর লক্ষণ মনে হয়?

আনু মুহাম্মদ: সরকারের জবাবদিহি প্রতিষ্ঠান নির্বাসনে গেলেই এ রকম অবস্থা হয়। শুধু গুজব নয়, অনেক সময় কাউকে টার্গেট করেও এ ধরনের গণপিটুনি হয়। কারও বিরুদ্ধে যত অভিযোগই থাকুক, তাকে পিটিয়ে-কুপিয়ে মারার অধিকার কারও নেই। কিন্তু প্রতিটি গণপিটুনির নৃশংসতার সময় একটি কথা খুব শোনা যায় ‘মাইরা ফালা, পুলিশ কোনো বিচার করবে না, ছেড়ে দেবে অপরাধীকে।’ সুতরাং তাকে আমাদেরই শায়েস্তা করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত বিভিন্ন বাহিনীর প্রতি মানুষের আস্থা উদ্বেগজনকভাবে কমে গেছে। আস্থা ফিরিয়ে আনতে গিয়ে বাহিনীগুলো মাঝেমধ্যে ছিনতাইকারী, মাদক ব্যবসায়ী, ধর্ষণকারী হিসেবে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ক্রসফায়ারে দেয়। এসব ক্রসফায়ার কিন্তু কার্যত তাদের প্রতি আস্থা তৈরিতে কোনো ভূমিকা পালন করে না। বরং মানুষ একই পথ গ্রহণ করে, সিদ্ধান্তে আসে এভাবেই কাউকে অপরাধী মনে করলে পিটিয়ে মেরে ফেলা যায় এবং তা–ই করতে হবে। রাষ্ট্রের নৃশংসতা সমাজের মধ্যে পুনরুৎপাদিত হয়।

প্রথম আলো: আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারের সঙ্গে গণপিটুনির কোনো তুলনা টানা যায়?

আনু মুহাম্মদ: দুটোর মধ্যে মৌলিক কোনো তফাৎ নেই। ‘ক্রসফায়ার’ ‘বন্দুকযুদ্ধ’ ইত্যাদি নামে মানুষ খুনের ঘটনা যেভাবে ঘটছে, তা দেশের আইন-বিচারব্যবস্থা ও রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের অস্তিত্বের যৌক্তিকতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়। এর মধ্যে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত থাকে একই গল্পের পুনরাবৃত্তি, মিথ্যাচার। অনেক ক্ষেত্রে গ্রেপ্তার করে হেফাজতে নিয়ে তারপর এই হত্যাকাণ্ড ঘটে। পুরো প্রক্রিয়াটি একটি দানবীয় চেহারা নেয়। এভাবে খুন করার পর আমাদের জানানো হয় তার নামে মামলা আছে, সে সন্ত্রাসী, সে মাদকসেবী ইত্যাদি। হাজারেরও বেশি মানুষ এভাবে নিহত হয়েছে। কোনো তদন্ত হয়নি। সংবাদমাধ্যমগুলোও এগুলো নিয়ে অনুসন্ধান করতে পারেনি। একাধিক ঘটনায় স্বজনদের ভাষ্য, পত্রিকার দু-একটি লাইন থেকে আমরা জানি, মিথ্যা অভিযোগও আনা হয় অনেকের বিরুদ্ধে। তার মানে নিহত ব্যক্তি শুধু খুনের শিকার হয়নি, মৃত্যুর পর অপবাদেরও শিকার হয়েছেন। এগুলো নিয়ে কোনো মামলাও করা যায় না ভীতি, ত্রাস সৃষ্টির কারণে। লিমনের কথা স্মরণ করতে পারি। কুখ্যাত এক সন্ত্রাসীর নাম দিয়েই তাঁকে গুলি করা হয়েছিল, লিমন বেঁচে না থাকলে তঁার নাম আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর খাতায় সন্ত্রাসী হিসেবেই থাকত। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর অনেক ক্ষেত্রে অনিয়মতান্ত্রিক ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ থাকায় সমাজের প্রভাবশালী বিত্তবান ব্যক্তিরা সহজেই এর সুযোগ নিতে পারে। নিজেদের প্রতিপক্ষকে তারা ক্রসফায়ারে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে পারে। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর এমন প্রাইভেট সার্ভিসের নমুনা আমরা নারায়ণগঞ্জে সাত খুনসহ নানা জায়গায় দেখছি। এর ভেতরের যুক্তি গণপিটুনির যুক্তির সঙ্গে মিলে যায়। বিচার হবে না, জামিন পেয়ে যাবে, সে জন্য মেরে ফেলাই যৌক্তিক। আমরা জানি, বিচার যে হয় না, তার পেছনে ক্ষমতাবানদের প্রভাব, পুলিশ–র‍্যাবের দাখিল করা কাগজপত্র, কিংবা ওপরের নির্দেশই দায়ী। আবার তারাই ক্রসফায়ারের মূল কর্তা। সে জন্য আমরা মন্ত্রীসহ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের ক্রসফায়ারের পক্ষে যুক্তি দিতে শুনি। প্রায়ই আমরা দেখি, ক্রসফায়ারে নিহত ব্যক্তি সমাজের কাছে চিহ্নিত অপরাধী, কিন্তু বিচার না করে তাঁকে ক্রসফায়ার দিয়ে আড়াল করা হয় ক্ষমতাবানদের। সর্বশেষ নয়ন বন্ড হত্যা তার প্রকাশ।

