Thank you for trying Sticky AMP!!

শ্যামাসুন্দরী খাল

শ্যামাসুন্দরীর আর্তনাদ বন্ধ হবে কবে

শ্যামাসুন্দরী রংপুর নগরীর একটি খালের নাম। খালটি রংপুরের ফুসফুস বলে পরিচিত। এটি খাল হলেও এর দৈর্ঘ্য ১৬ কিলোমিটার ও গভীরতা ৪০ ফুটের বেশি ছিল। বায়ুবাহিত রোগ থেকে পরিত্রাণ ও জলাবদ্ধতা দূরীকরণের উদ্দেশ্যে খালটি ১৮৯০ সালে খনন করা হয়।

নগরীর সিও বাজার এলাকার ঘাঘট নদের উৎসমুখ থেকে শুরু হয়ে খোখসা ঘাঘটের সঙ্গে মিলেছে। মাকড়সার জালের মতো রংপুর নগরীর আষ্টেপৃষ্ঠে রয়েছে এই খাল। একটা সময় নদীর মতো স্রোত ও প্রবাহ ছিল। মহানগরীর সব পানি এই শ্যামাসুন্দরী খালের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে তিস্তা নদীতে পতিত হয়েছিল।

ইউটিউবে কিংবা গুগলে শ্যামাসুন্দরী লিখে সার্চ দিলে একাধিক খবর আমাদের চোখে পড়ে। কিন্তু নদী নালা বিষয়ে আমাদের মন যেন অন্তঃসারশূন্য হয়ে গেছে। এত এত লেখালেখি, সেমিনার ও আন্দোলন, তবু যেন শ্যামার দুঃখ ঘুচছে না। আর কত জান্নাতুল মাওয়াদের কান্নায় স্থানীয় কিংবা কেন্দ্রীয় সরকারের নজরে আসবে কেউই জানে না।

কিন্তু এটা জানি, খালটির একটা গৌরবময় অতীত ছিল। গোসলের প্রয়োজন হলে মানুষ দৌড়ে গিয়ে লাফ দিত, মন ভরে গোসল করত, মাছ চাষ করে নিজের চাহিদা মেটাত এবং আয়ও করত। তখন পানির রং ছিল চকচকে ও ধবধবে। পাশাপাশি শহরের জলাবদ্ধতা দূরীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। সব নদীর পানি যেমন বঙ্গোপসাগরে মেশে, তেমনি রংপুর নগরীর পানি বুকে নেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছিল শ্যামাসুন্দরী।

গতকালের আশীর্বাদ আজকে যেন অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। খালে লাফ দেওয়া তো দূরের কথা, পাশ দিয়ে হাঁটাও কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। গ্র্যান্ড হোটেলের মোড় দিয়ে যখন আমি নয়াটোলায় প্রাইভেট পড়াতে যাই, নাকে কাপড় কিংবা টিস্যু দিয়ে খালটি পার হতে হয়। বর্তমানে শহরের বুকে কয়েক ঘণ্টা বৃষ্টি পড়লেই বিভিন্ন জায়গায় জলাবদ্ধতা দেখা যায়। ২০১৯ সালের বন্যা উৎকৃষ্ট উদাহরণ। শ্যামাসুন্দরী ভরাট হওয়ার কারণে পানির প্রবাহ নেই বললেই চলে। মানুষ এখন ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত করেছে। ঘরবাড়ির বিভিন্ন আবর্জনা খালে ফেলে দিচ্ছে।

ফলে স্তূপে ভরাট হয়ে দিন দিন সংকুচিত হচ্ছে। একসময়ের স্বচ্ছ পানির এই খাল বর্তমানে দুঃস্বপ্নের চেয়েও ভয়াবহ। মানুষের গোসল করা তো দূরের কথা, খালের কাছাকাছি গিয়ে নিশ্বাস নেওয়া কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন খালের কালো বর্ণ ধারণ করা দূষিত পানি আর ময়লা-আবর্জনার দুর্গন্ধে পাশ দিয়ে হাঁটাও চ্যালেঞ্জ হয়েছে রংপুরবাসীর।

শুধু তা-ই নয়, এই খাল এখন মশা প্রজননেরও কারখানা। মশার অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। ফলে সেখানকার মানুষ বায়ুবাহিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার অনেক ঝুঁকিতে আছে। বিশেষ করে রংপুর নগরীর বিভিন্ন স্কুলের ছোট ছোট শিক্ষার্থী হুমকির মধ্যে আছে। রংপুর নগরীর অনেকটা অংশ জুড়ে শ্যামা থাকায় অধিকাংশ মানুষ এই সমস্যার ভুক্তভোগী।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই খালের সেবা–শুশ্রূষা না করলে রংপুর শহর বসবাসের অনুপযোগী হতে পারে। মানুষ যে পরিমাণ ময়লা–আবর্জনা খালে ফেলছে এবং দখল করে নিচ্ছে, খুব দ্রুত এই খাল বিলীন হতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন।

আমার প্রশ্ন হচ্ছে, খালটির সঙ্গে আমাদের এমন আচরণ আসলে কতটুকু ঠিক হচ্ছে? রংপুর শান্তিপ্রিয় একটি শহর। সবুজময় প্রকৃতির ভিড়ে মানুষও সহজ–সরল। কিন্তু রংপুর বিভাগের সমস্যা সমাধান করার মতো কি কেউ নেই?

রংপুর শহরে কি ব্যারিস্টার সুমনের মতো নেতা জন্ম নেবে না? যে নেতা বলবে,  ‘মুই খালোত নামছু, তোমরা সবাই খালোত নামো, হামরা খালের যৌবন ফিরিয়ে দেই।’ যদি ব্যারিস্টার সুমন থাকতেন শ্যামাসুন্দরীর আর্তনাদ হয়তো শুনতে হতো না।

বলাই যায়, আমাদের পোড়া কপাল। শুধু এই খালেই নয়, রংপুর বিভাগের তিস্তা মহাপরিকল্পনা মিডিয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ, সরকারের কোনো মেগা প্রজেক্টের একটিও নেই।
চোখের সামনে প্রবহমান একটি খাল বিলীন হয়ে যাচ্ছে। নদীর সঙ্গে মিশে আছে আমাদের আবেগ, ঘাম, ভালোবাসা ও কবিতা। কবিরা কলমের কালিতে নদীকে ঠাঁই দিয়েছে। জেলেদের আবাসস্থল যেন নদী নালা।

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। নদীর সঙ্গে বাঙালির একটা জনম জনমের সম্পর্ক বিদ্যমান। কিন্তু সমাজের মানুষ নদীর সঙ্গে কি ভালো ব্যবহার করছে? দেশের অধিকাংশ নদীই আজ মুমূর্ষু।

আজকে নদীগুলো প্রাণভরে নিশ্বাস নিতে পারছে না। একটুখানি বেঁচে থাকার আকুতি–মিনতি করছে। হাউমাউ করে কাঁদছে। দম বন্ধ হয়ে মারা যাচ্ছে। শ্যামাসুন্দরী তাদের মধ্যে একটি। শ্যামাসুন্দরী খালটির সুন্দরী ট্যাগটি আজকে বড্ড বেমানান দেখাচ্ছে। সবার মতো শ্যামাও আজকে বাঁচতে চায়। রংপুর নগরীর সব পানির দায়িত্ব সে নিতে চায়। তার দায়িত্ব পালনে আমরা কি হাত বাড়িয়ে দিতে প্রস্তুত?

মো. মমিনুর রহমান
শিক্ষার্থী, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর