Thank you for trying Sticky AMP!!

যেভাবে রামগরুড়ের ছানা হয়ে যাচ্ছে সবাই

রামগরুড়ের ছানা/ হাসতে তাদের মানা—এটি একটি প্রচলিত ছড়া। কিন্তু বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে বলা যায়, আমাদের সমাজের ৮৫ শতাংশ মানুষই রামগরুড়ের ছানা। হাসি নেই, আড্ডা নেই, বেড়ানো নেই। সবাই সবার মতো প্রবহমান। এই একা থাকায় তাদের কোনো কষ্ট নেই, অনুযোগ নেই। নিজ থেকেই বেছে নেয় সবাই একাকিত্ব। মজার বিষয় এই যে জীবনের একটা পর্যায়ে এসে মানুষ যখন একাকিত্বের চরম পর্যায়ে পৌঁছায়। তখন মানুষ নিজেদের দোষী না করে একাকিত্বের ওপর, সমাজের ওপর, পরিবারের ওপর বা বন্ধুদের ওপর দোষ চাপায়। বলা উচিত, চেনা-জানা মানুষদের ওপর। কারণ, তারা কখনো বন্ধুই বানায়নি বা সাধারণ কথাবার্তা বলার মতো আন্তরিকতার সম্পর্কটুকুই তৈরি করেনি। ফলস্বরূপ অনেকে একটা কাগজে এক বা দুই বাক্য থেকে শুরু করে হাজার বাক্যের লেখা চিঠি কিংবা তথাকথিত ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। এর কারণ কি শুধু ব্যক্তি নিজে বা তাদের স্বেচ্ছাচারিতা? না। এর কারণ আমাদের আধুনিক সভ্যতা, যান্ত্রিকতা, নগরায়ণের কুফল। আধুনিক সভ্যতায় কোনো কিছুর অভাব নেই। কিন্তু একটু ঠান্ডা মাথায় বিবেচনা করলে এখানে সবকিছুতে এই অভাব বিদ্যমান। সবচেয়ে বড় অভাব আন্তরিকতার, মানবিকতার।

দশে মিলে করি কাজ, হারি জিতে নাহি লাজ—এই প্রবচন এখনো প্রথম শ্রেণি থেকে আমাদের মাথায় ঢোকানো হয়। কিন্তু যারা ঢোকায় কিংবা ঢোকানোর চেষ্টা করে, তাদের মাথায় এটা কতটুকু ঢোকে, সেটাই আমার প্রশ্ন। একই প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘদিন কাজ করার পরও দেখা যায় পরস্পরকে চেনায়ই হয়নি। ঠিকমতো কথা বলাও হয়নি। তারা প্রত্যেকে প্রত্যেকের জায়গা থেকে চিন্তা করে, ‘আগে থেকে কথা বললে যদি ছোট হয়ে যাই।’ এসবকে বলা যায় আত্মদ্বন্দ্ব বা আত্ম–অহংকার।

সবাই যেকোনো কাজের কৃতিত্ব একা নিতে চায়। যার প্রভাব পড়ে ছোটদের ওপর। ফলে একধরনের নোংরা প্রতিযোগিতার সঙ্গে জীবনের শুরুতেই জড়িয়ে যায় তারা। বন্ধুত্বের সম্পর্কে তৈরি হয় হিংসা, ভেদাভেদ। শেষ পর্যন্ত তাদের মুখ থেকে হাসি নামের বস্তুটাই হারিয়ে যায়। হয়ে উঠে তারা আন্তরিকতাহীন, মানবিক বোধবর্জিত রামগরুড়ের ছানা।

এর পেছনে শুধু শিক্ষকেরাই দায়ী নন, বাবা–মায়েরাও দায়ী। তারা সন্তানদের ঘরের ভেতর আবদ্ধ করে রাখতেই বেশি পছন্দ করেন। কারণ, নানা ধরনের বাচ্চার সঙ্গে মিশে তাদের সন্তান খারাপ হয়ে যাবে। ফলে বাচ্চারা হয়ে উঠছে ঘরকুনো ব্যাঙ। ঘরবন্দী রাখার দায়ে তাদের হাতে তুলে দিচ্ছে অতি অল্প বয়সেই কম্পিউটার ও মোবাইল গেম। এতে বাচ্চা এত বেশি আসক্ত হয়ে যাচ্ছে যে দিন শেষে বাবা–মায়েরা তাদের পূর্বের কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা করে। কিন্তু তত দিনে দেরি হয়ে যায়। যার পরিণতি কতটা খারাপ হতে পারে, সেটি আশপাশে খেয়াল করলে বা সংবাদমাধ্যমগুলোর খবর দেখলে বোঝা যায়।

সন্তানের শৈশব নষ্ট হয়ে যায়। কৈশোর বা যৌবনে পদার্পণ করার পর সেটি তখন হিতে বিপরীত হয়ে দাঁড়ায়। অনেকেই এর মধ্যে গড়ে তোলে ঠুনকো বন্ধুত্ব কিংবা প্রেমের সম্পর্ক। সেই সম্পর্কের মধ্যে তারা আবার প্রতিষ্ঠা করতে চায় স্ব স্ব জায়গা থেকে আমিত্ব। আমিত্বের রাজ্যে তারা হয়ে ওঠে স্বার্থপর, হিংসুটে। তারা হতে চায় সবাই সবার জায়গা থেকে সেরা। যখন সেটা তারা পারে না, তখন হারিয়ে যায় হতাশার গভীরে। একাকিত্বের বা ভেঙে যাওয়া বন্ধুত্বের করুণ কাহিনি কাউকে শোনাতে পারে না তারা। মেনে নিতে পারে না হতাশা, তারা বেছে নেয় আত্মহত্যা। অনেকে আবার পুনরায় আলিঙ্গন করে মুঠোফোন বা কম্পিউটারকে। যখন জীবনের বিস্তৃত পথ আলিঙ্গন করতে আসে, তখন তারা অনুভব করে একজন বন্ধু বা কাছের মানুষের অভাব, যাকে আনন্দ বা কষ্টের কথা বলতে পারবে, যার কাছে প্রাণখুলে হাসতে পারবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হতাশার, একাকিত্বের চাদরে তারা এত বেশি আটকে যায়, তারপর আর হাসতে পারে না। তারা হয়ে যায় চিরায়ত রামগরুড়ের ছানা।

খাদিজা চামেলী
নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলা বিভাগ