প্রথম আলো: নারী-শিশুদের ধর্ষণ, ধর্ষণের পর মেরে ফেলা, লোকজনকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে বা গায়ে আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে মারা—এ রকম নানা ধরনের নিষ্ঠুর অপরাধের বৃদ্ধি লক্ষ করা যাচ্ছে। অপরাধে সহিংসতার মাত্রা বৃদ্ধি কিসের আলামত?

আনু মুহাম্মদ: কোন হিংস্রতা কোনটি থেকে কম, তা বলা কঠিন। ত্বকীকে যেভাবে টর্চার সেলে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে, বিশ্বজিৎকে যেভাবে সবার সামনে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে, ধর্ষণের পর পুড়িয়ে, গলাটিপে আরও নানা কায়দায় নির্যাতন করে যেভাবে একের পর এক খুন করা হচ্ছে, রেনুকে পিটিয়ে হত্যা—কোনটির নৃশংসতা কোনটি থেকে কম? নির্যাতনের নতুন নতুন রাস্তা বের করা হচ্ছে। কর্মস্থলে নারী-পুরুষ-শিশু–কিশোরদের নির্যাতন করে হত্যার ধারাবাহিক খবর আমরা দেখি। শিশুকে ধর্ষণ করে হত্যা, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে ধর্ষণ, পুড়িয়ে হত্যা ভয়ংকর। অপরাধী দমনে রাষ্ট্রের অকার্যকারিতাই প্রমাণিত হয়। 

প্রথম আলো: সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে, পুরো সমাজে অস্বস্তি ও অস্থিরতা বেশ বেড়েছে। কারণ কী?

আনু মুহাম্মদ: মানুষ যখন নিরাপত্তাহীন বোধ করে, যখন অনিশ্চয়তায় ভোগে, যখন পথে বের হতে, সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে, এমনকি ঘরেও ভয় নিয়ে দিন পার করে, তখন তারা কার ওপর ভরসা করবে? ভরসা করার জায়গা হলো সরকার। সরকারের বিভিন্ন শাখার কার্যক্রমে মানুষ ভরসা পাবে, সেটাই হওয়ার কথা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে সরকার, সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নিজেই ভয়ের কারণ। ত্বকী-তনু-সাগর-রুনির মতো বহু খুনের মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে ক্ষমা, ব্যাংক-শেয়ারবাজার লুটকারীদের ক্ষমতায়ন, বন-নদী দখলকারীদের প্রবল প্রতাপ, সত্যকথন–ভিন্নমত দমনে অবিরাম ভয়ভীতি প্রদর্শন, জুলুম, নতুন নতুন আইন প্রণয়ন, মাদক ব্যবসায়ীদের পৃষ্ঠপোষকতা, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সর্বত্র সরকারি দলের একক আধিপত্য, শত প্রতিবাদ, তথ্য, যুক্তি সত্ত্বেও সুন্দরবনসহ প্রাণ-প্রকৃতিবিনাশী তৎপরতা, নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করা ইত্যাদি ভূমিকা এতই নির্লজ্জভাবে হচ্ছে যে মানুষের পক্ষে কোনো ভরসা রাখা সম্ভব নয়। মানুষ এখন ভাবে ‘কিছুতেই কিছু হবে না’। সমষ্টির বিপদে সামষ্টিক মোকাবিলার পথের অভাবে ব্যক্তিগত সমাধানের খোঁজে মানুষ অস্থির।

প্রথম আলো: রাজনৈতিক প্রতিরোধের শক্তি তো নেই। কীভাবে তা ফিরতে পারে?

আনু মুহাম্মদ: রাজনৈতিক প্রতিরোধের শক্তিহীনতা মানুষের নিরাপত্তাহীনতা বাড়িয়েছে। মানুষের মধ্যে নিয়তিবাদিতা বাড়ছে। অবিরাম প্রশ্ন উত্থাপন, স্বপ্ন দেখা আর প্রতিরোধের শক্তি সন্ধান ছাড়া আর পথ নেই।

প্রথম আলো: নাগরিক সমাজ ও বুদ্ধিজীবী সমাজ কি প্রত্যাশিত ভূমিকা রাখতে পারছে?

আনু মুহাম্মদ: বর্তমান সময়ের প্রধান সংকটই বিদ্বৎসমাজের বৃহৎ অংশের আপস, সুবিধাবাদিতা, নীরবতা। এদের মধ্যে কেউ ভয়ে, কেউ নিজের ব্যক্তিগত লাভে-লোভে, কিছু পাওয়ার আশায় মিশে গেছে সরকারের সঙ্গে।

প্রথম আলো: আপনি কি স্বাধীনভাবে লিখতে, নিজের মত নির্দ্বিধায়, নির্ভয়ে প্রকাশ করতে পারছেন?

আনু মুহাম্মদ: ভয়ভীতি, ত্রাস, অনিশ্চয়তার মধ্যেও ভেতরের দায় থেকে বলতে চাই, লিখতে চাই। সাহসের ব্যাপার নয়, মানুষ হিসেবে, দেশের নাগরিক হিসেবে যা উপলব্ধি করি, দেশ ও সমাজের জন্য যা বিপজ্জনক মনে করি, যা স্বপ্ন দেখি তা বলা ও লেখা দায়িত্ব মনে করি। কিন্তু তার প্রকাশ কঠিন। কেননা, প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য বিধিনিষেধ, হয়রানি, হুমকির কারণে সংবাদমাধ্যম অনেক কিছু প্রকাশ করতে ভয় পায়। দেশের অনেক স্থানে সাধারণ আলোচনা সভা করতেও বাধাগ্রস্ত হয়েছি। সংবাদমাধ্যম যদি ভীতসন্ত্রস্ত থাকে, সত্য প্রকাশ যদি বাধাগ্রস্ত হয়, তখন যে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তার মধ্যেই গুজব জায়গা নেয়। রেনুর রক্তাক্ত মুখে গুজবের ভয়ংকর চেহারা আমরা দেখতে পাচ্ছি। ধমক দিয়ে গুজব থামানো যাবে না। তথ্য প্রকাশ, সত্য প্রকাশে যদি ভয়ভীতির রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করা হয়, তাহলে গুজব ডালপালা মেলবেই।

প্রথম আলো: তাহলে বাংলাদেশ যাচ্ছে কোন দিকে? এই পরিস্থিতি থেকে কীভাবে বেরোনো যাবে?

আনু মুহাম্মদ: লুম্পেন ও চোরাই কোটিপতি এবং জবাবদিহিহীন রাজনীতিবিদদের হাতে দেশ জিম্মি। ‘উন্নয়ন’এবং ‘রাজনীতি’ দুটোই এখন বলপ্রয়োগ ও বিজ্ঞাপনের বিষয়। সরকার জনগণকে দূরে ঠেলে দিয়ে বলপ্রয়োগকারী সংস্থা ও বিজ্ঞাপনী সংস্থার সহায়তা নিয়ে দেশ চালাচ্ছে। এই কর্তৃত্ববাদী শাসনে প্রতিষ্ঠান ভেঙে যাচ্ছে, মানুষ প্রান্তিক হয়ে যাচ্ছে। প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ চুরমার হয়ে যাচ্ছে। সমাজে মানুষ যাতে কোনো কিছু নিয়ে প্রশ্ন না করে, পর্যালোচনা-বিশ্লেষণ ছাড়া সরকার যা বলে, তা–ই গ্রহণ করে, তার জন্য সব ক্ষমতা প্রয়োগ করছে সরকার। প্রশ্নহীন, রোবট সমাজ বানানোর চেষ্টার মধ্যে পর্যালোচনাহীন ধর্ম-জাতীয়তাবাদ-প্রবৃদ্ধি হয়ে দাঁড়ায় অস্ত্র। অদৃশ্য নানা শক্তি তখন পুষ্টি পেতে থাকে। এভাবে চলতে থাকলে সামনে আরও বিপদ বাড়বে। প্রতিষ্ঠিত বুদ্ধিজীবী ও নাগরিক সমাজের নেতারা যখন লুটেরা, সন্ত্রাসী ও কর্তৃত্ববাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন, যখন শাসকদের রাজনীতি দেউলিয়া, তখন ভরসা করতে হবে নতুন বুদ্ধিবৃত্তিক, রাজনৈতিক শক্তির ওপর। শত বৈরিতার মধ্যেও তরুণদের মধ্যে এখনো সেই সম্ভাবনা দেখি, দেখতে চাই।

প্রথম আলো: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

আনু মুহাম্মদ: ধন্যবাদ।

আরও পড়ুন:
নাগরিক সমাজের নীরবতা জাতির সঙ্গে বেইমানি